ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে রাষ্ট্র পরিচালনায় আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রায় পাঁচ মাস সময় অতিবাহিত করছে। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সময়টা খুব বেশি না হলেও একেবারে কম বলা যাবে না। ইতিমধ্যে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সাফল্য ব্যর্থতার মূল্যায়ন শুরু হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের ফসল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন আছে। তারপরও সমাজের সব স্তর থেকে বৈষম্য দূর করে শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টিতে আদৌ সফল হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। ব্যক্তিস্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতা কতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটি তর্কসাপেক্ষ। জনগণ চায় শান্তিতে ঘুমাতে, নিজেদের বৈধ আয়ে খেয়ে পড়ে বাঁচতে। বর্তমান সরকার কি পেরেছে কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিশ্চিত করতে? পেরেছে কি ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যমূল্য ক্রেতার সামর্থ্যরে আওতায় রাখতে? কেন মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলা যাচ্ছে না? কেন চাঁদাবাজদের উচ্ছেদ সম্ভব হচ্ছে না? সীমিত আয়ের মানুষদের সংসার চালাতে এখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা অবস্থা এখনো সুবিধাজনক না। পুলিশ প্রশাসন এখনো নড়বড়ে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নিধন যজ্ঞের আড়ালে কিন্তু চাঁদাবাজি চলছে। এগুলো কিন্তু সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়া সরকারের কার্যক্রমের দক্ষতার প্রতিচ্ছবি না।
সরকার সব পর্যায়ে সংস্কারের জন্য কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। ইতিমধ্যে অর্থনীতি বিষয়ক হোয়াইট পেপার কমিশন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেখানে বিগত সময় বিপুল লুটপাট, অর্থপাচার, দুর্নীতির ভয়াবহ পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু সীমিত সময় এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য পরিসংখ্যান না থাকায় প্রতিবেদন অনেকটাই অনুমাননির্ভর বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছে। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হলে আরো বিস্তারিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে হবে।
সরকারের সাফল্য মোটামুটি গ্রহণযোগ্য নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন। আশা করি নতুন নির্বাচন কমিশন নির্মোহভাবে নিরপেক্ষ ভূমিকা বজায় রেখে সম্ভাব্য সল্পতম সময়ে জাতীয় নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন দ্রুততার সঙ্গে স্বচ্ছভাবে অন্তত কিছু শীর্ষ দুর্নীবাজ রাজনীতিবিদ, আমলা, সিন্ডিকেট হোতাদের বিচারের আওতায় আনতে পারলে জন মনে স্বস্তি আসবে।
ইতিমধ্যে উচ্চ আদালতে কেয়ার টেকার সরকার বিষয়ক সাংবিধানিক সংশোধন বাতিল করা হয়েছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সকল জাতীয় নির্বাচন কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে হওয়া সমীচীন। তবে এই সরকারের গঠন পদ্ধতি সকল অংশীজনের সঙ্গে আলাপ করে সুনির্দিষ্ট করতে হবে। ভবিষ্যতে যেন কোনো সরকার নিজেদের স্বার্থে এই ব্যবস্থাকে কলুষিত করতে না পারে।
দেখলাম, আদালত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কিছু অংশ সংগত কারণেই নির্বাচিত সংসদে বিবেচনার জন্য রেখে দিয়েছে। ৭ মার্চ, জাতির পিতা এগুলো ঐতিহাসিক বাস্তবতা। এগুলো বিষয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। বর্তমান অবস্থায় এগুলো নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করলে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হবে।
অনেকটা বাধ্য হয়েই সরকার বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস এবং বিজয় দিবস যথাযথ মর্যাদায় পালন করেছে। তবে বিজয় দিবসে প্রধান উপদেষ্টা সৌজন্যের খাতিরেও স্বাধীনতার প্রধান নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নাম উচ্চারণ করা সংগত ছিল। বিজয় দিবসে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর এবং টুঙ্গিপাড়া মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদনে বাধা সৃষ্টি সুবিবেচনা প্রসূত হয়নি।
ডিসেম্বর মাস শেষ হতে চলেছে। ২০২৫ নতুন বর্ষ আসছে। সরকার প্রধান ঘোষণা দিয়েছেন ২০২৫ শেষ অথবা ২০২৬ জুন মাস নাগাদ জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। সংগত কারণেই ক্ষমতা প্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলো চাইছে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আশা। পারবে কি বর্তমান সরকার জুলাই-আগস্ট ২০২৪ এবং তৎপরবর্তী গণহত্যা, লুটপাট ইত্যাদির বিচারকাজ সম্পাদন করতে? পারবে কি আওয়ামী লীগ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে? পারবে কি ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতিকে একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে? সংগত কারণেই সংস্কারের প্রসঙ্গ আসছে। অন্তত কিছু ক্ষেত্রে অপরিহার্য সংস্কার না হলে জন আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে না। সেগুলো করতে হলে কয়েকজন উপদেষ্টা এবং সরকার ঘনিষ্ঠ মহলের কয়েকজনের অতিকথন বন্ধ করতে হবে। অতিকথনের ফলে সমাজে বৈষম্য নতুন করতে সৃষ্টি হচ্ছে।
সরকার কিন্তু মার্চ এপ্রিল নাগাদ তীব্র জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকটে পড়বে। নিজেদের জ্বালানি গ্যাস অপ্রতুলতা, অর্থ সংকটে প্রাথমিক জ্বালানি আমদানিতে সংকট, বিপুল বকেয়া পরিশোধের দায়। জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকটে অনেক শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। বিপুল পরিমাণ মানুষ চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ছে। এসব মৌলিক সমস্যাগুলো সামাল দেওয়া কিন্তু অরাজনৈতিক অনির্বাচিত সরকারের জন্য কঠিন। মানুষ যদি শান্তিতে খেতে পরতে, ঘুমাতে না পারে তাহলে কিন্তু সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়ে যেতে পারে।
আশা করি, বিচক্ষণ সরকারপ্রধান চ্যালেঞ্জগুলো বুঝতে পারছেন। এখনো অধিকাংশ মানুষের আস্থা আছে সরকারপ্রধান সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান করার প্রতিশ্রুতি পূরণ করবেন। বিদ্যমান অবস্থায় কোনো বিকল্প নেই। ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলোকেও উচিত পারস্পরিক বিদ্বেষ না ছড়িয়ে নিজেদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া এবং সরকারকে কিছু অত্যাবশক সংস্কার করার বিষয়ে সহযোগিতা করা।
সরকারের সমালোচনা করা সহজ কিন্তু অপশাসন, দুর্নীতির মাধ্যমে যে জঞ্জাল পুঞ্জীভূত হয়ে আছে সেগুলো একটি অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে সমাধান করা এতো সহজ কাজ না। বর্তমান অবস্থার জন্য ১৯৭২ -২০২৪ ক্ষমতায় থাকা সকল সরকার কম বেশি দায়ী। কেউ ধোয়া তুলসী পাতা ছিল না। জনগণ সবাইকে চেনে। কোনো সরকার জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি। লংকায় গিয়ে সবাই রাবন হয়ে গেছে। পরিশেষে বলবো, সাধারণ মানুষ কিন্তু ভালো নেই।