১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ০৪:১২:২৩ পূর্বাহ্ন


নতুন বাংলাদেশে বদলায়নি অনেক কিছু
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-০২-২০২৫
নতুন বাংলাদেশে বদলায়নি অনেক কিছু জুলাই-আগস্ট বিপ্লব


অনেক রক্ত, অনেক তাজা প্রাণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অনেক ক্ষেত্রে সংস্কার-পরিবর্তনের প্রতিশ্রুত দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারপ্রধান শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছয় মাস পেরিয়ে সাত মাস হতে চলেছে সরকারের কার্যকাল। সড়কে যানজট, সামান্য বৃষ্টি হলেই জলজট, বাতাসে বিষাক্ত দুষণ, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য সবই চলছে। পরিবর্তন ঘটেছে প্রকার এবং পদ্ধতির। 

বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কিছুটা উন্নয়ন হলেও এখনো মিডিয়া স্বাধীনভাবে সরকার বা সরকার ঘনিষ্ঠ শক্তিগুলোর কার্যক্রম নিয়ে মুক্তভাবে বিশ্লেষণ করতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। সৃজনশীল কৃষক সমাজ বরাবরের মতো ক্ষেতে সোনার ফসল ফলালেও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বাজারে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। মিল-কারখানা, অফিস-আদালত থেকে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে। অনেক ছোট, মাঝারি, বড় শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। জ্বালানি-বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলার নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হলেও অনাগত সময়ে (মার্চ থেকে অক্টবর) তীব্র বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকটের আশক্সকা করা হচ্ছে। পুলিশ এখনো পূর্ণমাত্রায় সক্রিয় হয়নি। মব লিনচিং, দেশজুড়ে ভাঙচুর, অগ্নিকাণ্ড নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় মশার উপদ্রব একইভাবে জনজীবন অতিষ্ঠ করে রেখেছে। গাজীপুর থেকে ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মাণাধীন বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কবে শেষ হবে কেউ জানে না। 

বিগত সরকারের ১৬ বছরের প্রায় পুরোটা সময় ধরেই এ রাস্তাটুকু নিয়ে কাটাছেঁড়া ও মেরামত, উন্নয়নের কাজ নিরবচ্ছিন্ন চলেছে। কিন্তু এর শেষ হয়নি। প্রায়ই গাজীপুরের মানুষদের আফসোসের সুরে বলতে শোনা যেত, যেহেতু আওয়ামী সরকার ভীষণ ’৪১-এর গল্প শোনাচ্ছেন। আমাদের মনে হয়, এ প্রজেক্ট ওই ভীষণের আওতায়। এটা পরিপূর্ণ শেষ হতে ২০৪১ সাল পর্যন্তই অপেক্ষা করতে হবে। বাস্তবেও এখন তাই মনে হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার এসে মাঝে যে বিআরটিএ একটা লেন করেছিল, সেটা ছেড়ে দিয়েছে। কিছুটা স্বস্তি। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়িত কবে হবে কেউ জানেন না। আওয়ামী লীগ সরকারই কয়েক দফা সময় বাড়িয়েছে। বাজেট একের পর এক বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু যা আছে তাই। কাজের অগ্রগতি নেই। এ সরকারের সময় ওই কাজ করতেও দেখা যাচ্ছে না। এর শেষ কোথায় কে জানে। 

 একইভাবে মেট্রোরেল কবে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে জানা নেই কারো, বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম পর্যন্ত নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে নির্মাণকাজ কাওরান বাজার ছাড়িয়ে এগোয়নি খুব একটা। ঢাকা এখনো দুনিয়ার অন্যতম শীর্ষ দূষিত শহর। শুনেছি, ঢাকায় এখন আর রাতের পথ চলাচল নিরাপদ নয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে অজানা ভয়-আতঙ্ক।

অবশ্যই বলবো ব্যাংক থেকে অর্থ লুট, বিদেশে পাচার স্থগিত রয়েছে। সরকারি অফিস-আদালতে হয়রানি কমেছে। তবে শিল্প-কারখানাসমূহের অনেক মালিক বিশেষত আওয়ামী লীগ ঘরানার শিল্পপতি বিদেশে পালিয়ে অথবা দেশে লুকিয়ে থাকায় শিল্প-কারখানাগুলোতে অরাজকতা বিরাজ করছে। শ্রমিক-কর্মচারীরা বেতন-ভাতা নিয়মিত পাচ্ছেন না। জ্বালানি-বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিশ্চিত থাকায় শিল্প উৎপাদন দারুণভাবে বিঘ্ন্নিত হচ্ছে। আমদানি রফতানিতে ক্রমাগত অবনমন ঘটায় বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় অনেকটা থমকে আছে।

এবার আসি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূলকথা নিয়ে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ জীবন কোথায় বৈষম্যের অবসান হয়েছে। দেশজুড়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো শুভ পরিবর্তন আসেনি। শিক্ষার মান নিম্নমুখী আগের মতোই। পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়ে সড়কে আন্দোলন করতে হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসেনি। দেখলাম, দেশবরেণ্য, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নিউরো বিশেষজ্ঞ ড. কাজী দীন মোহাম্মদকে পদত্যাগে বাধা করা হলো। জুলাই আগস্টের সফল আন্দোলন সময়ের আহত বীরদের সড়কে আন্দোলন করতে হচ্ছে। কথায় কথায় নানা স্তরের মানুষ নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে সড়কে অবস্থান নেওয়ায় জনজীবনে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে অহরহ। সেনানিবাসগুলো দেখলে মনে হবে ভিন্ন দেশ।

কোনো সরকার বিজেবি সদর দফতর, সেনা সদর দফতর ঢাকার কেন্দ্রস্থান থেকে নগরের বাইরে স্থানান্তর করার উদ্যোগ গ্রহণ করার সাহসী উদ্যোগ নিতে পারেনি। ঢাকা নগর ঘিরে চারটি নদী (বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ) দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। নানা সময়ে ঢাকার বুকচিরে একসময়ে বহমান খালগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করা হলেও অর্জন সীমিত। ঢাকা মহানগরীকে উত্তর ও দক্ষিণ দুটিভাবে ভাগ করা হলেও নাগরিক জীবনে স্বস্তি আসেনি। পরিবেশ উপদেষ্টা পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ, নগরে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ কমানোর উদ্যোগ নিয়ে নানা আশার আলো দেখালেও অর্জন সামান্য। তবে সেন্ট মার্টিন প্রবাল দ্বীপ বাঁচানোর জন্য মশা মারতে কামান দাগানো হয়েছে।

এতো শত সমস্যা-সংকট কিন্তু সবার জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বীকার করি বহু বছরের পুঞ্জীভূত সব সমস্যা মাত্র ছয় মাস কেন, দুই তিন বছরেও পরিবর্তন সম্ভব নয়। বিশেষত চাকরি হারানোর সংকটে থাকা সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের প্রায় নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে সংস্কার দূরে থাক নিয়মিত কার্যক্রম স্থবির হয়ে যাচ্ছে। দুই সপ্তাহ বাংলাদেশে অবস্থান সময়ে নানা শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে আলোচনার চেষ্টা করেছি। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বাঘাবাড়ী এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি, গ্যাস-বিদ্যুৎ সাপ্লাই চেইন উন্নয়ন নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করেছি, মেগাপ্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা করেছি। আশান্বিত হওয়া দূরের কথা উদ্বিগ্ন হয়েছি। ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন না হয়ে আমলানির্ভর নতুন বাংলাদেশে বদলায়নি অনেক কিছু।

শেয়ার করুন