৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৮:০৭:৩১ অপরাহ্ন


বাংলাদেশকে বন্ধুহীন ভাবা ভারতের ভুল হবে
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-১২-২০২৪
বাংলাদেশকে বন্ধুহীন ভাবা ভারতের ভুল হবে বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় পতাকা


দক্ষিণ এশিয়া, তথা বিশ্বের অন্যতম প্রধান উন্নয়নশীল দেশ ভারতের সঙ্গে একে একে প্রতিটি প্রতিবেশী দেশের দিপাক্ষিক সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে নানা বিষয়ে মতবিরোধ সৃষ্টির পর একমাত্র বাংলাদেশের সঙ্গে সুস্পর্ক ছিল। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই সম্পর্কেও ভাটা পড়েছে। ভারত সমর্থিত পতিত আওয়ামী লীগ সরকারপ্রধান ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। 

জুলাই-আগস্ট ২০২৪ নির্দয় হত্যাকাণ্ড, ২০০৯-২০২৪ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সীমাহীন দুর্নীতি, অর্থপাচার, সর্বস্তরে বৈষম্যের কারণে সাধারণ মানুষের মনে তীব্র বিক্ষোভ। এই সময়ে ভারতের কিছু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক নেতা, মিডিয়া বাংলাদেশে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর অন্যায়-অত্যাচারের কল্পকাহিনি প্রচার করে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বিষিয়ে তুলেছে। কলকাতা, আগরতলা ও দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশন আক্রমণ করা হয়েছে, বাংলাদেশের পতাকা পোড়ানো হয়েছে, কয়েকটি সীমান্ত পথে বাণিজ্য স্থগিত করা হয়েছে, কিছু প্রিন্ট মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্রমাগত উসকানি দেওয়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার। 

বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ তীব্র ক্ষোভে ফুঁসে উঠলেও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সাধারণ ভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় আছে। বারবার বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, সরকার পরিবর্তনের পর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় কিছু রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক ঘটনা ঘটলেও এগুলো অধিকাংশ সাম্প্রদায়িক ঘটনা নয়। আর যা কিছু হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে সব ধর্ম ও গোত্রের মানুষ অনুকরণীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করছে।

ভারত বাংলাদেশের প্রধান প্রতিবেশী। বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা-সংগ্রামে ভারত সরকার এবং ভারতের সাধারণ মানুষের ঐতিহাসিক এবং আন্তরিক সহায়তার জন্য সাধারণভাবে কৃতজ্ঞ। কিন্তু একই সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের জন্য দারুণ ক্ষুব্ধ। ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক বৃহৎ প্রতিবেশীর একতরফা মনোভাবের কারণে নানা কারণেই তিক্ত হয়ে আছে। ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, অভিন্ন নদনদীগুলোর পানি বণ্টনে দীর্ঘ ৫৩ বছরেও সম্মত হয়নি। শুষ্ক মৌসুমে অভিন্ন নদীগুলোর পানি উজানে সরিয়ে নিয়ে বিশাল অঞ্চলকে মরুভূমিতে পরিণত করেছে, বর্ষায় হঠাৎ করে পানি ছেড়ে বিশাল অঞ্চল প্লাবিত করছে। অভিন্ন নদী কমিশন ভারতের অসহযোগিতার কারণে মৃতপ্রায়। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া ছাড়াও মাঝেমধ্যেই নিরীহ বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা করছে ভারত। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে সড়ক, রেল এবং পানিপথে যোগাযোগ স্থাপিত হলেও চিকেন নেকের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে নেপাল ভুটানের বাণ্যিজ্যে এখনো নানা বাধা রয়েছে। ভারতের নানা ধরনের শুল্ক বাধার কারণে ভারত বাংলাদেশ বাণিজ্য এখনো ব্যাপকভাবে ভারসাম্যহীন। অনেকের মতে ভারতের পরোক্ষ বাধার কারণে বাংলাদেশ নিজেদের প্রাথমিক জ্বালানি আহরণ এবং উত্তোলন করছে না। কিন্তু একতরফা চুক্তির মাধ্যমে ভারত থেকে তরল জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ আমদানি করছে। বৈধ অবৈধভাবে অনেক ভারতীয় বাংলাদেশে কাজ করে বিপুল সম্পদ দেশে নিয়ে যাচ্ছে। ভারত প্রতিবছর প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণ পণ্য বাংলাদেশে রফতানি করে এবং এক মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের একতরফা নীতির পরিণতিতে বাংলাদেশ ভারতের বাণিজ্য পথ রুদ্ধ হলে বাংলদেশ এবং ভারত উভয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে. বাংলাদেশের মানুষ ভারতে সফর না করলে ভারতের অর্থনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে যার আলামত ইতিমধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তান, চীনের সম্পর্ক দৃঢ়তর হওয়া ভারতের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেভেন সিস্টার অস্থির হয়ে পড়ে উদ্বেগ বাড়ছে।

ভারত বিশাল বাজার হারাবে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে আন্তঃরাজ্য সহজ যোগাযোগের সুযোগ হারাবে। বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স আয়ের সুযোগ সংকুচিত হবে। সার্ক অঞ্চলে ভারতের বন্ধু বলে কেউ থাকবে না। ভারতের মনে রাখা উচিত উন্মুক্ত বিশ্বে গায়ের জোরে কোনো দেশ কোনো দেশকে দীর্ঘদিন কোণঠাসা করে রাখতে পারে না, পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘নবো সব কিছু, দিবো না কিছু’-এই নীতি চিরদিন সফল হয় না। বাংলাদেশে কি হচ্ছে, না হচ্ছে, সেগুলো নিতান্তই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিজেদের সমস্যা সমাধানের। বিশ্বসম্প্রদায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাকে সম্মান দেখাচ্ছে। আশা করি, ভারত-বাংলাদেশ সরকার আন্তরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাগুলো দুই দেশের সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে দ্রুত সমাধান করবে। বাংলাদেশের উন্নয়নে চীন, জাপান, কোরিয়া, রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম ইউরোপ, আরব দেশগুলো কিন্তু সম্পৃক্ত আছে। বাংলাদেশকে বন্ধুহীন ভাবা ভারতের ভুল হবে। 

শেয়ার করুন