বিশ্ব অর্থনীতিতে অন্যতম শক্তিশালী দেশ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের মাত্রা নতুন দিগন্তে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ ইউনূস। সদ্য চীন সফরে দুই দেশের মধ্যে এমন কিছু সমঝোতা ও চুক্তি তারা করেছেন যা দুই দেশকেই এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ এমন চুক্তিতে অনেক সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। যুগ যুগ ধরেই বাংলাদেশের সঙ্গে চীন সখ্যতা গড়তে আগ্রহী। বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী ছাড়াও ভূ-রাজনৈতিকও কারণও এর পেছনে কাজ করছে। বাংলাদেশ অতসত বুঝতে চায় না। প্রায় বিশ কোটির মানুষের দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে যেতে অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ এমন কোনো দেশের সহায়তা ভীষণ প্রয়োজন। চীন সে দৃষ্টিকোন থেকেই পাশে দাঁড়িয়েছে। আর যা হলো প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরে।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলেও চীনের সহায়তা লাভে চেষ্টা করেছেন। কিছু পেয়েছেনও। যা দিয়ে শেখ হাসিনা তার শাসনামলের উন্নয়নের বিভিন্ন চিত্র বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি আরো সহায়তা চেয়েছিলেন। পারিপার্শ্বিক কারণে সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। তার পেছনে কী কারণ সেটা সবারই জানা! বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ওয়ান ইলেভেনের সুফল পেয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন। ওয়ান ইলেভেন কাদের মদদে সংগঠিত হয়েছিল সেটা কারোরই অজানা নয়। এরপরও ২০১৪ ও ২০১৮ এবং ২০২৪ এর নির্বাচন এক তরফা করে শেখ হাসিনা যে দেশের মদদে, সে দেশের সঙ্গে প্রচণ্ড বিরোধ চায়নার। ফলে শেখ হাসিনা চাইলেও চীনের কাছে ঘেষতে শতবার চিন্তা করতে হতো।
২০০৫ সনেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া চীন সফরে গিয়েছিলেন। সে সময়ও খালেদা জিয়ার লক্ষ্য ছিল দেশকে এগিয়ে নেয়ার বাস্তব কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ, যাতে সহায়তা দেবে চীন। কিন্তু খালেদা জিয়া তাঁর চীন সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন। সে সময় আজ্ঞাত কারণে দেশে শুরু হয় প্রচন্ড বোমা হামলা। এ কারণে নির্দিষ্ট সময়ের আগে ওই বছরের ১৯ আগস্ট সন্ধ্যায় বেইজিং ত্যাগ করে ঢাকা ফিরে আসেন। এর আগে খালেদা জিয়া চীন সফরে গিয়েছিলেন ১৭ আগস্ট। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তাঁর চীনে পাঁচ দিন সফর করার কথা ছিল। ওই সফরকালে চীনের প্রেসিডেন্ট হু চিন থাও, চীনের জাতীয় গণ কংগ্রেসের স্ট্যান্ডিং কমিটির চ্যান্সেলর উ পাং কুও, চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন চিয়া পাও, উপ-প্রধানমন্ত্রী হুয়াং চিয়ু আলাদা আলাদাভাবে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু তার আরও কিছু প্রোগ্রাম থাকলেও সেটা করতে সক্ষম হননি। যে সময় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এবং সারা দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৮টি জেলায় ১৭ আগস্ট সকালের দিকে ১০০টিরও বেশী বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তাতে কমপক্ষে ২ জন নিহত এবং ১৩০জন আহত হন। ওই ভয়াবহতার কারণে ফিরে আসেন খালেদা জিয়া কাংখিত সুফল অপ্রাপ্তি রেখেই। শেখ হাসিনারও পতনের ঠিক আগ মুহূর্তে চীন সফরে গেলেও সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন গত জুলাইয়ে।
এবার প্রফেসর ইউনূসের চীন সফরের প্রাক্কালেও নানা ঘটনায় উত্তপ্ত হচ্ছিল দেশ। কিন্তু সেনাবাহিনী সহ আইনশৃংখলাবাহিনী দক্ষতার সঙ্গে সেগুলো মোকাবেলা করেই ড. ইউনূস দেশ ছাড়েন।
প্রধান উপদেষ্টার অর্জন
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরে বিশাল বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ২০২৮ সাল পর্যন্ত কোটা ও শুল্ক সুবিধার প্রতিশ্রুতিও। সফরে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন এবং বাংলাদেশ চীনের ‘এক চীন নীতিতে’ তার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে। একইসঙ্গে ‘এক চীন নীতিতে’ বাংলাদেশ তার অবস্থান আবারো স্পষ্ট করেছে চীনের কাছে। ফলে চীনের পক্ষ থেকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে।
২১০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি
গত জুলাইয়ে শেখ হাসিনা চীনের কাছ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ সহায়তা লাভের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু চীন সম্ভবত শেখ হাসিনার অতিরিক্ত ভারত প্রীতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে সেখানে মাত্র ১৪ কোটি টাকার একটা সহায়তা দেয়ার ঘোষণা করলে শেখ হাসিনা তাতে ব্যাপক ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু এবার এ ক্ষেত্রে উদারতা দেখায় চীন।
প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে সেদেশের সরকার ও চীনা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ২১০ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে দেশটির প্রায় ৩০টি কোম্পানি বাংলাদেশের বিশেষ চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে।
এ ছাড়া, মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণ প্রকল্পে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে চীন। চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা হিসেবে আরো ১৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। অনুদান ও অন্যান্য ঋণ সহায়তা হিসেবে আসবে বাকি অর্থ।
২০২৮ সাল পর্যন্ত চীনে কোটা ও শুল্ক সুবিধা
বাংলাদেশের বিদ্যমান শুল্ক ও কোটামুক্ত রপ্তানি সুবিধা আরো দুই বছর বহাল রাখার ঘোষণা দিয়েছে চীন। এর আগে চীনা বাজারে ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য এই সুবিধা ছিল। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে চীনা উপ-প্রধানমন্ত্রী ডিং জুয়েশিয়াংয়ের এক বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে চীনা উপ-প্রধানমন্ত্রী এ ঘোষণা দেন চীনের বাজারে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা ২০২৮ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে।
চীনে আম রপ্তানির দুয়ার খুলল
চীন বাংলাদেশ থেকে আম নিতে আগ্রহী। বাংলাদেশও চীনে আম পাঠাতে চায়। বাংলাদেশ চীনে আম রপ্তানির জন্য ৬ বছর আগে দেশটির কাছে আবেদন করেছিল। তবে নানা জটিলতায় সেটা আর কার্যকর হয়নি। তবে প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের মধ্যে দিয়ে সেদেশে আম রপ্তানির দুয়ার খুলেছে। আগামী মে-জুন মাস থেকে চীনে আম রপ্তানি শুরু হবে। এর মধ্যে দিয়ে বিদেশে বাংলাদেশি আমের চাহিদা বাড়বে।
তিস্তা প্রকল্পে সহায়তা দেবে চীন
এ মুহূর্তে বাংলাদেশের বড় সমস্যা তিস্তার ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তি। কিন্তু ভারত দীর্ঘ টালবাহানা করে বঞ্চিত করে বাংলাদেশকে। এরপর থেকেই তিস্তায় বিকল্প পানি ধরে রাখার একটা মহা প্রকল্প করে দেয়ার প্লান দেয় চীন। যাতে করে আর তিস্তার ন্যায্য হিস্যা না পেলেও এ বিকল্প দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ উপকৃত হবে। কিন্তু ভারত এখানেও বাগড়া দেয়। এবং এ প্রকল্প তারাই করে দেয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ওসব প্রস্তাবনায় আস্থা রাখেনি প্রফেসর ইউনূস। এবার চীনের কাছে সহায়তার আশা করলে চীন আগ্রহ দেখিয়েছে।
ফলে এবার প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে এই প্রকল্পে সহায়তার আশ্বাস মিলেছে। তবে শুধু তিস্তা প্রকল্প নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকেননি অধ্যাপক ইউনূস। তিনি নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য চীন থেকে ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যানও চেয়েছেন। যা নদীমাতৃক ও নদী নির্ভর বাংলাদেশের কৃষিকাজের উন্নতিতে ব্যপক উপকার হবে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক চীন সফরে সেদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী লি গোইয়িংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেসময় নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। বৈঠকে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা ও ঢাকার চারপাশের দূষিত পানি পরিষ্কারের বিষয়ে সহায়তার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন ড. ইউনূস।
এক চীন নীতিতে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি
বাংলাদেশ সব সময় এক চীন নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। তাইওয়ানকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেও মনে করে বাংলাদেশ। তবে এবার প্রধান উপদেষ্টার সফরে বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে। একই সঙ্গে চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার ব্যাপারে নিজেদের অঙ্গীকারের কথা স্পষ্ট করেছে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের পথচলায় সমর্থনের কথাও বলেছে চীন। তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিরোধিতা নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানের বিষয়ে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেছেন, এই বাক্যটি হয়তো চীনের আগ্রহে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হোক বা না হোক, এটি কোনো পার্থক্য তৈরি করে না।
৯ চুক্তি ও সমঝোতা সই
প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে একটি চুক্তি ও ৮টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং কারিগরি সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই হয়েছে। এ ছাড়া, দুই দেশের চিরায়ত সাহিত্যের অনুবাদ ও প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনিময় ও সহযোগিতা, সংবাদ বিনিময়, গণমাধ্যম, ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য খাতে সই হয়েছে ৮টি সমঝোতা স্মারক।
উল্লেখ্য, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস গত বুধবার (২৬ মার্চ) চার দিনের চীন সফরে যান। প্রধান উপদেষ্টার এটাই প্রথম কোনো দেশে দ্বিপক্ষীয় সফর। সেখানে পিকিং ইউনিভারসিটি প্রফেসর ইউনূসকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিও প্রদান করে।
চার দিনের সফর শেষে ঢাকায় ফিরেছেন প্রধান উপদেষ্টা।