মুক্ত-স্বাধীন সময়ে (?) জাতির সূর্যসন্তান শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করতে এসে কেন সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করা গেল না, কারা ছিল এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা? কেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারলেন না, কারা ছিল স্বাধীনতাবিরোধী চক্র? কাদের চক্রান্তে স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের পূর্বক্ষণে জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালানো হয়? স্বাধীন জাতি হিসেবে বাংলাদেশের মূল ব্যর্থতা চিহ্নিত শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা, মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্বকে কুক্ষিগত করতে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে বঙ্গবন্ধু, চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের একে একে হত্যা করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করা। ইতিহাসের বাঁকবদলের পথ ধরে এসেছে ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, প্রেসিডেন্ট জিয়া, খালেদ মোশারফ, মনজুরসহ সেক্টর কমান্ডারদের হত্যাকাণ্ড। কে জানে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ড- এমনকি জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ড একই স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ষড়যন্ত্রের ধারবাহিকতা কি না?
বর্তমান সময়ের এক মুখপাত্রের মুখে ১৮ ডিসেম্বর হত্যাকাণ্ড আর জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সামঞ্জস্য পেয়েছেন। নৃশংসতা বিবেচনায় নিলে অবশ্যই তুলনীয়। যদি সুদূর ভবিষ্যতে প্রমাণিত হয় পেছনের শক্তি এক তাহলেও বিস্মিত হবো না। প্রশ্ন করছি, এই কারণে কেন এই সময়ে স্বাধীনতার মূল স্লোগান ‘জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগান হিসেবে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা? বিশ্ববাসী জানে, জয় বাংলা স্লোগান ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। কোনো একটি বিশেষ দল বা ব্যক্তি-গোষ্ঠী স্লোগানটির অপব্যবহার করে থাকতে পারে, কিন্তু তার ফলে মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান নিষিদ্ধ করার সুযোগ দিয়ে শহিদ বুদ্ধিজীবী বা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি মৌখিক সম্মান প্রদর্শন ভণ্ডামির পর্যায়ে বিবেচনার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
দেখলাম, দেশের একটি প্রধান বিরোধীদলের মুখপাত্র সাহস করে উচ্চারণ করলেন না কারা, কোন বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্রে ১৪ আগস্ট হত্যাকাণ্ড হয়েছিল? মুক্ত-স্বাধীন সময়ে কেন জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের দুঃসাহস দেখানো হয়? কেন স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মারক ধ্বংস করা হয়েছে? কেন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতাকে অপমান করছে ক্রমাগত কিছু নবীন বিপ্লবী? ‘রক্ত দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দয়ার দান নয়’-তাহলে কেন এই বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে আপস করে থাকতে হবে? কেন তাদের মুখোশ উন্মোচন করা যাবে না?
বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা নির্ধারণ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক মূল্যায়নের জন্য জরুরি
১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস স্মরণ সময়ে প্রশ্ন জেগেছে কেন, কারা, কাদের ইন্ধনে স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের পূর্ব মুহূর্তে বাংলাদেশের মেধাবী বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল? স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও প্রকৃত হত্যাকারী এবং নেপথ্যের নায়কদের কেন বিচারের আওতায় আনা হলো না? একই প্রশ্ন করা চলে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা নিয়েও। ৫৩ বছর পরও কেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা নিয়ে বিতর্ক-বিভাজন। ১৯৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সাড়ে ৭ কোটি বাংলাদেশির সামান্যতম একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা করেছে। কোনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাই খেতাব বা স্বীকৃতির জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেননি। স্বাধীন-মুক্ত বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার, বড় অর্জন। কিন্তু দেখেন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ রমনায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের পর থেকেই প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ পর্যায়ক্রমে হারিয়ে গেছে। পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের ছদ্মবেশে লুটেরা বাহিনী খুন-খারাবি, লুটতরাজ করে মুক্তিযোদ্ধাদের ভিলেনে পরিণত করেছে। বেপথু তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ছায়াছবি হয়েছেÑ‘আবার তোরা মানুষ হ’ নামে। অসংখ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়ে সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। অথচ অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা অভাব-অনটনে দুঃসহ জীবনযাপন করে মৃত্যুবরণ করেছে। অনেককে মেরে ফেলা হয়েছে। ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে নিজেরা আত্মহনন করেছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক সেক্টর কমান্ডার। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ৫৩ বছর কোনো সরকার ১৯৭১-এর গণহত্যা বা বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ডদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা করেনি, বরং এগুলো থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চেষ্টা করছে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করা যেতেই পারে, জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের কুশীলবরা হয়তো একইভাবে বিচারের বাইরে রয়ে যাবে। বাংলাদেশে কিন্তু গুণীজন বা বুদ্ধিজীবী, যাদের বলি তাদের টার্গেট কিলিং, কিন্তু ৫৩ বছরেও বিভিন্ন সময় হয়েছে। কিছু কিছু হত্যাকাণ্ড নিয়ে কিছু দিন লোক দেখানো তোড়জোড় হয়েছে। একসময় সব চাপা পড়ে গাছে।
বর্তমান প্রজন্ম ১৪ ডিসেম্বরের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর বিষয়ে খুব একটা জানে না। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী এবং ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ দেশবরেণ্য যে বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, কেন তাদের বিষয়ে গবেষণা হলো না? পরবর্তী সময়ে যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী দাবি করেছেন বা এখনো করছেন, তাদের কি দায়িত্ব ছিল না নতুন প্রজন্মের কাছে জাতির সূর্যসন্তানদের পরিচিত করে দেওয়া? বরং একশ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, দুর্নীতিপরায়ণ শাসকগোষ্ঠীকে তোষামোদ করে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। নতুন প্রজন্মের কাছে অনুরোধ উদ্যোগ নিয়ে আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ, একাত্তরের গণহত্যা বিষয়ে গবেষণা করে সঠিক ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরুন। দেশপ্রেমিক প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের বিষয়ে তাদের অবদান বিষয়ে জানতে পারলে তোষামোদকারী তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের স্বরূপ আপনা থেকেই উন্মোচিত হবে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ, ধান্ধাবাজ আমলা ছাড়াও একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী বিশেষভাবে দায়ী।