৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:৪১:১৫ অপরাহ্ন


যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলবিরোধী মত দমন ও বাক-স্বাধীনতার সংকট
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-০৬-২০২৫
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলবিরোধী মত দমন ও বাক-স্বাধীনতার সংকট


ইসরায়েলবিরোধী সমালোচনাকে আইনি কাঠামোর মধ্যে এনে তা দমন করার লক্ষ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে অ্যান্টিসেমিটিজম সংজ্ঞা আইনে পরিণত হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল হলোকাস্ট রিমেমব্র্যান্স অ্যালায়েন্সের অ্যান্টিসেমিটিজম সংজ্ঞাকে ভিত্তি করে এই আইনগুলো প্রণয়ন করা হচ্ছে, যা সমালোচকদের মতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করছে এবং শিক্ষাঙ্গন, জনপরিসর ও রাজনৈতিক আলোচনায় একধরনের ভয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণ তৈরি করছে। ভার্জিনিয়া, ওকলাহোমা, ক্যানসাস, ফ্লোরিডাসহ একাধিক রাজ্যে এই সংজ্ঞাকে আইন বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে কার্যকর করে পাঠ্যক্রম পর্যালোচনা, পুলিশ প্রশিক্ষণ এবং প্রতিবাদী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল হলোকাস্ট রিমেমব্র‍্যান্স অ্যালায়েন্সের সংজ্ঞা অনুসারে, অ্যান্টিসেমিটিজম হলো ইহুদিদের প্রতি নির্দিষ্ট ধরনের ঘৃণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি, যার উদাহরণ হিসেবে ১১টি পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি উদাহরণ সরাসরি ইসরায়েল সম্পর্কিত, যেমন- ইসরায়েলকে অতিরিক্ত সমালোচনার মুখে ফেলা, নাৎসিদের সঙ্গে তুলনা করা, বা ইসরায়েল রাষ্ট্রকে ‘বর্ণবাদী প্রচেষ্টা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা। সংজ্ঞার সবচেয়ে বিতর্কিত দিক হলো- ইহুদি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অস্বীকার করাকে অ্যান্টিসেমিটিজম হিসেবে চিহ্নিত করা, যার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অ্যান্টি-জায়োনিজম বা ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিরোধিতা আইনি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এই সংজ্ঞার রাজনৈতিক ব্যবহার যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি এটি আইনবিশেষজ্ঞ ও নাগরিক স্বাধীনতাবিষয়ক সংগঠনগুলোর সমালোচনার মুখে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, টেক্সাসে গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ইন্টারন্যাশনাল হলোকাস্ট রিমেমব্র‍্যান্স অ্যালায়েন্স সংজ্ঞা বাধ্যতামূলক করার আদেশ দেন, যা ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট লঙ্ঘনের অভিযোগে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হলে, এক ফেডারেল বিচারক তা স্থগিত করেন। ফ্লোরিডায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়, যেসব কোর্সে ইসরায়েল, প্যালেস্টাইন, জায়োনিজম, ইহুদি ইত্যাদি শব্দ রয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করতে। এমনকি ‘টেরোরিজম অ্যান্ড হোমল্যান্ড সিকিউরিটি’ নামক একটি পাঠ্যবই নিষিদ্ধ করা হয়, কারণ সেটিকে প্রো-মুসলিম টেরর বলে বিবেচনা করা হয়েছিল, যদিও সংশ্লিষ্ট আইনপ্রণেতা পরে স্বীকার করেন, তিনি বইটি পড়েননি।

ওকলাহোমায় একটি নতুন আইনে বলা হয়েছে, পাবলিক স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইহুদি বিদ্বেষমূলক বৈষম্য অনুসন্ধানে ইন্টারন্যাশনাল হলোকাস্ট রিমেমব্র‍্যান্স অ্যালায়েন্সের সংজ্ঞা অনুসরণ করে একজন ‘টাইটেল চার কো-অর্ডিনেটর’ নিয়োগ দিতে হবে। ক্যানসাসে, বিক্ষোভে মুখোশ পরে ইহুদি সম্প্রদায়ের সদস্যদের হয়রানি করা হলে তা আইনি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। বিভিন্ন রাজ্যে স্কুল পাঠ্যসূচি, ক্লাব ফান্ডিং এবং পাঠাগার নিয়ন্ত্রণেও এই সংজ্ঞার ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে, যার ফলে ছাত্রদের বাক-স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক মতপ্রকাশ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল হলোকাস্ট রিমেমব্র্যান্স অ্যালায়েন্সের সংজ্ঞার সমর্থনে কাজ করছে প্রভাবশালী ইহুদি সংগঠন ও রাজনৈতিক লবি গ্রুপগুলো, যেমন- অ্যান্টিডিফেমেশন লিগ (এডিএল) ও কমব্যাট অ্যান্টিসেমিটিজম মুভমেন্ট। তাদের দাবি, এই সংজ্ঞা এখন পর্যন্ত ৪০টিরও বেশি দেশ, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এবং ৩৫টির বেশি মার্কিন রাজ্যে গৃহীত হয়েছে। তবে সংজ্ঞার মূল রচয়িতা কেনেথ স্টার্ন নিজেই এর আইনি প্রয়োগের বিরোধিতা করে বলেন, এটি একটি রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত হয়েছে, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত হানে। তার ভাষায়, যেভাবে কেউ কনফেডারেট মূর্তি অপসারণের বিরোধিতা করলে তাকে বর্ণবাদী বলা হয়, ঠিক তেমনভাবে এই সংজ্ঞার মাধ্যমে সমালোচনাকে অ্যান্টিসেমিটিজম হিসেবে লেবেল দেওয়া হচ্ছে।

২০১১ সালে তৈরি হওয়া এই সংজ্ঞার বিকল্প হিসেবে ২০২১ সালে শতাধিক ইহুদি একাডেমিক জেরুজালেম ডিক্লারেশন অন অ্যান্টিসেমিটিজম নামে একটি সংজ্ঞা প্রকাশ করেন, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়, ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় নীতির সমালোচনা বা অ্যান্টিজায়োনিজম সর্বদা অ্যান্টিসেমিটিজম নয়। বাইডেন প্রশাসনের ২০২৩ সালের জাতীয় অ্যান্টিসেমিটিজম কৌশলপত্রে ইন্টারন্যাশনাল হলোকাস্ট রিমেমব্র‍্যান্স অ্যালায়েন্সের সংজ্ঞার পাশাপাশি আরো একটি সংজ্ঞা নেক্সাস ডেফিনেশন উল্লেখ করা হয়, যা বাক-স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষার দিকে অধিকতর মনোযোগ দেয়।

এই বিতর্কিত সংজ্ঞা ও তার আইনি প্রয়োগ যুক্তরাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর একটি স্পষ্ট চাপ সৃষ্টি করছে। নাগরিক অধিকার সংগঠন, মানবাধিকারকর্মী এবং শিক্ষাবিদরা আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতে যদি এই প্রবণতা আরো বিস্তৃত হয়, তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোর মৌলিক ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাঙ্গনে মতের ভিন্নতা ও রাজনৈতিক চর্চাকে যদি রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

শেয়ার করুন