৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৭:২৮:০৩ অপরাহ্ন


জুলাই সনদে বিএনপিকে চুপ রাখলেন ড. ইউনুস
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-০৬-২০২৫
জুলাই সনদে বিএনপিকে চুপ রাখলেন ড. ইউনুস ড. মূহাম্মদ ইউনূস


ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ দ্রুত হতে হবে। ডিসেম্বরেই সম্ভব এই নির্বাচন। কোনো ধরনের দেরি হলে ষড়যন্ত্র দানা বেধে উঠবে। এমন দাবিতে বেশ কয়েক মাসই মাঠ গরম করে তুলেছে বিএনপি। নিবন্ধিত সব প্রায় সব রাজনৈতিক দল বিএনপি’র সাথে এখন ইস্যুতে একাট্টা। ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের ব্যাপারে হাটে-মাঠে-ঘাটে চলছে এনিয়ে বাক-যুদ্ধ। অভিযোগের তীর ছোড়া হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের খোদ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে। যাকে এতোদিন নিজেদের লোক, নিজেদের লোক বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে সে-ই উল্টো সুরে কথা বলা শুরু করেছে। বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ মন্তব্য করা শুরু করেছেন- তারা নাকি লোক চিনতে ভুল করেছেন। 

হুংকার ছেড়ে বলছেন, ছাত্র-জনতার বিজয়ের সুফল যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ভোগ করতে চায়, তাহলে তাদের স্থান হবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। আবার কারো অভিযোগ সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধেও। বলা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু কিছু উপদেষ্টা বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্টে নানা ছবক দিচ্ছেন। এখন বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদের মুখে এমন আওয়াজ আরও জোরালো হয়েছে । কেননা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের খোদ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাপানে বসে এক কঠিন অভিযোগ ছুড়ে মারেন। তিনি বলেছেন, একটি মাত্র দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। সেটি যে বিএনপিকে উদ্দেশ করে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন তা আর কারো বাকি নেই রাজনৈতিক মাঠে। তার এমন মন্তব্য জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো কাজ করেছে। 

ফুসে উঠেছে বিএনপি’র নেতারা। জাপান সফরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মন্তব্যে বিএনপি’র কোনো কোনো নেতার কণ্ঠে হতাশা প্রকাশ পায়। জানান যে, তারা বিদেশের মাটিতে বসে ড. ইউনুসের এমন মন্তব্যে হতাশ হয়েছেন। এসময় বিএনপি’র সাথে দীর্ঘদিন ধরে যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সব রাজনৈতিক দলগুলিও সরাসরি প্রতিবাদ না করলেও তারা তাদের মনের কথা জানিয়ে দেয়। স্পষ্ট করে তারা তাদের অভিমত জানায় বক্তব্যে, লেখনি ও টক-শোসহ বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায় তারাও। এসময় বেশ কয়েকটি প্রথম সারির গণমাধ্যম তথ্য-উপাত্ত দিয়ে কয়েকটি তথ্যবহুল সংবাদ প্রকাশ করে। তাদের নিজস্ব অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে যে, দেশের প্রায় অর্ধশত রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়। যারা সবই বিএনপি’র সাথের ফ্যাসিবাদ পতন অন্দোলনে দীর্ঘদিনের সঙ্গী ছিল। 

এদিকে বিদেশের মাটিতে বসে একটি মাত্র দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়-বিএনপিকে উদ্দেশ করে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এধরনের মন্তব্যে দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকার ইঙ্গিত পায় বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলি। বিএনপি’র মনে সন্দেহের দানা আরও কঠোর হতে থাকে। তারা মনে করেন, নির্বাচনী রোডম্যাপ না দিলে বিএনপিকে আবার মাঠে নামতে হবে। ডাক দিতে হবে আন্দোলরে। মাঠ পর্যবেক্ষণ করে তেমনটাই আভাস মিলেছে। এদিকে একটি মহল হাটে মাঠে ঘাটে আলোচনার ঝড় বইয়ে দেয় এই বলে যে, ডিসেম্বরে বিএনপি নির্বাচন চাইছে ভারতীয় আবদার পূরণের জন্য।

এটা ভারতের এজেন্ডা। কিন্তু এমন প্রচারণা যে দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর তা বিএনপি’র সাথে চলা যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা টের পায়। তারা গর্জে উঠে তারা..। বুঝিয়ে দেন কারো কারো এধরনের বক্তব্য এদেশে ভারতের আধিপত্য কূটকৈৗশলকে একধরনের স্বীকার করে নেয়ার মতই। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এমনটা খোলাসা করেন বিএনপি’র সাথে যুগপৎ আন্দোলনে দীর্ঘদিনের সঙ্গী গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি ওই অনুষ্ঠানে বিষয়টি পরিস্কার করেন। নিজেদের প্রয়োজনে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন দরকার বলে মন্তব্য করেন জোনায়েদ সাকি। তিনি বুঝিয়ে দেন যে, ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শেখ হাসিনা সরকার যে ফ্যাসিস্ট রোলার চালিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে দেশে ঐক্য গড়ে উঠেছে। এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভারতের এজেন্ডা-এমন কথা বলে জনগণের ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে ওই দেশটির পারপাস সার্ভ করা হচ্ছে। এ প্রচার ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনে সাহায্য করবে। সাকি সর্তক করে বলেন, ভারতের কোনো মিডিয়া কিংবা কোনো রাজনীতিক বাংলাদেশে নির্বাচন চাইলেন, আর এখানে নির্বাচনের দাবি করা ভারতের ইচ্ছা অনুযায়ী হচ্ছে বলে মনে করা অত্যন্ত বিপজ্জনক।

এদিকে একটি মাত্র দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়-বিএনপিকে উদ্দেশ করে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এমন মন্তব্যে বিএনপিও বসে থাকেনি। তারা সাফ সাফ জানিয়ে দেয় কিছুটা সময় দিয়ে অর্থ্যাৎ পর্যবেক্ষণ শেষে দ্রুত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নির্বাচনের দাবিতে মাঠে কঠোর আন্দোলনে নামবে।

জাপানের মাটিতে বসে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কানে তোলা হয় তার ওই মন্তব্যের পর বাংলাদেশের মাটিতে কি হচ্ছে? বলা হয় যে ইতোমধ্যে ড. ইউনুসের শাসনামল নিয়েও কথা উঠে গেছে বিদেশেী গণমাধ্যমে। কেননা আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা রয়টার্স-ও এক প্রতিবেদন নিয়ে নতুন চিন্তা দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক এই গণমাধ্যমে খবরে বলা হয় যে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গত আগস্টে ১৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষের দেশটিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ৮৪ বছর বয়সী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর থেকে নানামুখী চাপে পড়ে তার সরকার। এতে করে পরিস্কার হয়ে যায় ডিসেম্বর বা দ্রুত নির্বাচনের বিপক্ষের পার্টির উদ্দেশ্যই বা কি?

এত্তোসব ঝক্কি ঝামেলার মধ্যে মাঝে গুঞ্জন উঠে যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করতে পারেন। আর এমন খবর পেয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। চারিদিকে এমন খবরে দেশে একটা অন্যরকম পরিস্থিতির তৈরি হয়। এসময় বিএনপির স্থায় কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিএনপি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ চায় না, বিএনপি চায় নির্বাচনী রোডম্যাপ। তবে শেষমেষ যে কারণেই হোক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগের বিষয়টি আসলে আস্তে আস্তে হাওয়া মিলিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে নতুন আলোচনা মাঠে পেয়ে বসে যখন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাপানে বসে ওই মন্তব্যে করেন, ‘যে একটি মাত্র দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। 

জানা গেছে, জাপানে সফর করা অবস্থায় তুলে ধরা হয় তার এমন বক্তবে বাংলাদেশে কি তোলপাড় হচ্ছে। জানানো হয় যে, একটি মাত্র দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়-বিএনপিকে উদ্দেশ করে এধরনের মন্তব্যে বাংলাদেশে কারো কারো সন্দেহ ড. মুহাম্মদ ইউনূস দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকার ইঙ্গিত। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আরও জানানো হয় যে, তার এমন মন্তব্যের জেরে বিএনপি হয়তবা নির্বাচনী রোডম্যাপের দাবি নিয়ে বড় ধরনের আন্দোলনে দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়বে। এধরনের অবস্থা তৈরি হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে দেশে বিদেশে তার আন্তর্জাতিক সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। অভিযোগ উঠতে পারে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুসও ফ্যাসিবাদের পক্ষে হাঁটছেন। আর সুদূর জাপানে বসে এমন অবস্থা টের পেয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিছু সিদ্ধান্ত নেন। বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে ড. মুহাম্মদ ইউনূস আলোচনার জন্য বিএনপিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আমন্ত্রণ জানান। 

সর্বশেষ খবর হলো অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ওই বৈঠকের আয়োজনে যা যা করেছেন তা-তে বিশ্লেষকরা মনে করেন এতে করে আপাতত বিএনপি’কে জুলাই সনদের তৈরির দোহাই দিয়ে চুপ রাখা হলো। এই জুলাই সনদে যেনো জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বিএনপি কি করে তা পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।

তবে একটি সূত্র জানায় জুলাই সনদের কথা বলে একদিকে তিনি ২০২৪ সালে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যে আন্দোলন হয়েছিল তার পক্ষে অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে বিশেষ করে বিএনপি’কেই একধরনের মানসিক চাপে রাখা হয়েছে। কেননা শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের’ যে কথা উঠেছিল, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেটিরও বাস্তবায়ন দেখতে চায় তারা। আর এক্ষেত্রে ড. ইউনুস এমন কথা বলে বাংলাদেশে সেই জুলাই বিপ্লবে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের সহানুভুতি দেখালেন। কেননা ড. ইউনুস জানেন নির্বাচনের সময়ের চেয়েও জুলাই বিপ্লবের সেই অকুতোভয় শিক্ষার্থীরা জুলাই সনদের গুরুত্ব বেশি ও অনেক আবেদন তৈরি করবে জাতির কাছে। 

তাছাড়া দায়িত্ব নেয়ার সময় ‘জুলাই সনদের’ কথাও প্রধান উপদেষ্টা নিজে বলেছেন। জানিয়েছিলেন সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা সনদ তৈরি হবে। তাই ওই জায়গায় এখন তিনি হাত দিলেন। জানা গেছে বাংলাদেশের রূপরেখা কেমন হবে, কী কী সংস্কার এই সময়ে করা হবে, কী কী সংস্কার ভবিষ্যতে করা হবে, কী কী সংস্কারের ধারাবাহিকতা থাকবে-রাজনৈতিক দলগুলোকে সেই কমিটমেন্ট (অঙ্গীকার) জনগণের কাছে দিতে হবে- যাকে জুলাই সনদ বলা হচ্ছে। তবে এর পাশাপাশি ড. ইউনূস সংলাপ ডেকে দেশে-বিদেশে বার্তা দিলেন এই বলে যে যতোই মতবিরোধ থাকুক না কেনো দেশের রাজনৈতিক দলকে নিয়ে তিনি একসাথে বসে কথা বলার মতো পরিবেশ পরিস্থিতি এখনো ধরে রেখেছেন। এখন সামনের দেখা যাবে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কয়মাস টেনে নেন ড. ইউনুস।

শেয়ার করুন