৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:০৩:১৬ পূর্বাহ্ন


জনমনে সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৫-০২-২০২৫
জনমনে সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে


বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানের আলোকে সর্বোচ্চ বিচার বিভাগের রুলিংয়ের ভিত্তিতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের মূল দায়িত্ব হলো একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর। আর এ নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য নির্বাচন পদ্ধতি, নির্বাচন কমিশন, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এবং প্রশাসন ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার। এ কাজগুলো করার জন্য সর্বাগ্রে অত্যাবশ্যক অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দলীয় নিরপেক্ষ, নির্মোহ অবস্থান নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তব অবস্থার বিবেচনায় সরকারের কিছু উপদেষ্টা, সরকার ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তির নানা কথা, আচরণে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যে জনমনে সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থান বিষরে সন্দেহ দানা বাঁধছে। 

নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার অধীর আগ্রহে থাকা কোনো কোনো রাজনৈতিক দল দাবি তুলছে নির্বাচনকালে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবর্তে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের। যদিও কথাটি প্রাথমিক পর্যায়ে কিন্তু সরকারের ছাত্রপ্রতিনিধি এবং বিরোধীদলের প্রতিদিনের বাহাস চলতে থাকলে বিষয়টি বিতর্ক থেকে সংকটে রূপ নিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এমনিতেই সমাজ জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই নানা সমস্যা সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় কার্যপরিকল্পনায় স্বল্প অভিজ্ঞতার কারণে সরকার প্রশাসন এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসমূহকে পুরোপুরি কার্যকর করতে পারেনি। বিভিন্ন স্তরের নানা কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা নিত্য-নতুন দাবি-দাওয়া নিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করছে, সড়কে-মহাসড়কে সংঘাত নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। অথচ সরকারের কারো কারো এবং সরকার ঘনিষ্ঠ বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসংগঠনের কয়েকজন নেতার অতিকথনের কারণে নতুন করে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে। 

শোনা যাচ্ছে, নতুন একটি বা দুটি রাজনৈতিক দল গঠিত হতে চলেছে। গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কমিশনের নিয়মনীতি মেনে রাজনৈতিক দল গঠিত হতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত নিয়ে গোড়া কিংস পার্টি গঠন বিষয়ে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ জনগণের কিন্তু কিংস পার্টি গঠনের দুঃসহ স্মৃতি আছে। ১/১১ সরকারের সময়েও এ ধরনের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধজয়ী বাংলাদেশের পোড় খাওয়া মানুষ ২০২৪ জীবন দিয়ে কিন্তু ভোটের অধিকার চায়। যদিও পলিমাটির বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতি জেলি মাছের মতো। তবুও তরুণ প্রজন্ম প্রভাবিত বাংলাদেশিরা চায়না ফ্যাসিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় ফিরে যেতে। সত্যি বলতে কি ঘুষ, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারমুক্ত, বৈষম্যবিরোধী সমাজের স্বপ্ন নিয়ে আত্মাহুতি দেওয়া সাধারণ মানুষের উত্তরসূরিরা গত ৬ মাসে কিন্তু কোনো পরিবর্তন বা সংস্কারের সুফল পায়নি। 

প্রতিদিন দেখছি সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব, দু-একজন উপদেষ্টা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে নেতারা এমন কিছু আগ্রাসী মন্তব্য করছেন, যা সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করছে। সুযোগ হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টা মন্তব্য করে জল ঘোলা করার। ১৯৭২-২০২৪ সময়ে দেশের মানুষ কিন্তু আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত সবাইকে দেখেছে। ১৯৭১ মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগ, জামায়াতের ভূমিকা সবার জানা আছে। আর বিএনপি, জাতীয় পার্টির জন্ম এবং বিকাশ, উত্থানপতন সবার জানা আছে। যদি দেশ সঠিক পথে চলতো, তাহলে ছাত্র-জনতাকে রাজপথে জীবন বিসর্জন দিতে হতো না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় কিছু মানুষের দুরভিসন্ধির কারণে দেশে অনেক কিছুই এখন এলোমেলো হয়ে গেছে। সন্দেহ জেগেছে জুলাই-আগস্ট ২০২৪ হত্যাকা- ধ্বংসযজ্ঞের নিরপেক্ষ বিচার নিয়ে। আরো সন্দেহ দুর্নীতিবাজ, লুটেরাদের আদৌ বিচার হবে কি না? তালগোল পাকানো অবস্থায় নির্বাচন হলে হয়তো একটি সরকার গঠিত হবে। কিন্তু সে সরকার আবারও স্বৈরাচারী বা স্বেচ্ছাচারী হবে না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছে না জনগণ। 

আশা করি, বর্তমান সরকারে থাকা কোনো উপদেষ্টা যদি রাজনীতিতে যুক্ত হতে চায় অবিলম্বে পদত্যাগ করে সরকারকে নিরপেক্ষ হওয়ার সুযোগ দেবেন। একই সঙ্গে ছাত্র-জনতা নিজেদের অবস্থানে থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করে নিজেদের ভিশন এবং এজেন্ডা নিয়ে জনগণের কাছে যাবে। সরকার সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমতল খেলার মাঠ তৈরি করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রয়োজন নিজেদের সংস্কার। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদেরও গণতান্ত্রিক হওয়ার প্রয়োজন আছে। সরকার কিন্তু একটি বিশাল রাজনৈতিক মহলকে আলোচনার বাইরে রেখে সংলাপের পথে হাঁটছে। বিএনপি এবং জামায়াত ছাড়া অধিকাংশ দল, যাদের সঙ্গে সংলাপ করছে সরকার তারা কিন্তু অধিকাংশ সাইনবোর্ডনির্ভর প্রান্তিক দল। তৃণমূলে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। আর অনেকটা এ কারণেই নানা দিক থেকে সরকারকে চাপে ফেলা হচ্ছে। কিছু মানুষকে কিছু সময় হয়তো ছেলে ভোলানো গালগল্প বলে বিভ্রান্ত করা যায়, কিন্তু সবাইকে পারা যায় না। 

মনে রাখতে হবে সামরিক বাহিনীও কিন্তু একটি রাষ্ট্রীয় শক্তি। বৈষম্য বিরাজিত সমাজে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সিভিল সোসাইটির বিশাল বৈষম্য আছে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে বিগত সরকার ভালো করেছে না খারাপ করেছে সেটিরও কিন্তু মূল্যায়ন প্রয়োজন। দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীও কিন্তু নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে সহায়তা করছে। 

সংকটগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগে দেশপ্রেমিক সব শক্তি একতাবদ্ধ হয়ে সরকারকে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে সহায়তা করা জরুরি। জনগণের অবাধ ভোট নিশ্চিত হলেই সরকারের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হবে। অন্তর্বর্তী সরকার নিজেদের নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে হলে উপদেষ্টাদের নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে অবস্থান সুস্পট করছেন বারবার। কিন্তু কেউ কেউ বিতর্ক সৃষ্টি করছে। 

শেয়ার করুন