১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের নির্বাচনে ইলিশ মাছ নিয়ে একটি ভোটের ছড়া খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তাহলো-‘ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা/বোয়াল মাছের দাড়ি/ইয়াহিয়া খান ভিক্ষা করে/শেখ মুজিবের বাড়ি।’
শুধু রাজনীতিতে নয়, বাংলার সাহিত্যসাগরেও ইলিশের অবাধ বিচরণ। মাছের মধ্যে ইলিশ নিয়ে একটু বেশিই পক্ষপাতদুষ্ট যেন বাংলার কবি-সাহিত্যিকরা। বিদগ্ধজনের মতে, নাটক বিনে যেমন ইংরেজি সাহিত্য অন্ধ, তেমনি ইলিশ বিনে বাংলা সাহিত্যও।
পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে মানিক বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন-‘নৌকার খোল ভরিয়া জমতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে। নিষ্পলক চোখগুলোকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতো দেখায়।’ বাঙালির ইলিশপ্রীতি নিয়ে লেখাজোখার অভাব নেই। ৯০ দশক থেকে পহেলা বৈশাখে বিভিন্ন সংগঠন দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে মাটির পাত্রে পান্তাভাতের সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার প্রচলন করে।
বুদ্ধদেব বসু কবিতা লিখেছেন, ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ ইলিশ মাছ নিয়ে। বাংলা সাহিত্যে ইলিশের ছড়াছড়ি। সৈয়দ মুজতবা আলি বর্ণিত সে গল্পটি নিশ্চয়ই অনেকেই জানেন। এটি বিখ্যাত সম্রাট মুহম্মদ বিন তুঘলক সম্পর্কে। ইতিহাসে যাকে পাগলা রাজাও বলা হয়। সেই তুঘলক গেছেন গুজরাটে বিদ্রোহীদের দমন করার উদ্দেশ্য নিয়ে। এমনকি জলাভূমিতে নৌকায় চেপে তাদের তাড়া করতেও সম্রাটের খুব উৎসাহ। তারই মধ্যে এক বিকালে হঠাৎ একটা মাছ লাফিয়ে উঠে পড়লো নৌকার ওপর। ঝকঝকে সাদা রং, তার গড়নটিও চমৎকার। মাছটি দেখে সম্রাট খুবই কৌতূহলী হয়ে পড়লেন। এটা কী মাছ, কেউ জানে না। তুঘলক বললেন, এটাকে এক্ষুনি কেটেকুটে রান্না করে দাও। আমি খেয়ে দেখবো। তা শুনে তার মন্ত্রী ও পারিষদ আঁতকে উঠলেন। তারা সম্রাটকে অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, এই মাছ বিষাক্ত কি না তা তার জানা নেই, তাছাড়া এখন রোজার মাস চলছে, সুতরাং এখন এই মাছ সম্রাটের মুখে ছোঁয়ানোই উচিত নয়। জেদি সম্রাট কারো উপদেশ গ্রাহ্য করলেন না। তার আদেশে তিনি সেই মাছ রান্না করালেন এবং খেলেন। খুব সম্ভবত অনেকটাই খেয়ে ফেললেন। তারপর তার পেট ছেড়ে দিলো এবং সে কারণেই কি না কে জানে, কয়েক দিনের মধ্যেই মৃত্যু হলো তার। এরপর মুজতবা আলির মন্তব্য এই-সেই অচেনা মাছটি ইলিশই ছিল এবং ইলিশ খেয়ে যখন সম্রাটের মৃত্যু হয়েছে, তখন নিশ্চিত তিনি বেহেশতে গেছেন।
ইলিশ নিয়ে অত কথা বললাম এজন্য যে, এবার ইলিশ নিয়ে মহাকা- ঘটে গেছে। প্রতি বছর অক্টোবর মাসে পূজার সময় বাংলাদেশ থেকে ট্রাকভর্তি করে ইলিশ যায় পশ্চিমবঙ্গে। গত বছরও পূজার সময় ১১০০ মেট্রিক টন ইলিশ মাছ গিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে।
শেখ হাসিনা সরকার প্রত্যেকবার পুজোর আগে ভারতে ইলিশ পাঠিয়ে আসছিল। এই মাছ যেমন রাজ্যের বাজারে বিক্রি হতো, তেমনি দেশের অন্য বাজারগুলোতেও এখান থেকে যেত। কিন্তু বাংলাদেশের এই অশান্ত পরিস্থিতিতে এবার নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না ওপারে এবার ইলিশ যাবে কি না! কলকাতার মাছ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ইলিশ ছাড়াও প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে ৮ থেকে ১০টি ট্রাকে পাবদা, পারশে, ভেটকী, টেংরা, পমফ্রেট এবং অন্যান্য মাছ যায় ভারতে।
সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, কলকাতার একজন মাছ ব্যবসায়ী বলেছেন, ইলিশের জন্য আজ আমরা আক্ষরিক অর্থে বাংলাদেশের কৃপাপ্রার্থী। দুর্গাপূজার আগে কবে সরকারিভাবে ইলিশ রফতানির ঘোষণা আসবে আমরা সেজন্য অপেক্ষা করছি। জানা যায়, বাংলাদেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের হাল এখন ‘ঘটি ডোবে না নামেই তালপুকুর’-এর মতো। বাংলাদেশি ইলিশের জন্য পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের নোলা সদাই চুকচুক করে, কিন্তু গঙ্গা, রূপনারায়ণপুরে মাথা কুটেও ইলিশের দেখা মেলে না। পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের জোগান যতটুকু, তা হয় দিঘার সমুদ্র, নয়তো ডায়মন্ড হারবারের মোহনার দান। ৮৪ বছর আগে বুদ্ধদেব বসু ‘কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে ইলিশ ভাজার গন্ধ’ ও ‘সরস সর্ষের ঝাঁজে’ বর্ষার সঙ্গে ‘ইলিশ উৎসব’-এর যে অনবদ্য যুগলবন্দি সৃষ্টি করেছেন, আজ তা বাংলাদেশের কৃপার ওপর নির্ভর করে জেগে রয়েছে।
গঙ্গায় যে ইলিশ ধরা পড়ে, তা সমুদ্র থেকে কত দূর সাঁতরায়? বড় জোর ৫০-৬০ কিলোমিটার। আর পদ্মায় যেগুলো ধরা পড়ছে, তাকে সাঁতরাতে হয় দ্বিগুণ বেশি দূরত্ব। ইলিশের এ উজান বাওয়ায় তার ওজনে বাড়ে, স্বাদও খোলে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে ঢোকার পর গঙ্গার নাম হয়েছে পদ্মা। নদীটা কিন্তু এক। এ নদীতে ‘ডায়াকম’ নামে এক শেওলা জন্মায়। সেই শেওলা ইলিশের অতি প্রিয় খাদ্য। আশ্চর্য, ডায়াকম কিন্তু মেঘনা বা অন্য নদীতে জন্মায় না। পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গার তুলনায় বাংলাদেশের পদ্মা আড়ে-বহরে, দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বেশি। ফলে ডায়াকমের পরিমাণও বেশি। কাজেই পদ্মার ইলিশের স্বাদ বেশি হওয়ার যুক্তিসংগত ও বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার পর এবার পুজোয় পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশি ইলিশ পাঠানো যাবে কি না, তা সময়ই হয়তো বলে দেবে।