অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ এবং স্টেট প্রশাসনকে ফেডারেল অভিবাসন আইন প্রয়োগের ক্ষমতা দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে বিরল দ্বিদলীয় একতা প্রদর্শন করে গত ৯ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ৮৪-৯ ভোটে লেকেন রাইলি অ্যাক্ট (অপরাধ করলেই ডিপোর্ট) পাস হয়েছে। আইনটি এখন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে। যিনি আগামী ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। লেকেন রাইলি অ্যাক্ট কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান নিয়ে এসেছে। প্রথমত, এই আইনটি চুরি বা অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত অবৈধ অভিবাসীদের বাধ্যতামূলকভাবে আটক করার বিধান রেখেছে। দ্বিতীয়ত, স্টেটগুলোকে ফেডারেল সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার দেওয়া হয়েছে, যদি তারা অভিবাসন আইন প্রয়োগে ব্যর্থ হয়। এই নতুন বিধানগুলো অভিবাসন আইন প্রয়োগে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা বাড়াতে এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। এই বিলটি অভিবাসন নীতিতে কড়া পরিবর্তন আনবে, বিশেষ করে অপরাধমূলক কার্যকলাপে যুক্ত অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। এতে বলা হয়েছে, যেসব অবৈধ অভিবাসী চুরি, ডাকাতি বা দোকানে চুরির মতো অপরাধে জড়িত থাকবেন, তাদের বিচারের সুযোগ না দিয়ে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হবে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন এসব অহিংসাত্মক অপরাধে অভিযুক্তদের দ্রুত হেফাজতে নেয় এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
এই আইনটি জর্জিয়ার একটি নার্সিং কলেজের ছাত্রী লেকেন রাইলির নামে নামকরণ করা হয়েছে, যিনি ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি অবৈধ অভিবাসীর হাতে নির্মমভাবে খুন হন। তার মৃত্যু দেশের অভিবাসন নীতি এবং জননিরাপত্তা নিয়ে জাতীয় আলোচনা শুরু করে, যা এই আইনটির প্রণয়নে অনুপ্রাণিত করেছে। এই আইনের পক্ষে শক্তিশালী দ্বিদলীয় সমর্থন দেখা গেছে, যা পার্টির সীমা ছাড়িয়ে একযোগে পাস হয়েছে। সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা চাক শুমার (ডি-এনওয়াই) বিলটির পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন, যদিও কিছু সংশোধনী প্রস্তাব করেছেন। তবে, ৯ জন সিনেটর এই বিলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন, যাদের মধ্যে কোরি বুকার (ডি-এনজে), মাইজি হিরোনো (ডি-হাওয়াই), এবং বার্নি স্যান্ডার্স (আই-ভিটি) রয়েছেন। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে এই আইনটি আটক কেন্দ্রগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং ফেডারেল সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্য বিঘ্নিত করতে পারে।
এই বিলের পাস হওয়ার পর ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে অভিবাসন নীতিতে কিছু পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। পেনসিলভানিয়া সিনেটর জন ফেটারম্যান ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে এই বিষয়ে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, যা তার দলের মধ্যে জননিরাপত্তা নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচক হতে পারে। এই আইনটি যদি স্বাক্ষরিত হয়, তবে লেকেন রাইলি অ্যাক্ট ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম আইনগুলোর একটি হতে পারে এবং এটি তার অভিবাসন নীতি এজেন্ডার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হবে। আইনটির সমর্থকরা এটিকে মার্কিন জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন। যতই বিতর্ক চলুক, লেকেন রাইলি অ্যাক্ট মার্কিন অভিবাসন নীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে এর নিরাপত্তা ও শাসন ব্যবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলবে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিতে বিপ্লব বা বিভ্রান্তি?
যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে পাশ হওয়া নতুন আইন লেকেন রাইলি আইন শিগগিরই এর কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে পারে। গত সপ্তাহে হাউস ও সিনেটে পাস হওয়া এই বিলটির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হতে পারে। এ আইনটি অভিবাসন নীতি নিয়ে রাষ্ট্রীয় অ্যাটর্নি জেনারেলদের ভেটো পাওয়ার ক্ষমতা প্রদান করবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থায় একটি বৃহৎ পরিবর্তন ঘটাবে।
লেকেন রাইলি আইনটির প্রস্তাবিত কিছু পরিবর্তন দীর্ঘদিনের অভিবাসন নীতির প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। মূলত, এই বিলটি রাজ্য অ্যাটর্নি জেনারেলদের বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করবে, যা তাদের ফেডারেল অভিবাসন নীতিতে ভেটো দেওয়ার অধিকার দেবে। এর ফলে টেক্সাসের অ্যাটর্নি জেনারেল কেন প্যাক্সটনের মতো ব্যক্তিরা কেন্দ্রীয় সরকারের অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন। এই আইনটি স্টেট আদালতগুলোকে এমন ক্ষমতা দেবে, যাতে তারা নির্দিষ্ট দেশ থেকে ভিসা বন্ধ করার আদেশ দিতে পারে বা কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতি ফেডারেল সরকারের অধীনে রয়েছে এবং এটি বৈদেশিক সম্পর্কসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইনকেও প্রভাবিত করে। তবে এই আইন কার্যকর হলে, স্টেট সরকারগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের অভিবাসন নীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ পেতে পারে। এর ফলে একটি স্টেটের অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতের মাধ্যমে সরকারের অভিবাসন নীতিতে চাপ সৃষ্টি করতে পারবে। এতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপরও বিপুল প্রভাব পড়তে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো দেশ তাদের নাগরিকদের ফেরত নেওয়ার জন্য অস্বীকার করে, তবে সেই দেশ থেকে সব ধরনের ভিসা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে স্টেট গভর্নমেন্ট।
বিলটি কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্কও বিপদে পড়তে পারে। দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্তের ফলে আন্তর্জাতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। চীন, ভারত, ভেনেজুয়েলা এবং পাকিস্তানের মতো দেশগুলো, যেগুলো অভিবাসীদের ফেরত নিতে অস্বীকার করে, তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরো খারাপ হতে পারে।
এই বিলটি যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে। স্টেট গভর্নমেন্টগুলোকে ক্ষমতা দেওয়া হবে, যাতে তারা ফেডারেল সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। এমনকি তাদের ক্ষতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না থাকলেও তারা মামলা করতে পারবে। এর ফলে ফেডারেল বিচারকরা অভিবাসন নীতির ব্যাপারে রাজ্য গভর্নমেন্টের স্বার্থ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবেন, যা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিরোধ করা হচ্ছিল।
লেকেন রাইলি আইনটির সমর্থনকারী পক্ষের মতে, এটি দেশটির নিরাপত্তা এবং অভিবাসন ব্যবস্থার যথাযথ বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। কিন্তু ইমিগ্র্যান্ট অধিকার গ্রুপগুলো বলছে, এই আইনটি ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা সীমিত করবে এবং অভিবাসন ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। অনেকেই মনে করছেন, এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে ঝুঁকিতে ফেলবে এবং অভিবাসীদের প্রতি অনৈতিক আচরণকে উৎসাহিত করবে। লেকেন রাইলি আইন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।