১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ৬:০৮:৫৯ পূর্বাহ্ন


বন্দুকধারীর গুলিতে বাংলাদেশী দিদারুলসহ পাঁচজন নিহত
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-০৭-২০২৫
বন্দুকধারীর গুলিতে বাংলাদেশী দিদারুলসহ পাঁচজন নিহত নিহত নিউ ইয়র্ক সিটি পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম


নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যানহাটনের পার্ক অ্যাভিনিউর একটি কর্পোরেট ভবনে গত ২৮ জুলাই সোমবার সন্ধ্যায় এক বন্দুকধারীর হামলায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট (এনওয়াইপিডি)-এর কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম (৩৬) সহ মোট পাঁচজন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে তিনজন কর্পোরেট কর্মচারি, একজন ভবনের নিরাপত্তা রক্ষী এবং পুলিশ অফিসার দিদারুল ইসলাম রয়েছেন। হামলাকারী পরে নিজেই আত্মহত্যা করে। এই বর্বর ঘটনায় আরও একজন গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এই হামলার পর শহর জুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে এবং পুরো ঘটনার তদন্তে ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) সহযোগিতা করছে।

ঘটনাটি ঘটে নিউ ইয়র্কের ৩৪৫ পার্ক অ্যাভিনিউতে, একটি ৪০ তলা ভবনে, যেখানে ব্ল্যাকস্টোন গ্রুপ, ন্যাশনাল ফুটবল লিগ (অনএফএল ), কেপিএমজি এবং রুডিন ম্যানেজমেন্টের মত কর্পোরেট দপ্তর রয়েছে। ২৮ জুলাই সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটের কিছু আগে হামলাকারী লাস ভেগাসের বাসিন্দা শেইন তামুরা (২৭), এআর ফিফটিন রাইফেল হাতে একটি ডাবল পার্ক করা বিএমডব্লিউ গাড়ি থেকে বেরিয়ে ভবনে প্রবেশ করেন। ভবনের লবিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এনওয়াইপিডি অফিসার দিদারুল ইসলামকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়েন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকে হত্যা করেন। এরপর খুনি তামুরা একজন নারীকে গুলি করেন যিনি একটি পিলারের আড়ালে লুকাতে চেষ্টা করছিলেন। এরপর পুরো লবিতে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে থাকেন। হামলাকারী শেইন তামুরা তখন একটি ডেস্কের পেছনে আশ্রয় নেওয়া নিরাপত্তারক্ষী এবং আরেকজন ব্যক্তিকে গুলি করেন। এরপর তিনি লিফটে উঠে ৩৩ তলায় যান, যেখানে রুডিন ম্যানেজমেন্টের অফিস অবস্থিত। সেখানে তিনি আরেকজন নারী কর্মচারিকে গুলি করে হত্যা করেন। অবশেষে ভবনের করিডোরে গিয়ে নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। এই মর্মান্তিক ঘটনা শুধু নিউ ইয়র্ক নয়, গোটা যুক্তরাষ্টকে নাড়া দিয়ে গেছে। নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটি এই ঘটনার পর গভীর শোক প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন মসজিদ, সামাজিক সংগঠন ও বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন দিদারুল ইসলামের স্মরণে দোয়া মাহফিল ও শোকসভা আয়োজন করেছে। নিহত পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম ছিলেন ৩৬ বছর বয়সী একজন বাংলাদেশী অভিবাসী। তার বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া সদর উপজেলাধীর পৌর এলাকার এলাকার বাসিন্দা। বাংলাদেশ থেকে নিউ ইয়র্কে এসে তিন বছর আগে এনওয়াইপিডিতে যোগ দেন। তিনি ব্রঙ্কসের ৪৭তম প্রিসিঙ্কটে কর্মরত ছিলেন এবং ঘটনার দিন কর্পোরেট সিকিউরিটির অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার দুটি সন্তান রয়েছে এবং বর্তমানে স্ত্রী আট মাসের গর্ভবতী। পুলিশ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দিদারুল ইসলাম ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। এক পর্যায়ে তিনি মিডল স্কুলে পিস অফিসার হিসেবে কাজ করতেন। পরবর্তীতে তিনি এনওয়াইপিডি একাডেমিতে ভর্তি হন এবং ২০২১ সালে পুলিশ অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান। তার সহকর্মীরা জানান, তিনি অত্যন্ত দায়িত্ববান, পরিশ্রমী ও সততার প্রতীক ছিলেন।

নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র এরিক অ্যাডামস বলেন, দিদারুল ইসলাম শুধু একজন পুলিশ অফিসার নন, তিনি ছিলেন এই শহরের আত্মার প্রতীক। তার উদ্যম, সাহস এবং শহরের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে সত্যিকারের নিউ ইয়র্কার করে তুলেছে। মেয়র অ্যাডামস আরো বলেন, তিনি এই শহরের জন্য জীবন দিয়েছেন। তার আত্মত্যাগ আমাদের সকলের জন্য এক অনুপ্রেরণা।

নিউ ইয়র্ক সিটি পুলিশ কমিশনার জেসিকা টিশ জানান, হামলাকারী তামুরার মানসিক রোগের একটি পূর্ব-রেকর্ড রয়েছে। তার গাড়ি থেকে রিভলভার, অতিরিক্ত ম্যাগাজিন, গোলাবারুদ এবং মানসিক রোগের প্রেসক্রিপশনযুক্ত ওষুধ উদ্ধার করা হয়েছে। তামুরা তার গাড়ি নিয়ে কলোরাডো, নেব্রাস্কা, আইওয়া হয়ে নিউ জার্সির কলাম্বিয়া শহর পর্যন্ত যাত্রা করেন এবং সেদিন বিকেল ৪টা ২৪ মিনিটে নিউ ইয়র্ক সিটিতে প্রবেশ করেন। কমিশনার টিশ আরো বলেন, তিনি আমাদের শহরের প্রতীক। ইউনিফর্ম পরে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি যেমন বেঁচে ছিলেন, তেমনি এক বীর হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন।

দিদারুল ইসলামের মৃত্যুতে ব্রঙ্কসে তার পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার ভগ্নিপতি জামীল রহমান জানান, তিনি ছিলেন একজন পরিশ্রমী, পরিবারপ্রেমী মানুষ। আমাদের বিশ্বাসই হচ্ছে না, যে মানুষটিকে সকালে বিদায় জানালাম, সে আর ফিরে আসবে না। বন্ধু মারজানুল করিম জানান, দিদারুল আগে স্কুলে পিস অফিসার হিসেবে কাজ করতেন, কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল এনওয়াইপিডিতে কাজ করার। তিনি সেটা অর্জন করেছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের পরিবার, বয়স্ক মা-বাবা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাজ করে গেছেন। তাঁর আত্মত্যাগ ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

দিদারুল ইসলামের মৃত্যু বিশেষভাবে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর শোক ও বেদনার ছায়া ফেলেছে। নিউ ইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটি অনেকেই তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, এবং তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বিভিন্ন সংগঠন ইতিমধ্যে শোকসভা ও সাহায্যের উদ্যোগ নিয়েছে। দিদারুল ছিলেন কর্মঠ, পরিবারকেন্দ্রিক এবং স্বপ্নবাজ একজন মানুষ, যিনি আমেরিকান স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি শুধু একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন না, বরং ছিলেন একটি পরিবারের স্তম্ভ, সমাজের একজন সম্মানিত নাগরিক এবং এক আদর্শ অভিবাসী।

তার এক সহকর্মী বলেন, দিদার সবসময় হাসিখুশি থাকতেন, নিজের কাজটাকে ভালোবাসতেন। পুলিশে যোগদানের পরও তিনি কখনো তার শেকড় ভুলে যাননি। বাংলাদেশে তার বাবা-মায়ের খোঁজখবর রাখতেন, তাদের চিকিৎসা ও ভরণপোষণের দায়িত্বও তিনিই পালন করতেন। ইসলাম তার পরিবারের জন্য নিউ ইয়র্কে একটি ছোট্ট বাড়ি কিনেছিলেন, এবং তার জীবনের লক্ষ্য ছিল সন্তানদের নিরাপদ ও শিক্ষিত পরিবেশে বড় করে তোলা। দুঃখজনকভাবে সেই স্বপ্ন আজ ধুলিসাৎ। এই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয়েছে দিদারুল ইসলামের বীরত্বের প্রশংসা এবং তার আত্মত্যাগের মূল্যায়ন। অনেকেই বলছেন, ইসলাম ছিলেন সেই মানুষ, যিনি জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে একজন অভিবাসীও এই দেশের জন্য সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন।

এই হামলা বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন ও মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর জাতীয় বিতর্ক ফের জোরদার করেছে। কিভাবে একটি এই রাইফেল ও বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরে থাকা একজন মানসিক রোগী এমন একটি উচ্চ-নিরাপত্তা ভবনে ঢুকে পড়তে পারে সেটা নিয়ে প্রশাসন, পুলিশ এবং সুশীল সমাজের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্ত্র ক্রয়ে লাইসেন্সের মানদণ্ড আরও কঠোর করা না হলে এ ধরনের হামলা রোধ সম্ভব নয়। ঘটনার পর ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। ভবনটিতে এত বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার অফিস থাকার পরও অস্ত্র স্ক্যানার বা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আগেভাগেই হামলাকারীকে শনাক্ত করা যায়নি। অনেকেই বলছেন, ভবিষ্যতে এমন ভবনগুলোতে উন্নত নিরাপত্তা প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষিত সশস্ত্র নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা দরকার।

এই ঘটনার পর দিদারুল ইসলামের পরিবার, বিশেষ করে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী এবং দুই সন্তানযারা এখন পিতৃহীন হয়ে গেল, তাদের জন্য সহমর্মিতা ও অর্থনৈতিক সহায়তা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। ইতিমধ্যে কিছু পুলিশ সংগঠন পরিবারটির জন্য তহবিল সংগ্রহ শুরু করেছে, এবং নিউ ইয়র্ক পুলিশ ফাউন্ডেশনও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। নিউ ইয়র্ক পুলিশ ফাউন্ডেশন নিহত অফিসারের পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তা তহবিল ঘোষণা করেছে। দিদারুলের স্ত্রী বর্তমানে গর্ভবতী, তার দুটি ছোট সন্তান রয়েছে। প্রশাসন তাদের শিক্ষাগত ও বাসস্থান খরচসহ অন্যান্য বিষয়েও সহায়তা দেবে বলে জানানো হয়েছে। মেয়র এরিক অ্যাডামস বলেন, এই শহরের প্রতিটি মানুষ দিদারুল ইসলামের পরিবারের পাশে থাকবে। আমরা তার আত্মত্যাগকে সম্মান জানিয়ে যাব।

এই ঘটনায় ভবিষ্যতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথা বলেছে পুলিশ বিভাগ। পুলিশ কমিশনার টিশ এবং মেয়র অ্যাডামস এক যৌথ বিবৃতিতে জানান, কর্পোরেট ভবনগুলোর নিরাপত্তা জোরদার, মানসিক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হবে। একই সঙ্গে এনওয়াইপিডির অফিসারদের জন্য মনোসামাজিক সহায়তা ও নিরাপত্তা প্রশিক্ষণও বাড়ানো হবে।

এই মর্মান্তিক ঘটনা শুধু নিউ ইয়র্ক নয়, গোটা দেশকে নাড়া দিয়ে গেছে। এটি প্রমাণ করে, অভিবাসী সমাজ শুধু অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেই নয়, আত্মত্যাগ ও সাহসের প্রতীক হিসেবেও নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। দিদারুল ইসলাম ছিলেন সেই প্রতীক-একজন মানুষ যিনি স্বপ্ন নিয়ে এই দেশে এসেছিলেন, নিজের ঘাম ও রক্ত দিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়ে তা অমর করে গেছেন।

এই মর্মান্তিক ঘটনার পর নিউ ইয়র্ক সিটিতে আবারও শুরু হয়েছে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে তীব্র আলোচনা। বহু বিশ্লেষক এবং মানবাধিকার সংগঠন প্রশ্ন তুলেছে, কীভাবে একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি-যার ‘ডকুমেন্টেড মেন্টাল হেলথ হিস্ট্রি’ রয়েছে-সাধারণভাবে একটি এম-৪ রাইফেলের মতো সামরিক ধাঁচের অস্ত্র পেতে পারে এবং এমন একটি স্পর্শকাতর এলাকায় ঢুকে নির্বিঘ্নে এতগুলো প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। অনেকেই বলছেন, এটি শুধু নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা নয়, বরং একটি বৃহত্তর নীতিগত সমস্যার প্রতিফলন।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে এই ধরনের গণহত্যা, যেগুলোর পেছনে অস্ত্র আইনের শিথিলতা, মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং সামাজিক নিঃসঙ্গতা-সব মিলিয়ে এক বিপজ্জনক সংমিশ্রণ কাজ করছে। তামুরার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, তার লাস ভেগাসে অস্ত্র বহনের অনুমতি ছিল, এমনকি ২০২২ সালে সে একটি কনসিলড ফায়ারআর্মস পারমিট পেয়েছিল, যা তাকে লুকিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র বহনের বৈধতা দিয়েছিল। অথচ সে মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিল এবং তার ওষুধপত্র গাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, তামুরার গাড়ির ভেতরে একটি রাইফেল, রিভলভার, বহু গুলি এবং একটি রাইফেল কেস ছিল, যার অর্থ হচ্ছে সে পূর্বপরিকল্পিতভাবেই এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। তবে প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে-এই পরিকল্পনা কী উদ্দেশ্যে এবং কাকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছিল?

রুডিন ম্যানেজমেন্ট, ব্ল্যাকস্টোন এবং এনএফএল-এর মতো প্রতিষ্ঠান যেখানে এত উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা থাকার কথা, সেই ভবনের অভ্যন্তরে কিভাবে একজন ব্যক্তি এম-৪ রাইফেল নিয়ে ঢুকে পড়তে পাড়ল-তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। যদিও ভবনের সিসিটিভি ক্যামেরায় পুরো ঘটনাটি ধারণ করা হয়েছে, তথাপি সেই মুহূর্তে অস্ত্রধারীকে নিরস্ত্র করার মতো যথেষ্ট প্রস্তুতি বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা কেন ছিল না, তা এখন আলোচনা ও তদন্তের কেন্দ্রবিন্দুতে।

নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগ এই ঘটনার পর শহরের অন্যান্য স্পর্শকাতর এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা আরও জোরদার করেছে। বিভিন্ন ভবনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে এবং ভবনের নিরাপত্তা নীতিমালাগুলো পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন ইতিমধ্যে হামলাকারী তামুরার অতীত ইতিহাস, যোগাযোগ ও ডিজিটাল অ্যাক্টিভিটি বিশ্লেষণ শুরু করেছে। পাশাপাশি, তার মানসিক চিকিৎসার রেকর্ড, পূর্বের কোনো অস্বাভাবিক আচরণ এবং তার ভ্রমণের গতিপথও তদন্ত করা হচ্ছে।

তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, শুধু তদন্ত করলেই হবে না। এর পেছনে যে সামাজিক, আইনগত এবং নীতিগত সমস্যাগুলো কাজ করছে, সেগুলো নিয়েও এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই ঘটনার পর আবারও প্রশ্ন উঠেছে-যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিগতভাবে আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অধিকারের বিপরীতে জননিরাপত্তার বিষয়টি কীভাবে বিবেচনা করা হবে? কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও নজরদারি আরও উন্নত করা যায়? কিভাবে ভবিষ্যতে এমন ঘটনাগুলো প্রতিরোধ করা যায়?

এমন ভয়াবহ একটি ঘটনার পর শহরজুড়ে আতঙ্কের ছায়া নেমে এলেও, একইসঙ্গে দিদারুল ইসলামের মতো বীরদের গল্পও সমাজকে আশার আলো দেখায়। তিনি একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়ে গেলেন-সাহস, কর্তব্য ও আত্মত্যাগ কখনো জাত, ধর্ম বা দেশের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় না। একজন মানুষ যদি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যদের রক্ষা করতে প্রস্তুত থাকেন, তবে তিনি সর্বকালের নায়ক।

নিউ ইয়র্ক সিটি এখন এই ঘটনায় শোকাহত, বিচলিত, কিন্তু একইসঙ্গে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ-এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে, তার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করা হবে। ইসলামদের মতো সাহসী মানুষদের ত্যাগ যেন বৃথা না যায়, সেটাই এখন এই শহরের কাছে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। দিদারুল ইসলামের পরিবারকে দেশের এবং বিশ্বের প্রতিটি বাংলাদেশির পক্ষ থেকে গভীর সমবেদনা ও শ্রদ্ধা জানানো হোক। তার আত্মত্যাগ অমর হোক। দেশ ও বিদেশের প্রতিটি বাংলাদেশি যেন তার স্মৃতি ও বীরত্বের কথা মনে রাখে এবং তার আদর্শ থেকে অনুপ্রাণিত হয় এই প্রত্যাশাই থাকলো।

গুলিতে নিহত পুলিশ অফিসার দিদারুল ইসলামের মৃত্যুর খবরে বাবার স্ট্রোক

ম্যানহাটানেবন্দুকধারীর এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পুলিশ অফিসার দিদারুল ইসলামের মর্মান্তিক এই ঘটনার খবর শুনে তার বাবা হৃদয়ভাঙা কষ্টে স্ট্রোক করেন বলে জানিয়েছে পরিবার। বর্তমানে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। নিহত দিদারুল ইসলামের চাচাতো ভাই মোহাম্মদ মাইনুল ইসলাম বলেন, ওদের পরিবারের ভরসা ছিল শুধু দিদারুল। খবরটা পাওয়ার পর তার বাবা একদম ভেঙে পড়েন। তখনই স্ট্রোক হয়। দিদারুল ইসলামের স্ত্রী গর্ভবতী এবং অগাস্ট মাসে তাদের তৃতীয় সন্তানের জন্মের সম্ভাব্য তারিখ। মৃত্যুর পরদিন সকালে স্ত্রীর হাসপাতাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল, যেখানে দিদারুল যাওয়ার কথা ছিল। তবে ওই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসেন তার সহকর্মী এক নারী পুলিশ অফিসার। নিউ ইয়র্ক পুলিশ ইউনিয়নের সভাপতি প্যাট্রিক হেনড্রি বলেন, এটি আমাদের শহরের জন্য এক বেদনাদায়ক রাত। আমাদের সাহসী সহকর্মী নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন শহর ও মানুষের নিরাপত্তায়।

শোক মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থেকে নিউইয়র্কের ব্রঙ্কস পর্যন্ত

স্বজনেরা তাঁকে ডাকতেন রতন নামে। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে রতন ছিলেন পরিবারের গর্ব, আশ্রয়, ভবিষ্যৎ। এক ভাই আর দুই বোনের মধ্যে বড় দিদারুল, মাত্র বছরখানেক আগে ছুটি নিয়ে স্ত্রী, সন্তান আর বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে দেশে গিয়েছিলেন। কিন্তু কর্মজীবনের দায়বদ্ধতা তাকে বেশি দিন থাকতে দেয়নি। গত ২৮ জুলাই সোমবার সন্ধ্যায় ভয়াবহ হামলার দিন, ম্যানহাটনের ৩৪৫ পার্ক অ্যাভিনিউয়ের উঁচু ভবনে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এক যুবক- শেইন তামুরা, বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরে, হাতে রাইফেল নিয়ে ঢুকে পড়ে। গুলি ছুড়তে ছুড়তে সে ভবনের লবিতে প্রবেশ করে-সবার আগে তাক করে গুলি চালায় দিদারুল ইসলামের দিকে। তিনি সেখানেই শহীদ হন, সাথে আরও তিনজন সাধারণ মানুষ।

মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগেই দুই বোনের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেছিলেন তিনি। কে জানত, এটাই হবে তাঁর জীবনের শেষ কথা? তাঁর মৃত্যুর খবরে মাটিতে ভেঙে পড়েন বাবা। চোখের সামনে একমাত্র সন্তানের মৃত্যু মেনে নিতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি, দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে নিতে হয়। অন্যদিকে গর্ভবতী স্ত্রীও এই দুঃসংবাদে জ্ঞান হারিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। বাড়ির আশপাশে স্বজন, প্রতিবেশীদের আহাজারিতে কুলাউড়ার আকাশ ভারী হয়ে ওঠেছে।

নিউইয়র্কেও গভর্নর ক্যাথি হোকুল এবং সিটি মেয়র এরিক অ্যাডামস তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। 

২৯ জুলাই মঙ্গলবার সকালে, হাসপাতাল থেকে তাঁর মরদেহ যখন এনওয়াইপিডি পতাকায় মোড়ানো অবস্থায় বের করে আনা হয়, তখন সহকর্মীরা নীরব শ্রদ্ধায় দাঁড়িয়ে সালাম জানান। মুহূর্তটি ছিল হৃদয়বিদারক- একজন সাহসী পুলিশ সদস্যের সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর নিঃশব্দ সাক্ষ্য।

ঘটনাস্থলে তৈরি হয়েছে অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ। হলুদ বেলুনে লেখা, LOVE ONE ANOTHER!!--এই বার্তাই যেন প্রতিধ্বনিত করছে দিদারুলের মতো মানুষদের জন্য, যারা অন্যের সুরক্ষায় নিজের জীবন বিলিয়ে দেন।

এই মৃত্যু দিদারুল ইসলামের পরিবার, পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর সাহস, আত্মত্যাগ ও মানবিকতা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

শেয়ার করুন