১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ৬:০১:৩৪ পূর্বাহ্ন


নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে পরিবর্তন চোখে পড়ছে না
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-০১-২০২৫
নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে পরিবর্তন চোখে পড়ছে না মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখছেন সুলতানা কামাল


মানবাধিকার কর্মী অ্যাড. সুলতানা কামাল বলেন, নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে গত ষাট বছর ধরে আমার একই কথাই বলে যাচ্ছি। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। নারীরা ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। এই নিরাপত্তহীনতার বোধ তৈরি হয়েছে আমাদের পরিবারের ভেতরে। কাজেই ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের সামাজিক-পারিবারিক সংস্কৃতির উপর জোর দিতে হবে। একটি সুস্থ, সামাজিক , সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। গত ২৯ ডিসেম্বর সোমবার তিনি এক মতবিনিময়ে একথা বলেন।

জাতীয় কমিটির সচিবালয় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তন, ১০/বি/১, সেগুনবাগিচা, ঢাকাতে নারী ও কন্যা নির্যাতন প্রতিরোধে বর্তমান করণীয় বিষয়ে নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সম্মানিত সদস্যবৃন্দের সাথে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। বক্তব্য রাখেন নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।

সভায় নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সদস্যবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ও বক্তব্য রাখেন- লেখক ও গবেষক মফিদুল হক, সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. এসএমএ সবুর, মানবাধিকার কর্মী অ্যাড. সুলতানা কামাল, মুক্তিযোদ্ধা ও তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মাহবুব জামান, সমাজকর্মী ছবি বিশ্বাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন ও জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার, র্ব্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং এর ডীন ড. আরসাদ চৌধুরী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. মো. আমিনুল ইসলাম প্রমুখ।

সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে এই কমিটি গঠিত হয়। তখন থেকেই প্রচারমূলক ও সচেতনতামূলক বিভিন্নমুখী উদ্যোগ ও আইন সংস্কার নেটওয়ার্কসহ বহুমুখী কর্মকান্ডের পরও নারী ও কন্যার প্রতি যৌন হয়রানি বন্ধে কার্যকরি ভূমিকা দৃশ্যমান হচ্ছে না। নারী ও কন্যা নির্যাতন অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখান থেকে উত্তরণের পথ এই সভায় আলোচনা হবে। সভা থেকে প্রাপ্ত সুপারিশগুলো থেকে আলোচনার মাধ্যমে কর্মসূচি নির্ধারণ করা হবে।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. এসএমএ সবুর বলেন, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে যদি অপরাধ হয় এবং তার প্রতিকার না হয় তাহলে তা হয় বেশি ভয়ঙ্কর এবং নিরাময় অযোগ্য। গত কয়েক মাসে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার অনেক ঘটনা ঘটেছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিভিন্ন গণসংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে যুক্ত করে বৃহত্তর জাতীয় প্লাটফরম গড়ে তুলতে হবে বলে উল্লেখ করেন।

লেখক ও গবেষক মফিদুল হক বলেন, এখন তরুণরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের নতুন চিন্তা, নতুন ধারা। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। নারী ও কন্যা নির্যাতনের যে ডাটা পাওয়া যায় সেগুলো কোন প্রবণতা তুলে ধরে তা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। দেখা যায়, ধর্ষণের এক-তৃতীয়াংশ হয় দলবদ্ধ ধর্ষণ। নারী সংগঠনগুলো নারী ও কন্যা নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে। তবে এসব সংগঠনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। অনেক দিন ধরেই সরকারি পাঠ্যপুস্তকে নারী-পুরুষের সমতার কথা বলা হচ্ছে। পাশাপাশি, স্কুলগুলোতে কিশোরী ক্লাব আছে। নারী শিক্ষকরা এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানিয়া হক বলেন, পরিবারিক পরিসরে নারীর প্রতি যে সহিংসতাগুলো হচ্ছে সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতার অনেক জায়গা এখনো চিহ্নিত করা হয়নি যেমন- কম্প্রিহেনসিভ ফ্যামিলি প্ল্যানিং, ফ্যামিলি বাজেট-যেখানে কন্যাসন্তানের জন্য সমান বরাদ্দ রাখা, সন্তান জন্মের সময় লেবার রুমে বাবার উপস্থিত থাকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঠিক ব্যবহার, সঠিক সেক্স এডুকেশন, কস্ট অব ভায়োলেন্স- যে অপরাধ করে তাকে কত মূল্য দিতে হয়, লিঙ্গ-নিরপেক্ষ আইন ইত্যাদি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চন্দ্রনাথ পোদ্দার বলেন, নারীকে সমাজে যতদিন মানুষ হিসেবে গণ্য করা না হবে, তত দিন নারীর প্রতি সহিংসতা কমবে না। সে লক্ষ্যে নারী প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ কার্যক্রমে পুরুষকে অধিকহারে সম্পৃক্ত করতে হবে। বিগত কয়েক মাসে কয়েক শ’ নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এ দেশে ধর্ম-বর্ণ,নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, বৈষম্য দূর করতে হবে। গণতান্ত্রিক, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন দেশ গড়তে হবে।

সভায় উপস্থিত নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির অন্যান্য সদস্যবৃন্দ বলেন, পুরো সমাজেই নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। নারী ও কন্যা নির্যাতনের ঘটনা ঘটে যাবার পর শুধু বিচার করা নয়, বরং ঘটনা ঘটার আগে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করার লক্ষ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রোগ্রাম করতে হবে। বর্তমানে শিশু নির্যাতন বেশি হচ্ছে। আবার শিশু ধর্ষণের ক্ষেত্রে মামলা হয় কম কারণ এই শিশুকে বড় হলে বিয়ে দিতে হবে এই ভয় কাজ করে। পাশাপাশি, এসব ক্ষেত্রে সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করা হয়। কাজেই গ্রামাঞ্চলে যারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তারা কতটুকু লিগ্যাল এইড পাচ্ছে সেটাও দেখতে হবে। সাইবার ক্রাইমের শিকার মেয়েরা সাইবার ক্রাইম ইউনিটে যেতে চায় না, ভয় পায় অথবা এ সম্পর্কে জানে না। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া নারীর প্রতি সহিংসতা কমবে না। প্রযুক্তি নারীর জন্য একদিকে যেমন আশীর্বাদ, অন্যদিকে এটি অভিশাপও বটে। প্রযুক্তিকে নিজেদের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। এজন্য নারী ও কন্যা নির্যাতনের বিভিন্ন ডেটা ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রবণতা চিহ্নিত করতে হবে ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

উক্ত মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ডা. মাখদুমা নার্গিস রত্না, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম ও অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, সম্পাদকমন্ডলী, নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সদস্যবৃন্দ, কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

সভা সঞ্চালনা করেন নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড সম্পাদক রেখা সাহা।

শেয়ার করুন