৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৭:১৯:৩৩ পূর্বাহ্ন


অশুভ কর্মকাণ্ড, অশনিসংকেত
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-১২-২০২৪
অশুভ কর্মকাণ্ড, অশনিসংকেত হত্যাকাণ্ডে শিকার আইনজীবী ও ইসকনের সাবেক নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস


ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘাতে লিপ্ত, লুটতরাজ, ভাঙচুর, অগ্নিকাণ্ড ঘটাচ্ছে একে অপরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সংবাদপত্রের অফিসের সম্মুখে উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড, সড়ক-মহাসড়কে দাবি-দাওয়ার নামে দেদার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে জনজীবন দুর্বিষহ করে তোলা, ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে সংঘাত সৃষ্টির অপপ্রয়াস করা, সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত না হয়ে অবনতির দিকে, দিনদুপুরে চট্টগ্রামে হত্যা করা হয়েছে একজন আইনজীবীকে। ছাত্র-জনতার মহান আন্দোলনের পর সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্যে নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেকটাই তালগোল পাকিয়ে ফেলছে বলে মনে হচ্ছে। মূলত কিছুটা নমনীয়তা বা দুর্বলতার সুযোগে এমন সব অহরহ ঘটনা এবং এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। যে কোনো সময় অন্তর্বর্তী সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার মানেই জলজ্যান্ত আতঙ্ক। অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই-এমনকি অপরাধীদের যমদূত তুল্য। ফলে সহাবস্থানে সরকারি-বেসরকারি থেকে শুরু করে সবাই থাকেন দায়িত্ব পালনে তটস্থ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নিজেদের কর্মতৎপরতা চালিয়ে যায় কারো রাজনৈতিক ফরমায়েশহীনভাবে। সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট থাকে এসব কর্মকাণ্ডে। কিন্তু এবার ছাত্র-জনতার বিপ্লবে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে এমন আতঙ্ক ছড়াতে পারেনি। ফলে মানুষও সন্তুষ্ট হতে পারছে না। কোনো একটা সেক্টরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ফলে বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যে ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ অস্থির। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রত্যাশিত কর্মতৎপরা না থাকায় মানুষ ভয়ে তটস্থ! 

সম্প্রতিক ঘটনার দিকেই নজর দেওয়া যাক-ভেবে দেখেন ঢাকায় ঘোষণা দিয়ে কয়েকটি কলেজের কতিপয় নিয়ন্ত্রহীণ ছাত্ররা আরেকটি কলেজে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো সামাল দিতে। চট্টগ্রামে ইসকনের বহিষ্কৃত নেতাকে আদালতে আনা, সেখানে অবস্থানকাল এবং পরিবর্তিতে সংঘটিত সংঘর্ষ এবং আইনজীবীকে নির্মম হত্যাকাণ্ড কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা তৎপরতায় এড়ানো যেত না? দেখলাম, ছাত্র-জনতা আন্দোলনের দুই শীর্ষনেতা সারজিস আলম ও আবুল হাসনাতের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছিল। পরে হাসনাতের গাড়ি ঢাকার কাছাকাছি আবারও দুর্ঘটনায় পড়ে- এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকা-ের অপপ্রয়াস? দেশ যখন নানা সংকট মোকাবিলা করে সংস্কারের পথে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে তখন এই ধরনের চতুর্মুখী সংকট সৃষ্টি কারো জন্যই শুভ পরিণতি বয়ে আনবে না। 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ভিশন ছিল সব মত, পথের, সব ধর্মের বিশ্বাসের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। সেখানে কেন কিছু পত্রপত্রিকাকে টার্গেট করা হবে? কেন ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর পায়তারা করা হবে? যে ছাত্র সমাজ একতাবদ্ধ হয়ে মহান আন্দোলন করলো তারা কেন নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত? কেন শিল্প অঞ্চলে শান্তি আসছে না? এমন না এগুলোর জবাব সমাজ সচেতন মানুষদের জানা নেই? জানি দেশে অনেক শান্তিপ্রিয়, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, সমাজ সচেতন মানুষ আছেন। দেশের এই সংকট মুহূর্তে সবাইকে দেশের স্বার্থে একতাবদ্ধ হতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু উপদেষ্টা নিজেদের কার্যক্রমে সফল হচ্ছেন না। এতে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসের অর্জিত সুনাম ম্লান হচ্ছে। কিছুতেই পুলিশ বাহিনী সংগঠিত হচ্ছে না, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেসামরিক প্রশাসন সংগঠিত হচ্ছে না। সরকারঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তির আস্ফালন সমাজে বিভেদ, অবিশ্বাস সৃষ্টি করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা গুজব বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভুল সংকেত পাচ্ছে। যেভাবে চলছে দেশ পরিণতি শুভ হবে না কারো জন্যই। মনে রাখতে হবে, ভূরাজনীতির কারণে অনেকেই চায় না বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাক। আমাদের নিজস্ব ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় রেখে উপযোগী কূটনৈতিক কৌশল অবলম্বনের প্রয়োজন রয়েছে। সরকারকে বুঝতে হবে গতানুগতিক ধারায় আমলানির্ভর থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে বিষয় বিশেষজ্ঞদের খুঁজে বের করে দায়িত্ব দিতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছে, সেখানে সুফল মিলছে।

মনে রাখতে হবে সরকার অনির্বাচিত, দেশের সংবিধান রক্ষার শপথ নেওয়া খণ্ডকালীন সরকার। সব সমস্যা সমাধান, সব সংস্কার করা সরকারের ক্ষমতার বাইরে। সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলো সংস্কারের সুপারিশ করবে। সরকার রাজনৈতিক দলসমূহ এবং অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে সম্মত সংস্কারগুলোর পথনকশা জাতির সামনে তুলে ধরবে। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারগুলো পর্যায়ক্রমে সংস্কার সম্পাদন করবে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ করা, সংবিধান পাল্টে ফেলা এগুলো দাবি তুলে জল ঘোলা করা অপ্রাসঙ্গিক। 

শুনছি ডিসেম্বর ৩১, ২০২৪ নাগাদ সংস্কার কমিশনগুলো সুপারিশ জমা দেবে। জানুয়ারি থেকে মার্চ ২০২৫ সরকার সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার সম্পাদন করে, অবশিষ্টগুলো সম্পাদন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পথনকশা অনুমোদন করতে পারে।

এদিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ড সম্পাদনে ৬-৯ মাস পর্যন্ত সময়। তবে এই সময়ের মধ্যে সরকারকে জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ড এবং তৎপরবর্তী কিছু ঘটনার নিরপেক্ষ বিচার একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। সরকারকে অর্থনীতি সচল রাখতে হবে। জ্বালানি-বিদ্যুৎ সংকট সামাল দিতে হবে। ২০২৫ গ্রীষ্মকাল, সেচ মৌসুমে জ্বালানি-বিদ্যুৎ সংকট তীব্রতর হতে পারে। শিল্পগুলো ধুঁকছে, বিনিয়োগ পরিস্থিতি স্থবির। দেশের স্বার্থ বিবেচনায় সবাইকে হঠকারিতা সৃষ্টিকারী মহলের বিরুদ্ধে সচেতন থাকতে হবে। বিশেষ করে সরকারের উপদেষ্টা এবং সরকার সমর্থক ব্যক্তি-গোষ্ঠীর কথায়, আচরণে সংযত হতে হবে। বুঝতে হবে সবার সীমাবদ্ধতা। বিশ্বপরিস্থিতি কিন্তু সংকট পথে। বাংলাদেশ কোনোভাবেই পরাশক্তিগুলোর ক্রীড়াঙ্গনে পরিণত হতে পারে না। ২০২৫ বাংলাদেশিদের জাতীয় জীবনে একটি মহা গুরুত্বপূর্ণ বছর হিসেবে বিবেচিত হবে।

শেয়ার করুন