৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:২৩:০৩ পূর্বাহ্ন


ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারি পরীক্ষায় হয়রানি বন্ধের আহবান
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৫-০২-২০২৫
ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারি পরীক্ষায় হয়রানি বন্ধের আহবান


পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট ডা. রাহাত আরা নূর বলেন, ধর্ষণের ঘটনার কেসস্টাডি তুলে ধরে বলেন নারী ও কন্যার শারীরিক পরীক্ষা করার সময় গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে, শিকার নারীর নিরাপত্তা, মর্যাদা রক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে ডাক্তারি পরীক্ষার ক্ষেত্রে হয়রানি বন্ধ করতে হবে। মেডিকো লিগ্যাল যে এসওপি করা হচ্ছে সেখানে টু-ফিঙ্গার টেস্ট নিষিদ্ধের জোর দাবি থাকতে হবে মেডিকো কারিকুলামে বিষয়টি যুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সম্প্রতি আনোয়ারা বেগম মুনিরা খান মিলনায়তনে টু-ফিঙ্গার টেস্ট করার ক্ষেত্রে হাইকোর্টের দেয়া নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন পর্যালোচনা বিষয়ক মত বিনিময় সভায় বক্তারা এদাবি জানান। 

সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ-সভাপতি ডা. রওশন আরা বেগম, আইসিডিডিআরবি এর ইমেরিটাস সায়েনটিস্ট রুচিরা তাবাসসুম ও সিনিয়র রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর (জেন্ডার ইকুয়ালিটি স্পেশালিস্ট) নাহিদা আক্তার; পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট ডা. রাহাত আরা নূর। 

ধারণাপত্রে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে দীর্ঘদিন ধরে নারীর প্রতি অবমাননাকর দ্বি-আঙ্গুলী পরীক্ষা বা টু ফিঙ্গার টেস্ট বাতিল করে বিজ্ঞানসম্মত, আধুনিক পরীক্ষা পদ্ধতির দাবি জানানোর প্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ ‘দ্বি-আঙ্গুলের পরীক্ষা’ বা ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ অবৈজ্ঞানিক, অনির্ভরযোগ্য এবং অবৈধ ঘোষণা করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। দেশের বিভিন্ন স্থানে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ, মেডিকো-লিগ্যাল পরীক্ষার সাথে যারা কাজ করেন তাদের অনেকেই হাইকোর্ট বিভাগের ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করে দেওয়া রায়টি সম্পর্কে অবগত নন। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগও সীমিত আকারের। ইতিমধ্যে ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করে হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া রায়ের প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করে সকল মেডিকেল কলেজ, হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে পাঠানো হলেও পরবর্তীতে এ বিষয়ে তেমন কোন মনিটরিং করা হয়নি। এমতাবস্থায় ধর্ষণের শিকার নারীর মেডিকো-লিগ্যাল পরীক্ষার ক্ষেত্রে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করে দেওয়া রায়টি বাস্তবায়নে সচেতনতা তৈরিতে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালানোর জোর দাবি জানানোর পাশাপাশি মোট ১৪ টি সুপারিশ উপস্থাপন করেন। 

সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আশির দশক থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করে সমতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। সংগঠনের অ্যাডভোকেসি কর্মসূচি ও নারী আন্দোলনের দাবির প্রেক্ষিতে নারীবান্ধব বিভিন্ন আইন প্রণয়ন হলেও আইন বাস্তবায়নে নানা প্রতিবন্ধকতা লক্ষ্য করা যায়। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করে জেন্ডার জাস্টিস কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে তা এখন পর্যালোচনার বিষয়। ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারী (মেডিকো-লিগ্যাল) পরীক্ষার ক্ষেত্রে ‘দ্বি-আঙ্গুলের পরীক্ষা’ বা ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করা নারী আন্দোলনের একটি অন্যতম অর্জন। এই রায় বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ধর্ষণের শিকার নারী ও কন্যা শিশুর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। হাইকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করা এখনও ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ পরীক্ষা চলমান, যা নারীর জন্য অবমাননাকর বলে মনে করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

আলোচনায় ডা. রওশন আরা বেগম বলেন ধর্ষণের শিকার নারী টু-ফিঙ্গার টেস্ট বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের পরও অনেক ডাক্তার এখনো সচেতন নয়। এটি বাস্তবায়নে ও সচেতনতা তৈরিতে ডাক্তারদের ঐক্যবদ্ধভাবে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কাজ করতে হবে।

আইসিডিডিআরবি এর ইমেরিটাস সায়েনটিস্ট রুচিরা তাবাসসুম বলেন, টু-ফিঙ্গার টেস্ট নিয়ে ডাক্তার দের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি আছে। এই টেস্টের মাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণিত হয় কিনা তা পরিষ্কার নয়, এই ধারণাটাই অবৈজ্ঞানিক। ধর্ষণের সংজ্ঞা নিয়ে পর্যালোচনা করতে হবে।

আইসি ডিডিআরবি এর সিনিয়র রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর জেন্ডার (জেন্ডার ইকুয়ালিটি স্পেশালিস্ট) নাহিদা আক্তার বলেন, টু-ফিঙ্গার টেস্ট এর উপর দেয়া নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন মূল্যায়ণের লক্ষ্যে পরিচালিত গবেষণাটি ঢাকা, দিনাজপুর ও রংপুরে জেলায় হেলথ, লিগ্যাল সহায়তা দানকারী এনজিও গুলোর উপর করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকার বাইরে ডাক্তার, আইনী সেবাদানকারী সংস্থার প্রতিনিধি, পুলিশ টু-ফিঙ্গার টেস্ট এর নিষিদ্ধ বিষয়ে তেমন সচেতন নয়, পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারণে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও তেমন কার্যকর নয়। এবিষয়ে সরকারের উদ্যোগে দেয়া প্রশিক্ষণ তেমন কার্যকর হয়নি। টু-ফিঙ্গার টেস্ট এর কারণে সহিংসতার শিকার নারীর বিচার পাওয়ায় যেমন বাধা তৈরি হয় তেমনি তারা শারীরিক ক্ষতির ও সম্মুখীন হন। 

পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট ডা. রাহাত আরা নূর বলেন, ধর্ষণের ঘটনার কেসস্টাডি তুলে ধরে বলেন নারী ও কন্যার শারীরিক পরীক্ষা করার সময় গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে, শিকার নারীর নিরাপত্তা, মর্যাদা রক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। ডাক্তারি পরীক্ষার ক্ষেত্রে হয়রানি বন্ধ করতে হবে। মেডিকো লিগ্যাল যে এস ওপি করা হচ্ছে সেখানে টু-ফিঙ্গার টেস্ট নিষিদ্ধের জোর দাবি থাকতে হবে। মেডিকো কারিকুলামে বিষয়টি যুক্ত করতে হবে।

মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ঢাকা মেডিকেলের এ্যসিসট্যান্ট প্রফেসর (ফরেনসিক মেডিসিন) ডা. দেবিকা রায়, ডা. স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক (ফরেনসিক মেডিসিন) আসমাউল হুসনা, বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের কোঅর্ডিনেটর মাহরুবা খানম, জেড এইচ শিকদার ওমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হসপিটালের প্রফেসর এস কে জিন্নাত আরা নাসরিন, ডা. রাহাত আরা নূর, শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুন নাহার, ডা. সায়রা বানু, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি এন্ড লবি শাখার ডিরেক্টর অ্যাড. দীপ্তি শিকদার ও ডেপুটি ডিরেক্টর (লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি এন্ড লবি) অ্যাড. রামলাল রাহা এবং অ্যাসিসট্যঅন্ট ডিরেক্টর অ্যাড. ফাতেমা খাতুন।

সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বিচারের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে তবে সহিংসতা বাড়ছে। এই সহিংসতা প্রতিরোধে এখনকার সময়ে তৈরি হওয়া চাহিদার দিকে খেয়াল করতে হবে। মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের টু-ফিঙ্গার টেস্ট নিষিদ্ধ করে দেয়া রায় বাস্তবায়নে সরকারি , বেসরকারি সংস্থা, স্বাস্থ্যসেবাদানকারী সংস্থা এবং আইনী সংস্থাকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। সেবাদানকারী সংস্থাকে আরো সচেতন হতে হবে, একইসাথে মানবিক হওয়ার পাশাপাশি পেশাগত দায়বদ্ধতা নিশ্চিতে সদিচ্ছা থাকতে হবে।

মতবিনিময় সভায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর (ডিপার্টমেন্ট অব অবস এন্ড গাইনী) ডা. মিতা জোয়ার্দার ও মিটফোর্ড হাসপাতালের গাইনী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহনাজ আহমেদ, ক্যাপিটাল জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা এর কনসালটেন্ট (গাইনী) ডা. হামিদা এমসহ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কমিটির নেতৃবৃন্দ, সম্পাদকমন্ডলী, সদস্য, কর্মকর্তা, আইনজীবী, এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিসহ প্রায় ৫০ জন উপস্থিত ছিলেন। সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের স্বাস্থ্য উপপরিষদ সম্পাদক ডা: দীপা ইসলাম।

শেয়ার করুন