৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:৬:৪৪ পূর্বাহ্ন


যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ নিয়ে বিভক্ত বিচারপতিরা
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২১-০৫-২০২৫
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ নিয়ে বিভক্ত বিচারপতিরা জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব


যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট গত ১৫ মে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবৈধ বা অস্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী অভিবাসীদের সন্তানদের নাগরিকত্ব প্রদানের প্রচলিত অধিকার অস্বীকার করে নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে শুনানি করেছে। শুনানিতে আদালতের বেশির ভাগ বিচারপতি এই আদেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, বিশেষ করে যদি এটি সাময়িকভাবেই কার্যকর থাকে। এমনকি কনজারভেটিভ বিচারপতিরাও নবজাতক সন্তানদের বিষয়ে হাসপাতাল ও স্টেট প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিচারপতি ব্রেট কাভানাফ বিশেষ করে জানতে চেয়েছেন, এই পরিস্থিতিতে হাসপাতাল ও স্টেট প্রশাসন কী করবে।

সুপ্রিম কোর্টের অধিকাংশ বিচারপতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যদি ট্রাম্প প্রশাসন সাময়িক হলেও অবৈধ অভিবাসীদের সন্তানদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করার সুযোগ পায়, তাহলে তা দেশের নাগরিকত্বের ঐতিহ্য ও সংবিধানকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তবে একই সঙ্গে তারা বিচারাধীন দেশের বিভিন্ন স্থানে নিষেধাজ্ঞার পরিধি সীমিত করার উপায়ও খুঁজছেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম দিনেই একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন, যেখানে বলা হয়, যারা অবৈধ বা সাময়িকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে, তাদের সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম হলেও নাগরিকত্ব পাবে না। এই আদেশ ১৮৯৮ সালের সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের পরিপন্থী, যেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ১৪তম সংশোধনীর নাগরিকত্ব ধারা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া সবাই নাগরিক শুধু কিছু সংকর্ঢু ব্যতিক্রম ছাড়া। এই আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র, অভিবাসী ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো দ্রুত মামলা করেন এবং নিম্ন আদালত দেশজুড়ে স্থগিতাদেশ জারি করে। এখন সুপ্রিম কোর্টে মূল বিতর্ক হচ্ছে, এই স্থগিতাদেশের পরিধি কতটুকু হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সলিসিটার জেনারেল ডি জন সাওয়ার আদালতকে জানান, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু থেকে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ৫০টি স্টেটের সর্বত্র কার্যকর নিষেধাজ্ঞা বা নেশনওয়াইড ইনজাংকশন জারি হয়েছে, যা সরকারের জন্য বড় বাধা। তিনি দাবি করেন, অনেক বিচারক বেআইনিভাবে এই ক্ষমতা ব্যবহার করছেন, যা প্রশাসনের কাজ থামিয়ে দিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের যুক্তি হলো, এই নিষেধাজ্ঞাগুলো শুধু মামলাকারীদের জন্য হওয়া উচিত, গোটা দেশজুড়ে নয়। তাই তারা সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করেছে এসব সর্বজনীন নিষেধাজ্ঞার পরিধি সীমিত করার জন্য।

বিচারপতি এলেনা কাগান বলেন, ‘জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব’ ইস্যুতে প্রতিটি নিম্ন আদালতই সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি সরকার এই আপিল জিতে যায়, তাহলে যারা আর্থিক কারণে মামলা করতে পারবে না, তারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হবে। অন্যদিকে বিচারপতি কেটানজি ব্রাউন জ্যাকসন এই পরিস্থিতিকে ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’ কৌশল হিসেবে অভিহিত করেছেন, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তিকে আলাদা আলাদা মামলা করতে হবে সরকারের অবৈধ কাজ বন্ধ করার জন্য। অন্যদিকে বিচারপতি সোনিয়া সোটোমায়োর উদ্বেগ, যদি নিষেধাজ্ঞাগুলো সীমিত হয়, তাহলে আইন প্রয়োগে বিভ্রান্তিকর এবং অনিয়মিত নিয়মাবলি তৈরি হবে। এর ফলে অনেক শিশু ‘রাষ্ট্রহীন’ হয়ে পড়তে পারে। কারণ তারা আমেরিকার নাগরিকত্ব পাবে না এবং তাদের পিতামাতার দেশেও নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ থাকবে না।

তবে কিছু রক্ষণশীল বিচারপতি নেশনওয়াইড ইনজাংকশন কমানোর পক্ষে। তারা জানতে চেয়েছেন, নিষেধাজ্ঞাগুলো সীমিত হলে এর বাস্তব প্রভাব কী হবে এবং সুপ্রিম কোর্ট কত দ্রুত চূড়ান্ত রায় দিতে পারবে। বিচারপতি ব্রেট কাভানাফ প্রশ্ন করেছেন, নবজাতক শিশুর ক্ষেত্রে হাসপাতাল বা রাজ্য প্রশাসন কী করবে। সলিসিটার জেনারেল জানান, হাসপাতাল বা প্রশাসনে তাত্ক্ষডুক কোনো পরিবর্তন আসবে না, তবে সরকার হয়তো ডকুমেন্টেশনে নাগরিকত্ব চিহ্ননির্দেশে নতুন নিয়ম তৈরি করতে পারে।

২২টি স্টেটের পক্ষে মামলা দায়েরকারী নিউজার্সির সলিসিটার জেনারেল জেরেমি ফেইগেনবাউম আদালতকে সতর্ক করে বলেছেন যে ডেলাওয়্যার নদী পারাপারের সময় জন্ম নেওয়া শিশুর নাগরিকত্ব নিয়ম অনির্ভরযোগ্য হয়ে যাবে ক্যামডেনে জন্মানো শিশু নাগরিক হবে, আর পাশের ফিলাডেলফিয়ায় জন্মানো শিশু নাগরিক হবে না, যা আইন ভঙ্গ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে। আদালতের কিছু বিচারপতি প্রস্তাব দিয়েছেন, দেশজুড়ে নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে ‘ক্লাস অ্যাকশন’ মামলা চালু করা যেতে পারে, যেখানে একটি প্রতিনিধি গোষ্ঠী বৃহৎ জনগোষ্ঠীর পক্ষে রায় পেতে পারবে। এতে দ্রুততা ও সমানতা নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তবে সরকারের আইনজীবী সাওয়ার বলেছেন, সরকার এই ধরনের মামলাও প্রতিহত করতে পারে।

সুপ্রিম কোর্ট সাধারণত এমন জরুরি আপিল শুনানি খুব কম করে। এই মামলায় তারা মূলত আদেশের আপদকালীন কার্যকারিতা ও তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রেসিডেন্টের অনুরোধে শুনানি করেছেন।

এই মামলার চূড়ান্ত রায় ২০২৫ সালের জুন মাসের মধ্যে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে যদি আদালত সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে নবজাতক শিশুদের নাগরিকত্বের নিয়মে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, যা একটি বড় সাংবিধানিক সংকটের জন্ম দিতে পারে। এই মামলার আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব শুধুই একটি আইনি ধারা নয়-এটি দেশটির সংবিধানিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার এবং জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ এবং এর বিরুদ্ধে হওয়া আইনি প্রতিক্রিয়া নাগরিকত্বের প্রশ্নে দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত নীতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী সমাজ ও সামাজিক ভারসাম্যের ওপর সুদূরপ্রসারি প্রভাব ফেলতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের এ রায় শুধু ট্রাম্প প্রশাসনের ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করবে না, বরং সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর ব্যাখ্যার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, যা ভবিষ্যতে নাগরিকত্ব, মানবাধিকার এবং ফেডারেল স্টেট সম্পর্কের ক্ষেত্রেও পথনির্দেশক হয়ে থাকবে। অতএব এই মামলার রায় হবে একটি সন্ধিক্ষণের সিদ্ধান্ত, যা যুক্তরাষ্ট্রের আইন ও মূল্যবোধের দীর্ঘমেয়াদি দিকনির্দেশক ঠিক করবে।

শেয়ার করুন