বৈষয়িক এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক ডামাডোলে বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিন্তু সংকটপথে। এমনিতেই রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্বের আড়ালে পরাশক্তির প্রক্সি যুদ্ধ, গাজায় পশ্চিমা জোটের প্রণোদনায় ইসরায়েলের গণহত্যার জেরে বিশ্ব যখন টালমাটাল তখন দক্ষিণ এশিয়ায় কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান ভারতের সীমান্ত সংঘর্ষ বিশ্বকে পারমাণবিক যুদ্ধের দুয়ারে উপনীত করেছিল। আপাতত পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের উদ্যোগে যুদ্ধ বিরতি হলেও পরিস্থিতি এখনো বিস্ফোরণ সম্ভবা।
পাক ভারত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হলে তার অবসম্ভাবী প্রতিক্রিয়া হবে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায়। বাংলাদেশ আফগানিস্তান এমনকি চীন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া থেকে পরিত্রাণ পাবে না। এদিকে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারে চলছে জাতিগত সংঘর্ষ। বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন আরাকান এলাকায় সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মি এবং অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী নিজ ভূখণ্ডে গণহত্যার শিকার।
সেখানে মানবিক সাহায্য প্রদানের আড়ালে পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে মানবিক করিডোর সৃষ্টি করতে। তেল গ্যাস খনিজ এবং বনজ সম্পদ সমৃদ্ধ মায়ানমার অঞ্চল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত আছে। ভারত, রাশিয়া ও জাপান মায়ানমার বিষয়ে আগ্রহী। এছাড়া ভূমধ্য সাগর সংলগ্ন অঞ্চলে চীনের বিদ্যমান আধিপত্য খর্ব করার দীর্ঘকালীন অভিলাষ আছে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বের পশ্চিমা শক্তির। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে মানবিক করিডোর প্রদান করা হলে অবসম্ভাবী প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার সমুহ সম্ভাবনা আছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রভাবশালী প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এই অঞ্চলের ওপর প্রভাবশালী দেশ চীন কখনো চাইবে না তাদের স্বার্থবিরোধী কোন কাজে বাংলাদেশের কোন স্থাপনা ব্যাবহৃত হোক। চীন, ভারত এবং একই সঙ্গে রাশিয়ার স্বার্থে আঘাত সৃষ্টির উপক্রম হলে তার তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশ। এমনকি ফেনী থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল বিক্ষুব্ধ সংঘর্ষ সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমুদ্র বন্দরগুলোর পরিচালনায় পশ্চিমা দেশ বা তাদের স্বার্থরক্ষাকারী কোম্পানিগুলোর তোড়জোড় দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশকে নিয়ে গভীর আন্তর্জাতিক রাজনীতি চলছে। দেশে এখন অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত মানবিক করিডোর অথবা বন্দরসমূহ ব্যবস্থাপনার মত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অবশ্যই জাতীয় পর্যায়ে সকল রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মতামত অত্যাবশ্যক। বিশ্ব পরিস্থিতি বলে দেয় সংঘাতপূর্ণ এলাকায় মানবিক করিডোর প্রদান করে কোন দেশ স্বস্তিতে নেই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোন অবস্থায় আঞ্চলিক কোন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার অবস্থানে নেই। এমনিতেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, শান্তি শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকট, জুলাই আগস্ট ২০২৪ হত্যাকান্ড বিচার, পুলিশ বাহিনী পূনর্গঠন, মব জাস্টিস নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বেসামাল অবস্থায় আছে। অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত করার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে নানা দাবি নিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা রটনা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করিডোর প্রদান অথবা বন্দরসমূহ পরিচালনা বিদেশী মালিকানায় দেয়ার মত স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নিলে দেশের শান্তি শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে পড়তে পারে।
রাজপথেও কিন্তু স্বস্তি নেই। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার আন্দোলনে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের আস্ফালন দৃশ্যমান হয়েছে। নারী অধিকার নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সমাজে সংঘাত সৃষ্টির অপপ্রয়াস দৃশ্যমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্দালয় এলাকায় রক্ত ঝরেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু কার্যক্রমে পক্ষপাতের আলামত দেখা গেছে। স্পর্শকাতর সময়ে যখন ইস্পাত দৃঢ় জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য তখন সরকারের হটকারি সিদ্ধান্তে যেন জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট না হয় সেদিকে সবাইকে বিশেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানকে সচেতন থাকতে হবে। বাংলাদেশিরা যুদ্ধ জয়ী জাতি। সঠিক সময়ে আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে অস্তিত্বের লড়াইয়ে লিপ্ত হতে প্রয়োজন শুধু অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। আশা করি জাতীয় স্বার্থ সম্পৃক্ত বিষয়ে হটকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিরত থাকবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ঘোষিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত সরকারের কাছে দেশ পরিচালনা সমর্পন হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। নতুন সরকাকেও জাতীয় স্বার্থে বিভেধ ভুলে সবাইকে নিয়ে এগুতে হবে।