দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে যেভাবে বক্তব্য দিচ্ছে, হেয় করার চেষ্টা করছে এটা মোটেও ভাল চোখে দেখছেন না সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। পরিস্থিতি জটিল করে না তুলতে এবং সবকিছুতে শান্তি শৃংখলা ও সহমর্মিতা দেখানো প্রয়োজন বলে তিনি মনে করছেন।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। না হয় পরে বলবেন যে আমি আপনাদের সতর্ক করিনি। আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসাথে কাজ করতে না পারেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি-কাটাকাটি করেন, দেশ ও জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আমি আজকে বলে দিলাম, সতর্ক করে দিচ্ছি, পরে বলতে পারবেন না যে সতর্ক করিনি।
মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় শহীদ সেনা দিবসে রাওয়া ক্লাবে আয়োজিত ফটো এক্সিবিশনে তিনি এসব কথা বলেন।
সেনাপ্রধান বলেন, আমরা সুখে শান্তিতে থাকতে চাই, সে উদ্দেশে সেনাবাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর প্রতি আক্রমণ করবেন না। আমাদের প্রতি কারো কারো বিদ্বেষের কারণে আজও খুঁজে পাইনি। আমাদের সাহায্য করেন, আক্রমণ নয়। প্রয়োজন হলে আমাদের উপদেশ দেন। ভালো উপদেশ হলে আমরা গ্রহণ করবো। আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই, দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।
তিনি আরও বলেন, নিজেরা ভেদাভেদ না করে এক হয়ে থাকি। যদি কোনো বিভেদ থাকে আলোচনা করে ঠিক করবো। ডানে-বায়ে গিয়ে লাভ হবে না। কেউ অপরাধ করলে বিন্দুমাত্র ছাড় নেই। এটা একটা সুশৃঙ্খল বাহিনী, এটিকে সুশৃঙ্খল থাকতে দিন।
ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, আমার অন্য কোনো আকাঙ্খা নেই। আমার একটাই আকাঙ্খা দেশ ও জাতিকে সুন্দর জায়গায় রেখে আমরা সেনানিবাসে ফেরত আসবো। আই হ্যাড এনাফ, ওয়াজ লাস্ট সেভেন-এইট মান্থ এনাফ।
দেশের আইনশৃঙ্খলা খারাপের পেছনে বেশকিছু কারণ আছে উল্লেখ করে সেনাপ্রধান বলেন, প্রথমত আমরা নিজেরা হানাহানির মধ্যে ব্যস্ত, একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে ব্যস্ত। অপরাধীদের জন্য এটি চমৎকার একটি সুযোগ। আমরা একটা অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে বিরাজ করছি, তারা জানে এই সময়ে অপরাধ করলে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। সে কারণে এসব অপরাধ হচ্ছে। আমরা যদি সংগঠিত থাকি, একত্রিত থাকি, তাহলে এগুলো এগুলো মোকাবেলা করা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই এগুলো দেশের জন্য অতীতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। খারাপ কাজের সাথে অনেকগুলো ভালো কাজ করেছে। দেশকে যে এত বছর স্থিতিশীল রাখা হয়েছে, এটার কারণ হচ্ছে, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও সিভিলিয়ানরা মিলে অর্গানাইজেশনগুলো ইফেক্টিভ রেখেছে। এজন্য আমরা একটা সুন্দর পরিবেশ পেয়েছি। এর মধ্যে কেউ অপরাধ করলে শাস্তি হবে। অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। না হয় এই জিনিস আবার ঘটবে। আমরা এসব চিরতরে বন্ধ রাখতে চাই। কিন্তু তার আগে মনে রাখতে হবে, এমনভাবে কাজটা করবো, যাতে এসব অর্গানাইজেশন আন্ডারমাইন্ড না হয়। আপনারা যদি মনে করেন, এসব অর্গানাইজেশনকে আন্ডারমাইন্ড করে শান্তিতে থাকবেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক বিরাজ করবে, এটি সম্ভব না।
ওয়াকার-উজ-জামার বলেছেন, আমরা নির্বাচনের দিকেই ধাবিত হচ্ছি, তার আগে যেসব সংস্কার প্রয়োজন, সরকার সেগুলো করবে। আমি যতবার ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেছেন এবং সেটা ডিসেম্বরের মধ্যেই। আমি প্রথমেই ১৮ মাসের কথা বলেছিলাম। মনে হয় সরকার সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। ড. ইউনূস যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে। আমরা উনাকে সহযোগিতা করবো। আমাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনায় বিরোধ, মতবিরোধ থাকতে পারে কিন্তু দিনশেষে দেশ ও জাতির কথা চিন্তা করে সবাই এক থাকতে পারি।
সেনাপ্রধান মূলত যেসব বার্তা দিয়েছেন-
এক. ঐক্য ও সংহতির পক্ষে কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেছেন সেনাপ্রধান। উচ্চারণ করেছেন চূড়ান্ত সতর্কবার্তা। বলেছেন, ‘‘আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। পরে বলবেন আমি সতর্ক করিনি। আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ না করতে পারেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি কাটাকাটি করেন, তাহলে এই দেশ ও জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।’’
দুই. নির্বাচন নিয়েও কথা বলেছেন সেনাপ্রধান। জানিয়েছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে কিংবা ক্লোজ টু দ্যাট টাইমের মধ্যে ফ্রি, ফেয়ার এবং ইনক্লুসিভ নির্বাচনের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার সঙ্গে একমত হয়েছেন।
তিন. পিলখানা হত্যাকান্ড নিয়েও নিজের অবস্থান জানিয়েছেন সেনাপ্রধান। বলেছেন, একটা জিনিস আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে। এই বর্বরতা কোনো সেনাসদস্য করেনি। সম্পূর্ণটা তদানীন্তন বিজিবি (তখন নাম ছিল বিডিআর) দ্বারা সংঘটিত। ফুলস্টপ। এখানে কোনো ‘ইফ’ ও ‘বাট’ নেই। পরে এটাও যোগ করেছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কিংবা বাইরের কোনো শক্তি ইনভলভ ছিল কিনা সেটার তদন্তের জন্য কমিশন করা হয়েছে।
চার. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও বার্তা দিয়েছেন সেনাপ্রধান। আইনশৃঙ্খলা খারাপ হওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে হানাহানি ও বিষোদ্গারকে প্রথম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। এ ছাড়াও বলেন, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই অতীতে দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। খারাপ কাজের সঙ্গে অসংখ্য ভালো কাজ করেছে। দেশ যে এত বছর স্থিতিশীল ছিল এটার কারণ হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও সিভিলিয়ান সবাই মিলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইফেক্টিভ রেখেছি। সে জন্য এতদিন ধরে আমরা একটা সুন্দর পরিবেশ পেয়েছি। এর মধ্যে যারা কাজ করেছে যদি অপরাধ করে থাকে সেটার শাস্তি হবে। অবশ্যই শাস্তি হতে হবে। নাহলে এ জিনিস আবার ঘটবে। আমরা সেটাকে বন্ধ করতে চাই চিরতরে। কিন্তু তার আগে মনে রাখতে হবে, আমরা এমনভাবে কাজ করবো এসব সংস্থা যেন আন্ডারমাইন না হয়।
শেষ কথা: ইতিহাসে কখনো কখনো এমন হয়। একটি জাতির ক্রান্তিলগ্নে সেনাবাহিনী কিংবা সেনাপ্রধানকে সুনির্দিষ্ট কাজের বাইরে জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয়। ভূমিকা রাখতে হয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনেও। সে ভূমিকাই আরও স্পষ্ট হলো সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্যে। বাংলাদেশের ইতিহাস নিশ্চিতভাবেই তাকে স্মরণ রাখবে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধান বলেন, এ বর্বতায় সেনাসদস্যরা দায়ী নন। তৎকালীন বিজিবি সদস্যরা এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী। বিচারিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করবেন না। যারা শাস্তি পেয়েছে, তারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। রাজনীতিবিদ ও বাইরের কেউ যুক্ত ছিল কি না তার জন্য কমিশন করা হয়েছে, কমিশন তদন্ত করে জানাবে।
সেনাপ্রধান বলেন, আজকে একটু মন খুলে কথা বললাম। এতদিন যে কথা মনের মধ্যে ছিল। সব সময় প্রকাশ করতে পারি না। প্রকাশ করাও যায় না। আজকে প্রকাশ করে ফেললাম। সবার সামনে আমি আমার মনের কথাটা প্রকাশ করে ফেললাম। কাউকে যদি দুঃখ দিয়ে থাকি, আমাকে ক্ষমা করবেন। আসেন আমরা একসঙ্গে কাজ করি। দেশ এবং জাতিকে একটা সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাই। এখানেই আমাদের ছেলেমেয়েরা বাস করবে। তাদের জন্য এমন কোনো স্থান আমরা রেখে না যাই, যেখানে হানাহানি, কাটাকাটি মারামারি হবে।