১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ০৪:৬:৩৯ পূর্বাহ্ন


‘জুলাই শহীদ দিবস’-এ রাষ্ট্রীয় শোক
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৬-০৭-২০২৫
‘জুলাই শহীদ দিবস’-এ রাষ্ট্রীয় শোক বুক পেতে দেয়া আবু সাঈদ


‘জুলাই শহীদ দিবস’ উপলক্ষে বুধবার ১৬ জুলাই রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। চব্বিশে ফ্যাসিবাদবিরোধী অভ্যুত্থানের শুরুতে ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আবু সাঈদ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে গত ২ জুলাই এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব তানিয়া আফরোজ স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, “সরকার প্রতি বছর ১৬ জুলাই ‘জুলাই শহীদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং উক্ত তারিখ ‘জুলাই শহীদ দিবস’ হিসেবে পালনের নিমিত্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালন সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ২১ অক্টোবর-২০২৪ তারিখের পরিপত্রের ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।”

দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। এ ছাড়া শহীদদের রুহের মাগফিরাতের জন্য বুধবার বাংলাদেশের সব মসজিদে বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হবে। 

অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে তাদের আত্মার শান্তির জন্য বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে।

এক বছর পূর্ণ শহীদ আবু সাঈদ হত্যাকান্ডের 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে বুধবার (১৬ জুলাই)। প্রথম শাহাদাতবার্ষিকীতে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করবেন তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, সহপাঠী ও সহযোদ্ধারাসহ পুরো জাতি। পরিবার ও সহযোদ্ধাদের দাবি, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকালেই আবু সাঈদসহ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত শেষ করতে হবে। এক্ষেত্রে তারা অন্তর্বর্তী সরকার ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ওপর ভরসা রাখছেন।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদ। আন্দোলনের সময় পুলিশের ধাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে আবু সাঈদ বেরোবি’র ১ নম্বর গেইট সংলগ্ন রাস্তায় পুলিশের সামনে দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকেন। ঠিক সেই মুহূর্তে রাস্তায় বিপরীত পাশ থেকে পুলিশ সরাসরি তাঁর ওপর গুলি চালায়। 

আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা দেশজুড়ে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। এই ঘটনায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের গণঅভ্যুত্থানে। দমন-পীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে একপর্যায়ে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া আবু সাঈদ ছয় ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। তাঁর তিনজন বোন রয়েছে। পরিবারের সদস্যরা জানান, আবু সাঈদের মৃত্যুতে পুরো পরিবার যেন নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে।

আবু সাঈদের বাবা মো. মকবুল হোসেন বলেন, আমার প্রিয় সন্তান আবু সাঈদ পুরো পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের জন্য আশার আলো ছিল। আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার এক বছর হয়ে গেল। মনে হচ্ছে গতকালের ঘটনা। তাঁর মৃত্যু আমাদের স্বপ্নগুলো ভেঙে দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শিগগিরই আবু সাঈদসহ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে বলে আশা করেন মকবুল হোসেন। তিনি বলেন, আমি চাই আমার ছেলের খুনিরা এবং সকল জুলাই শহীদদের হত্যাকারীরা শাস্তি পাক।

ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ছেলে হারানোর বেদনা কোনোভাবে সহ্য করা যাচ্ছে না। হত্যাকাণ্ডের বিচার হলে হয়তো কিছুটা স্বস্তি পাবো।

আবু সাঈদের বড় ভাই আবু হোসেন বর্তমান সরকারের মেয়াদে বিচার কাজ সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতির জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

আরেক ভাই রমজান আলী বলেন, আমার ভাই আবু সাঈদ আমাদের বাড়ির আঙিনায় চিরনিদ্রায় শায়িত। ওর কবরের দিকে তাকালেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না।

বোন সুমি খাতুন বলেন, আমরা সাদামাটা জীবনযাপন করতাম। আমাদের খুব কম ছিল, কিন্তু ভাইদের সঙ্গে সবকিছু ভাগাভাগি করে আমরা অনেক সুখী ছিলাম। এখন হয়তো অনেক কিছু আছে, কিন্তু কোনো কিছুতে সুখ নেই। আমি খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। 

বেরোবিতে আন্দোলনের সমন্বয়ক ও সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রহমত আলী বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে অভিযোগ গঠন করেছে ও বিচার কাজ শুরু করেছে। আমরা দ্রুত রায় চাই। এই বিচার এমন একটি দৃষ্টান্ত হোক, যা প্রমাণ করবে আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়।

বেরোবির বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ও আবু সাঈদের সহযোদ্ধা শামসুর রহমান সুমন আশা প্রকাশ করে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে। তিনি বলেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হলে, তা হবে একটি জাতীয় মাইলফলক।

আন্দোলনের সময় আবু সাঈদকে রক্ষা করতে গিয়ে মারাত্মভাবে আহত হন বেরোবির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তৌহিদুল হক সিয়াম। তিনি বলেন, এখনো শরীরে প্রায় ৬০টি স্প্রিন্টার নিয়ে বেঁচে আছি। যার মধ্যে ছয়টি রয়েছে মাথায়। তিনি বলেন, সাঈদ সবসময় অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াত। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকত আলী বলেন, আবু সাঈদ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বিত সদস্য। তাঁর সর্বোচ্চ ত্যাগ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি এনে দিয়েছে। তাঁর হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার শুধু তাঁর পরিবার নয়, জুলাই শহীদদের পরিবার এবং পুরো জাতিকেই শান্তি দেবে। 

মসজিদে মসজিদে দোয়া

জুলাই শহিদ দিবস উপলক্ষ্যে ১৬ জুলাই বুধবার রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে ১৬ জুলাই বাদ যোহর দেশের সকল মসজিদে দোয়া ও মোনাজাত আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল মঙ্গলবার একথা জানানো হয়।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদগণের রূহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করার জন্য দেশের সব মসজিদের খতিব, ইমাম ও মসজিদ কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এ উপলক্ষে বুধবার বাদ যোহর বেলা দেড়টায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।

শেয়ার করুন