৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:১৯:৫০ পূর্বাহ্ন


দেশকে মিথিলা
পড়াশোনা আমার কাছে থেরাপির মতো
আলমগীর কবির
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০৮-২০২৫
পড়াশোনা আমার কাছে থেরাপির মতো রাফিয়াত রশিদ মিথিলা


অভিনয়জগতের পরিচিত মুখ রাফিয়াত রশিদ মিথিলা শুধু পর্দার নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দাপটের সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন। এবার সেই পথচলায় যুক্ত হলো আরেকটি নতুন পালক পিএইচডি ডিগ্রি। ইউনিভার্সিটি অব জেনেভা থেকে পাঁচ বছরের দীর্ঘ সাধনার ফলাফল এই ডিগ্রি। শিক্ষাজীবনের নানা বাঁক, গবেষণার অভিজ্ঞতা ও এই অর্জনের পেছনের গল্প নিয়ে কথা বললেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির 

প্রশ্ন: অভিনয়ের পাশাপাশি পিএইচডি অর্জন; এটি কীভাবে সম্ভব হলো?

মিথিলা: এটা খুব সহজ ছিল না। সত্যি বলতে, জীবনে যা কিছু অর্জন করেছি, তার সবটাই নিজের চেষ্টায়। শতভাগ নিজে করে এসেছি। পিএইচডি অর্জনটাও ঠিক তেমনই। অভিনয়, সন্তান, সংসার, চাকরি সবকিছুর মধ্যে থেকেও সময় বের করেছি লেখাপড়ার জন্য। এই অর্জন আমার একান্তই নিজের। যদিও আমার পাশে অনেক শুভাকাঙ্খী ছিল, অনেকে সহযোগিতা করেছেন, কিন্তু দিনশেষে কাজটা আমাকেই করতে হয়েছে। সেই জন্য এটা আরও বেশি সন্তোষজনক। নিজের শ্রম, সময়, কষ্ট সব মিলিয়ে এই অর্জনটা একেবারে হৃদয়ের কাছাকাছি।

প্রশ্ন: আপনার পিএইচডির বিষয় ছিল ‘আর্লি চাইল্ডহুড এডুকেশন’। এই বিষয়টি বেছে নেওয়ার পেছনে কোনো বিশেষ কারণ ছিল?

মিথিলা: আমি শিশুশিক্ষা এবং শিশুদের মানসিক বিকাশ নিয়ে বরাবরই আগ্রহী। আমার ব্র্যাকের কাজও এই খাত ঘিরেই, বিশেষ করে আফ্রিকাতে। তাই যখন পিএইচডির বিষয় বাছাই করি, তখন আমি এমন কিছু খুঁজছিলাম যা শুধু আমার আগ্রহের সঙ্গে মিলবে না, বরং সমাজের জন্যও কার্যকর হবে। ‘আর্লি চাইল্ডহুড এডুকেশন’ সেই দিক থেকে পারফেক্ট ছিল। ছোটবেলার শিক্ষা শুধু একাডেমিক না, সেটি পুরো জীবনকে প্রভাবিত করে। এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করাটা ছিল আমার প্যাশন এবং দায়িত্ব।

প্রশ্ন: আপনি যেখান থেকে পিএইচডি করেছেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রোগ্রাম সম্পর্কে কিছু বলবেন?

মিথিলা: আমি পিএইচডি করেছি ইউনিভার্সিটি অব জেনেভা থেকে, সুইজারল্যান্ডে। এটা একটি অত্যন্ত প্রখ্যাত ও গ্লোবালি স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে সোশ্যাল সায়েন্স ও এডুকেশন বিষয়ক গবেষণায়। আমার পিএইচডি প্রোগ্রাম ছিল একদম ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডের। আমি পাঁচ বছর সময় দিয়েছি এই ডিগ্রির জন্য। শুরুটা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। তখন অফার লেটার পাই, তারপর থেকেই যাত্রা শুরু।

প্রশ্ন: পিএইচডি করতে গিয়ে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে?

মিথিলা: অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। আমার একটি ফুলটাইম চাকরি আছে, যেটি সম্পূর্ণ আফ্রিকা-কেন্দ্রিক। ফলে প্রচুর ট্রাভেল করতে হতো, প্রায় সারাক্ষণই ভ্রমণে থাকতাম। অন্যদিকে আমার বিশ্ববিদ্যালয় সুইজারল্যান্ডে, সেখানেও সময় বের করে যেতে হতো। গবেষণার শুরুতেই করোনা মহামারি শুরু হয়, তাই তথ্য সংগ্রহে এক বছর পিছিয়ে গিয়েছিলাম। তার মধ্যে আবার অভিনয় থেকেও একদম বিচ্ছিন্ন হতে পারিনি। বছরে এক-দুটি প্রজেক্ট করেছি মন চেয়েছে বলেই। এ ছাড়া সংসার ও সন্তানের দায়িত্ব তো ছিলই। সব মিলিয়ে সময় বের করা ছিল অনেক কঠিন।

প্রশ্ন: আপনার শিক্ষাজীবন বরাবরই কেমন ছিল? অনেকেই বলেন আপনি একজন মেধাবী ছাত্রী ছিলেন।

মিথিলা: হ্যাঁ, আমি সবসময়ই পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি প্রথম বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছি। এরপর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স করি। সেখানে ৪-এর মধ্যে ৪ পেয়েছিলাম সিজিপিএ পারফেক্ট স্কোর ছিল। সে কারণে আমি চ্যান্সেলর গোল্ড মেডেল পাই। ২০১৪-১৬ শিক্ষাবর্ষে আমি একমাত্র শিক্ষার্থী ছিলাম যিনি সব বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ সিজিপিএ পেয়েছেন। এটা আমার জন্য অনেক বড় একটা অর্জন ছিল।

প্রশ্ন: আপনার পড়াশোনা এবং গবেষণা করার প্রেরণা কী? কীভাবে এত ব্যস্ততার মধ্যেও পড়াশোনাকে সময় দিতে পারলেন?

মিথিলা: পড়াশোনা আমার কাছে থেরাপির মতো। অনেকেই গিটার বাজিয়ে, পিয়ানো বাজিয়ে শান্তি পায়, আমি পড়তে বসলে পৃথিবীর সব ভুলে যাই। আমার মন শান্ত হয়। যখন পড়াশোনায় ডুবে যাই, তখন বাইরের চাপ, স্ট্রেস সবকিছু ভুলে যাই। তাই এটা আমার কাছে শুধু দায়িত্ব নয়, বরং আত্মার খোরাক। এত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বের করেছি কারণ এটা ছিল আমার মনের দাবি।

প্রশ্ন: এই দীর্ঘ যাত্রায় কোনো সময় কি মনে হয়েছে, আপনি থেমে যাবেন? হতাশা এসেছে?

মিথিলা: হতাশা আসেনি বললে মিথ্যে বলা হবে। অনেক সময় মনে হয়েছে সব ছেড়ে দিই। সময়, ক্লান্তি, পারিবারিক চাপ, চাকরির দায়িত্ব সব মিলে খুব কঠিন সময় গেছে। বিশেষ করে যখন করোনার কারণে কাজ থেমে যায়, তথ্য সংগ্রহ পিছিয়ে যায়, তখন খুব হতাশ লেগেছিল। কিন্তু নিজের লক্ষ্য স্থির ছিল বলেই টিকে থাকতে পেরেছি। আমি জানতাম, এই কাজটা আমি শেষ করবই।

প্রশ্ন: পাঁচ বছর ধরে এত আত্মত্যাগ করেছেন। সামাজিক জীবন কতটা প্রভাবিত হয়েছে?

মিথিলা: অনেকটাই। বলা চলে আমার সামাজিক জীবন প্রায় ছিল না। কোনো দাওয়াতে যাওয়া হয়নি, বন্ধুদের আড্ডা থেকেও দূরে থাকতে হয়েছে। বিনোদন অঙ্গনের অনুষ্ঠানেও খুব একটা অংশ নিতে পারিনি। প্রতিটি মুহূর্ত ছকে বাঁধা ছিল। কোথায় যাব, কখন কী করব সব পরিকল্পনা অনুযায়ী চলতে হতো। পাঁচ বছর এমনভাবে চলতে চলতে এখন সামাজিক পরিসরে যেতেও ভালো লাগে না।

প্রশ্ন: এই অর্জনকে আপনি কীভাবে দেখেন? ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কী?

মিথিলা: এটা নিঃসন্দেহে আমার জীবনের অন্যতম বড় অর্জন। এত কষ্ট, সময়, ত্যাগের পর যখন সাফল্য আসে, সেটা সত্যিই আত্মতৃপ্তির। এখন আমি চাই এই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সমাজে অবদান রাখতে। শিশুশিক্ষা নিয়ে আরও গবেষণা, নীতি নির্ধারণে অংশগ্রহণ এবং মাঠপর্যায়ে কাজ করার পরিকল্পনা আছে। আমি চাই আমার জ্ঞান বাস্তব ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে।

প্রশ্ন: যারা অভিনয়, সংসার, চাকরি ও পড়াশোনা একসঙ্গে সামলাতে চান তাদের জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?

মিথিলা: আমি বলব, আগে নিজের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করতে হবে। আপনি যদি জানেন আপনি কী চান, তাহলে সময় বের করাই সম্ভব। ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে, বিনিময়ে যা পাবেন তা অমূল্য। সময় ব্যবস্থাপনা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর সবচেয়ে বড় কথা নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। আমি পেরেছি, আপনারাও পারবেন।

শেয়ার করুন