৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ১১:৪৯:৪৭ অপরাহ্ন


যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বাতিলের ক্ষমতা কার হাতে
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-০৭-২০২৫
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বাতিলের ক্ষমতা কার হাতে ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস


সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব বাতিল করার ইঙ্গিত বারবার উঠে আসছে হোয়াইট হাউস থেকে। নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া বা ডিন্যাচারালাইজেশন হলো এমন একটি আইনগত প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনো ন্যাচারালাইজ নাগরিকের মার্কিন নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। এটি খুবই বিরল ও জটিল একটি পদক্ষেপ এবং শুধু নির্দিষ্ট কিছু আইনি ভিত্তিতে এই প্রক্রিয়া শুরু করা যায়। মার্কিন আইনে, কোনো ব্যক্তি যদি নাগরিকত্ব লাভের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য দেন বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য গোপন করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে ডিন্যাচারালাইজেশন প্রক্রিয়া চালানো যেতে পারে। এ ছাড়া যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, কিংবা যারা পরিচয় গোপন করে বা জাল পরিচয়ে নাগরিকত্ব লাভ করেছেন, তারাও এ প্রক্রিয়ার আওতায় পড়তে পারেন। এমনকি যদি কেউ নাগরিক হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে সন্ত্রাসী বা রাষ্ট্রবিরোধী কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাহলেও তার নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া যেতে পারে।

ডিন্যাচারালাইজেশন করার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ এবং ফেডারেল আদালতের হাতে থাকে। এ ধরনের মামলা সাধারণত ফেডারেল আদালতে দায়ের করা হয় এবং শুধু একজন ফেডারেল বিচারকই চূড়ান্তভাবে নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশ দিতে পারেন। প্রশাসনিক পর্যায়ে কাউকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার কোনো ক্ষমতা নেই।

এ প্রক্রিয়াটি দুটি পদ্ধতিতে পরিচালিত হতে পারে : সিভিল মামলা ও ফৌজদারি মামলা। নাগরিক মামলায় সরকারের পক্ষে প্রমাণের মানদণ্ড অপেক্ষাকৃত কম পরিষ্কার, দৃঢ় এবং সন্দেহাতীত প্রমাণ দেখাতে হয়। অন্যদিকে ফৌজদারি মামলায় সরকারকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হয় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি মিথ্যা বলে বা প্রতারণার মাধ্যমে নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন। ফৌজদারি মামলায় জুরি ট্রায়াল হয় এবং সাজা হিসেবে জেলও হতে পারে। যদি কাউকে ডিন্যাচারালাইজ করা হয়, তাহলে তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব হারান এবং পূর্বের অভিবাসন অবস্থানে ফিরে যান। যদি তিনি অন্য কোনো বৈধ অভিবাসন অবস্থায় না থাকেন, তাহলে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো বা বহিষ্কার করা হতে পারে। কখনো কখনো ওই ব্যক্তির স্ত্রী বা সন্তানরাও যদি তার মাধ্যমে নাগরিকত্ব পেয়ে থাকেন, তাহলে তারাও প্রভাবিত হতে পারেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মার্কিন মুলুকে জন্ম নেওয়া কোনো ব্যক্তির নাগরিকত্ব সাধারণত বাতিল করা যায় না। কেবল ন্যাচারালাইজেশনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়া ব্যক্তিরাই ডিন্যাচারালাইজেশনের আওতায় পড়েন। এছাড়া রাজনৈতিক মত প্রকাশ বা সরকারের সমালোচনা কোনোভাবেই ডিন্যাচারালাইজেশনের বৈধ কারণ নয়। যদি কেউ তার অভিবাসন অবস্থা বা অতীত অপরাধের কারণে উদ্বিগ্ন হন, তাহলে দ্রুত একজন অভিজ্ঞ অভিবাসন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। আদালতের সিদ্ধান্ত এবং সঠিক আইনগত সহায়তার মাধ্যমেই কেবল এ ধরনের জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব।

কর ফাঁকি দিলে নাগরিকত্ব বাতিলে ইঙ্গিত ট্রাম্প প্রশাসনের

যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত যেসব কারণে নাগরিকত্ব বাতিল (ডিন্যাচারালাইজেশন) করা হতো, তা ছিল যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি কিংবা সন্ত্রাসবাদের মতো গুরুতর অপরাধ। তবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের অধীনে এ চর্চা নতুন এক মাত্রা পেয়েছে। এখন এমনকি কর রিটার্নে আয় কম দেখানোর মতো ত্রুটিও হতে পারে নাগরিকত্ব হারানোর কারণ। ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন কড়াকড়ির অংশ হিসেবে সম্প্রতি বিচার বিভাগ নাগরিকত্ব বাতিলকে তাদের সিভিল ডিভিশনের শীর্ষ পাঁচটি প্রয়োগযোগ্য অগ্রাধিকারে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এতে করে এখন ১০টি নির্ধারিত ক্যাটাগরির পাশাপাশি যে কোনো ক্ষেত্রকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে নাগরিকত্ব বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া যাবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এমনকি ইলন মাস্ক ও নিউইয়র্ক সিটির মেয়র প্রার্থী জোহারান মামদানি-দুজনেই ন্যাচারালাইজপ্রাপ্ত নাগরিক। তাদের নাগরিকত্ব বাতিলের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া এবং বর্তমানে আয়ারল্যান্ডে বসবাসকারী ট্রাম্পবিরোধী কমেডিয়ান রোজি ও’ডনেলের নাগরিকত্ব বাতিলের কথাও বিবেচনায় আনা হয়েছে।

নাগরিকত্ব বাতিলের চর্চা বহু আগেই আইনের আওতাভুক্ত ছিল, কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে এর প্রয়োগের অগ্রাধিকার এবং ক্ষেত্র ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আইনজীবী প্যাট্রিসিয়া কোরালেস জানিয়েছেন, আগের প্রশাসনগুলো যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের ওপর মনোযোগ দিতো, ট্রাম্পের অধীনে অপেক্ষাকৃত ছোটখাটো ভুল বা অপরাধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ২০১৮ সালে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেই ডিন্যাচারালাইজেশন মামলার সংখ্যা হঠাৎ করে দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পায়। ব্লুমবার্গ ল’র এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সে বছর ৯০টির বেশি সিভিল ও ক্রিমিনাল মামলা দায়ের করা হয়, যা ওবামা এবং বুশের সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।

এ নীতির বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায় হিউস্টনের বাসিন্দা ভ্যানেসা বেনের ক্ষেত্রে। তিনি একজন হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করতেন এবং ২০১৭-১৮ সালে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন। সে সময় তিনি সাক্ষাৎকারে জানান যে তিনি কোনো অপরাধ করেননি। পরে ২০১৯ সালে তার বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়। তিনি অপরাধ স্বীকার করে জরিমানা দেন এবং এক বছরের কারাদণ্ডও ভোগ করেন। এরপরও বিচার বিভাগ এখন তার নাগরিকত্ব বাতিলের চেষ্টা করছে এ অভিযোগে তিনি নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার সময় তার অপরাধ গোপন রেখেছিলেন। আইনি বিশেষজ্ঞদের মতে, ছোটখাটো অপরাধের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব বাতিল খুবই বিরল ঘটনা। তবে নাগরিকত্বপ্রাপ্তির সময় কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করা হলে আইনত সে নাগরিকত্ব বাতিল করা যেতে পারে। এসব মামলা সিভিল ও ক্রিমিনাল দুভাবেই আনা যায়। ক্রিমিনাল মামলায় প্রমাণের মানদণ্ড হলো ‘বিয়ন্ড এ রিজনেবল ডাউট’, যেখানে সিভিল মামলায় তা তুলনামূলকভাবে কম কঠোর, ‘স্পষ্ট, নিশ্চিত ও সন্দেহাতীত প্রমাণ’ দিতে হয়। যারা সেনাবাহিনীর মাধ্যমে নাগরিকত্ব পেয়েছেন, তারাও যদি নাগরিক হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হন বা ভুল তথ্য দেন, তবে তাদের নাগরিকত্বও বাতিল হতে পারে। এমনকি সন্তান বা স্বামী-স্ত্রীও এ থেকে রেহাই পান না।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এই নীতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য প্রমিলা জয়াপাল বলেন, এ নীতি এমন এক বার্তা দেয় যে, আপনি বাকিদের মতো আসল আমেরিকান নন। ফলে অনেকেই নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়াতে অংশ নিতে ভয় পাচ্ছেন। আইনজীবী গিনতারি গ্রিগাইটি বলেন, প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত নাগরিক কিংবা অভিবাসী যেই হোন না কেন, যে কোনো মামলায় দোষ স্বীকার করার আগে একজন অভিজ্ঞ অভিবাসন আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক। কারণ এখন একটি ছোট ভুলের জন্যও নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকি দেখা দিচ্ছে।

আইনি দিক থেকে সুরক্ষা থাকলেও ট্রাম্প প্রশাসনের বড় পরিসরের নীতিগত পরিবর্তন আদালতের বাইরেও রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ফেলছে। প্রাক্তন হোয়াইট হাউজ উপদেষ্টা অ্যান্ড্রিয়া ফ্লোরেস জানান, ডিন্যাচারালাইজেশনের চর্চা আগে যতটা সীমিত ছিল, এখন ততটাই বিস্তৃতভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

এমনকি কট্টর ডানপন্থীরা সাংবাদিক ও প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধেও নাগরিকত্ব বাতিলের আহ্বান জানাচ্ছেন, যাদের বক্তব্যে তারা হামাসের প্রতি সহানুভূতি খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবি। এটি ১৯০৭ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া ২২ হাজারেরও বেশি নাগরিকত্ব বাতিলের ঘটনার প্রতিধ্বনি দেয়, যেগুলো পরবর্তী সময়ে আদালত দ্বারা বাতিল হয়।

আইনি বিশেষজ্ঞ ম্যাথু হপক বলেন, এমন অভিযোগ প্রমাণ করতে হলে সরকারকে স্পষ্ট ও সন্দেহাতীত প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। ফেডারেল আদালত এ চর্চার ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে বলেও মত দেন অধ্যাপক স্টিফেন ইয়েল-লোয়ের। তার মতে, একজন মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই আদালত নিশ্চিত করবে আইনগত মানদণ্ড পূরণ হয়েছে কি না। সুতরাং ট্রাম্প প্রশাসনের নাগরিকত্ব নীতির আসল লক্ষ্য যতটা না অধিকসংখ্যক নাগরিকত্ব বাতিল, তার চেয়ে বড় হলো একটি ‘ভীতির পরিবেশ’ সৃষ্টি করা যাতে প্রবাসীরা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়া থেকে বিরত থাকে।

শেয়ার করুন