৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৫:১৯:৪৮ অপরাহ্ন


কানাডীয় আমদানির ওপর শুল্ক
বিলুপ্তির মুখে যুক্তরাষ্ট্রের ছোট আকারের পত্রিকা শিল্প
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-০৪-২০২৫
বিলুপ্তির মুখে যুক্তরাষ্ট্রের ছোট আকারের পত্রিকা শিল্প


যুক্তরাষ্ট্র সরকার সম্প্রতি কানাডা থেকে আমদানিকৃত নিউজপ্রিন্টের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। যদিও এই পদক্ষেপকে জাতীয় নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন সুরক্ষার নামে বৈধতা দেওয়া হয়েছে, বাস্তবে এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের ছাপা সংবাদপত্রশিল্পে, বিশেষ করে ছোট ও স্থানীয় পত্রিকাগুলোর ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের ছোট শহর ও গ্রামীণ এলাকার স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো বহুদিন ধরেই আর্থিক সংকটে ভুগছে। এই সংকটের মধ্যেই নতুন করে এক বড় আঘাত এসেছেÑ কানাডা থেকে আমদানি করা সংবাদপত্রের কাগজের ওপর শুল্ক আরোপ। মার্কিন প্রশাসনের যুক্তি, কানাডা থেকে কম দামে নিউজপ্রিন্ট আমদানি করার ফলে দেশের নিজস্ব কাগজ উৎপাদকরা ক্ষতির মুখে পড়ছে। তাই স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে ও বিদেশি নির্ভরতা কমাতে এই শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত সংবাদপত্রের কাগজের প্রায় ৮০ শতাংশই আসে কানাডা থেকে। বহু বছর ধরে এই দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতাভিত্তিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এই শুল্ক সেই ভারসাম্যে গুরুতর আঘাত হেনেছে।

স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর জন্য কাগজের খরচ হলো বাজেটের অন্যতম বড় অংশ। ২৫ শতাংশ শুল্কের ফলে সেই খরচ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় অনেক ছোট পত্রিকা মারাত্মক অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। ২০২৫ সালের ১১ মার্চ থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও আপাতত তা ৯০ দিন স্থগিত রাখা হয়েছে। যদিও সময়সীমা পেছানো হয়েছে, এই শুল্কের সম্ভাবনা মাত্রই যথেষ্ট আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে, ২০১৮ সালের অনুরূপ শুল্কের ফলে সংবাদপত্রের কাগজের দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। এর ফলে দেশজুড়ে অনেক পত্রিকায় কর্মী ছাঁটাই, পৃষ্ঠা সংখ্যা কমানো এবং বিজ্ঞাপন হারানোর মতো প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে মাত্র ছয়টি বড় নিউজপ্রিন্ট উৎপাদনকারী মিল রয়েছে, যেগুলো মোট চাহিদার তুলনায় অনেক কম উৎপাদন করতে সক্ষম। ফলে ছোট পত্রিকাগুলোর কাছে বিকল্প উৎসের অভাব রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন না বাড়ালে বা কানাডা থেকে আমদানি চালু না থাকলে অনেক পত্রিকা চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটি করে কমিউনিটি পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ২০২৩ সালেই গড়ে প্রতি সপ্তাহে দুটির বেশি, অর্থাৎ মোট ১২৭টি পত্রিকা তাদের কার্যক্রম বন্ধ করেছে। ২০০৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশে মোট ৩ হাজার ২০০টিরও বেশি ছোট ও স্থানীয় সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। এই সংকটের পেছনে রয়েছে অনলাইন মাধ্যমের প্রভাব, বিজ্ঞাপন রাজস্বের ধ্বস এবং ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ব্যয়। বর্তমানে সেই সংকটে যোগ হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত ২৫ শতাংশ নিউজপ্রিন্ট আমদানি শুল্ক, যা কানাডা থেকে আমদানিকৃত সংবাদপত্রের কাগজের ওপর আরোপ করা হতে পারে।

কানাডা থেকেই আসে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত নিউজপ্রিন্টের প্রায় ৮০ শতাংশ। তাই এই শুল্ক কার্যকর হলে কাগজের দাম আরো বেড়ে যাবে। নিউজপ্রিন্ট হলো ছোট সংবাদপত্রগুলোর দ্বিতীয় বৃহত্তম খরচের খাত (মানবসম্পদের পরেই)। ফলে এতটুকু বাড়তি ব্যয়ও অনেক পত্রিকার পক্ষে বহন করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। বাড়তি খরচ সামলাতে তাদের হয় পাঠকের কাছে সাবস্ক্রিপশন ফি বাড়াতে হবে, নয়তো বিজ্ঞাপনের মূল্য বাড়াতে হবে, যা আবার নতুন করে পাঠক ও বিজ্ঞাপনদাতা হারানোর ঝুঁকি তৈরি করবে।

এই শুল্কের প্রভাব ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান। নিউইয়র্ক টাইমস তাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচালিত দুই ডজনেরও বেশি আঞ্চলিক সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছে। এই ধরনের সিদ্ধান্ত স্থানীয় সংবাদ কাঠামোর জন্য বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি করছে। একই সঙ্গে দেশজুড়ে বাড়ছে ‘নিউজ ডেজার্ট’ বা সংবাদ শূন্য অঞ্চল, যেখানে মানুষ স্থানীয় খবর ও তথ্য থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ছোট আকারের এসব সংবাদপত্র শুধু সংবাদ পরিবেশন করে না, বরং তারা স্থানীয় প্রশাসনের জবাবদিহি নিশ্চিত করে, নাগরিক অংশগ্রহণ বাড়ায় এবং কমিউনিটিকে সংযুক্ত রাখে। তাই এদের হারানো মানে গণতন্ত্রের একটি স্তম্ভ ভেঙে পড়া।

অতএব এই পরিস্থিতিকে শুধু একটি অর্থনৈতিক সংকট হিসেবে দেখলে চলবে না, এটি গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার এবং তথ্যের অধিকারকেও হুমকির মুখে ফেলছে। সরকারের উচিত এই শুল্ক পুনর্বিবেচনা করা এবং ছোট ও স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর জন্য সহযোগিতামূলক নীতি গ্রহণ করা না হলে যুক্তরাষ্ট্রের বহু কমিউনিটি তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্রটি চিরতরে হারিয়ে ফেলবে। কলাম্বিয়া বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ব্রেট হাউস বলেন, কোনো পরিস্থিতিতেই এটি মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির জন্য লাভজনক নয়। যেভাবেই সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করা হোক না কেন, কাগজের দাম বাড়বেই। এই মতের সঙ্গে সাংবাদিক মহলও একমত যে, শুল্ক কার্যকর হলে উৎপাদন খরচ এমনভাবে বাড়বে যা ছোট পত্রিকার জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে।

২০০৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ৩ হাজার ২০০টিরও বেশি সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। অনলাইন পাঠকসংখ্যা বৃদ্ধি, বিজ্ঞাপনের আয় কমে যাওয়া এবং উৎপাদন খরচের ঊর্ধ্বগতি এই ধ্বংসের প্রধান কারণ। যারা এখনো টিকে আছে, তারাও চলছে অত্যন্ত সংকটাপন্ন আর্থিক পরিস্থিতিতে। ছোট পত্রিকাগুলোর অস্তিত্ব রক্ষায় এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সরকার, সমাজ এবং ব্যবসায়িক মহলের উচিত এসব পত্রিকার পাশে দাঁড়ানো, কর সুবিধা দেওয়া, এবং নিউজপ্রিন্ট সহজলভ্য করতে নীতিগত সহায়তা প্রদান। না হলে হ্যানকক কাউন্টির মতো ছোট ছোট কমিউনিটির তথ্য ও জবাবদিহির এই মূল্যবান মাধ্যমগুলো একের পর এক হারিয়ে যাবে, যা গণতন্ত্র ও নাগরিক সমাজের জন্য এক ভয়ানক হুমকি।

শেয়ার করুন