১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ০২:০০:৪৬ পূর্বাহ্ন


গ্রীষ্মে তীব্র লোডশেডিংয়ের শঙ্কা
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০১-২০২৫
গ্রীষ্মে তীব্র লোডশেডিংয়ের শঙ্কা জমিতে সেচ দেওয়ার দৃশ্য


বাংলাদেশের প্রকৃতিতে এখন শীতকাল। জ্বালানি বিদ্যুৎ চাহিদা তুলনামূলক অনেক কম থাকায় এখনো পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে। সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা ৯৫০০-১১০০ মেগাওয়াট। জানুয়ারি পেরিয়ে ফেব্রুয়ারি এলেই শুরু হবে নিবিড় সেচ মৌসুম। বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ১৩০০-১৪০০ মেগাওয়াট। মার্চের শুরুতে রোজা শুরু বিদ্যুৎ চাহিদা আরো বেড়ে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এপ্রিল থেকে আগস্ট পাঁচ মাসে বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে ১৭৫০০-১৮০০০ মেগাওয়াট হতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের কিন্তু গ্রিড বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ দশমিক ৮২০ মেগাওয়াট। উৎপাদন ক্ষমতার বিচারে সর্বোচ্চ চাহিদা মেটানো কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু প্রধান সমস্যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ। নিজস্ব প্রমাণিত গ্যাসসম্পদ নিঃশ্বেষ হয়ে আসছে। সুদূর ভবিষ্যতে গ্যাস উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনা সীমিত। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কয়লা, এলএনজি, তরল জ্বালানি আমদানি, বিদ্যুৎ আমদানি পর্যাপ্ত পরিমাণে করার মতো প্রয়োজনীয় ডলার এবং টাকা নেই। সরকারি বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি কোম্পানিগুলো বিপুল বকেয়ার দায় মেটাতে পারছে না। এমতাবস্থায় আসন্ন গ্রীষ্মকালে তীব্র বিদ্যুৎ লোডশেডিং জনজীবন বিপর্যস্ত করবে বলে সবার ধারণা।

আগেই বলেছি, এখন গ্রিড সংযুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ দশমিক ৮২০ মেগাওয়াট। ৩০ এপ্রিল ২০২৪ সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। ওইদিন চাহিদা বেশি থাকায় লোডশেডিং হয়েছিল সীমিত পরিমাণ। পিডিবি এবং পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায় প্রয়োজনীয় প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এখন ১৪৪টি। ৫২টি বেজ লোড প্লান্টের উৎপাদন ক্ষমতা ১৯ দশমিক ২২৯ মেগাওয়াট আর ৯২টি পিকিং প্লানের উৎপাদন ক্ষমতা ৮৫ হাজার ৫ মেগাওয়াট। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১২ হাজার ৪১৩ মেগাওয়াট যা মোট ক্ষমতার ৪৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ২৪২০ এমএমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ প্রয়োজন। বর্তমান বাস্তবতায় সেটি কল্পনার অতীত। এবারের গ্রীষ্মের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর জন্য বিপিডিবি পেট্রোবাংলার কাছে ১৫০০-১৬০০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহের অনুরোধ করেছে। 

২০২৪ গ্রীষ্মকালে পেট্রোবাংলা সর্বোচ্চ ১১৫০-১২০০ এমএমসিএফডি গ্যাস অরবরাহ করেছিল। এবার কিন্তু দেশের গ্যাস উৎপাদন কমে গেছে। দুটি এফেসারু ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ১১০০ মিলিয়ন আর এলএনজি সরবরাহকারীদের বকেয়া বিল মিটিয়ে পেট্রোবাংলার কাছে এলএনজি আমদানির মতো প্রয়োজনীয় বিদেহী মুদ্রা থাকে। তবে পেট্রোবাংলার পক্ষে হয়তো সর্বোচ্চ ১২০০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে বিদ্যুতের জন্য। এই গ্যাস দিয়ে ৬০০০-৬৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। বিপিডিবিকে নিশ্চিত করতে হবে জ্বালানি দক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে যেন প্রাধিকার ভিত্তিতে উৎপাদনে রাখা যায়। সবাই জানে মেঘনাঘাট অঞ্চলে সম্প্রতি জাপানিজ কোম্পানি জারা, স্থানীয় কোম্পানি সামিট পাওয়ার এবং ইউনিক গ্রুপের তিনটি অত্যাধুনিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত আছে। এগুলোর সমন্বিত উৎপাদন ক্ষমতা ১৮০০ মেগাওয়াট। এই অঞ্চলে গ্যাস সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য নির্মাণাধীন বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্র থেকে হরিপুর, সিদ্ধিরগঞ্জ পর্যন্ত নির্মাণাধীন ৪২ ইঞ্চি বাসের গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন নির্মাণকাজ মার্চ ২০২৫ শেষ হবে। তবে মেঘনাঘাট থেকে বিদ্যুৎ এভাকুয়েশন সীমাবদ্ধতা থাকায় ১ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ গ্রিডে সঞ্চালন করা যাবে না। এমতাবস্থায় বিপিডিবির পক্ষে আসন্ন গ্রীষ্মকালে ৬ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি গ্যাসবদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে না।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান বিকল্প উৎস কয়লা। নিজেদের একমাত্র বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির মুখে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১২৫-২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি উপকূলে স্থাপিত পায়েরা, মাতারবাড়ী, বাঁশখালী এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে কয়লা আমদানি এবং সরবরাহ নিশ্চিত হলে এবং এর পাশাপাশি ভারতের আদানি গ্রুপের ঝাড়খণ্ডের কোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ রফতানিতে বিঘ্ন না ঘটলে নানা সংকট মিটিয়ে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যেতে পারে। আছে পটুয়াখালীতে পায়রা এবং আরপিসিএল-নরিংকো বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা পরিবহন সংকট, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারিগরি ত্রুটিজনিত কারণে অহরহ উৎপাদন বিভ্রাট এবং বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়না পরিশোধ সমস্যা।

যাই হোক, গ্যাস-কয়লা মিলিয়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার পরও ঘাটতি থাকবে ৬ হাজার মেগাওয়াট, যা বিদ্যুৎ আমদানি এবং ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সামাল দিতে হবে। ভারত থেকে ভেড়ামারা এবং কুমিল্লা সংযুক্তি দিয়ে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট আমদানি সম্ভব। কিন্তু এখানেও অনেক বকেয়া রয়েছে। ধরে নিলাম ১ হাজার মেগাওয়াট আমদানি হলো। তার পরেও পিক চাহিদা মেটাতে ফার্নেস অয়েল প্লান্টসমূহ থেকে ৪৫০০-৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন পড়বে। উৎপাদন ক্ষমতা ৫ হাজার ৮৮৫ মেগাওয়াট। প্রাইভেট সেক্টর প্লানগুলোর ক্ষমতা ৪ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। কিন্তু সমস্যা হলো সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রয় বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকা পাওনা। প্লান্ট মালিকরা নিজেরা ফার্নেস অয়েল কিনে প্লান্ট চালায়। মালিকরা বিপিডিবিকে জানিয়েছে, ১০ দিনের মধ্যে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পরিশোধ করা না হলে, তাদের পক্ষে এলসি খুলে ফার্নেস অয়েল আমদানি করে মার্চ মাসের মধ্যে প্লান্টগুলো চালু করা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে অর্থ বিভাগ টাকা ছাড় না করায় বিপিডিবির পক্ষেও ১০ দিনের মধ্যে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় মার্চ মাস থেকেই ২০০০-৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি হতে পারে। এমতাবস্থায় একমাত্র উপায় পরিকল্পিত উপায়ে লোডশেডিং এবং বিদ্যুৎ-জ্বালানি ব্যবহারে কৃচ্ছ্রসাধন। দেশবাসীকে আসন্ন গ্রীষ্মকালে নিয়মিত লোডশেডিং ঝক্কি পোহাতে হবে।

শেয়ার করুন