তীব্র জ্বালানি সংকটে ভুগছে দেশ। যত দিন যাচ্ছে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দুই মাস পেরিয়ে গেল। সংস্কার, পরিবর্তন নিয়ে নানা কথা বলা হলেও জ্বালানি-বিদ্যুৎ সেক্টরে বিরাজমান সংকট উত্তরণের শুভ লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বিদ্যুৎ-জ্বালানি সেক্টর ব্যবস্থাপনায় শীর্ষ পর্যায়ে কিছু কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে, দ্রুত বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহ বিশেষ আইন, ২০১০ স্থগিত করে এর আওতায় বিবেচনাধীন, এমনকি চুক্তি হয়ে যাওয়া কিছু প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু সংকটের মূলে থাকা প্রাথমিক জ্বালানি আহরণ, উন্নয়ন এবং সরবরাহে কোনো গুণগত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গ্যাস সরবরাহ সংকটে ভোগা বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থা চরম সংকটে, অধিকাংশ সার কারখানায় উৎপাদন স্থগিত, শিল্পসমূহ আছে গভীর জ্বালানি-বিদ্যুৎ সংকটে। এরই মধ্যে পেট্রোবাংলার সঙ্গে কয়েকটি কোম্পানির সম্পর্কের অবনতি ঘটায় জ্বালানি সেক্টরে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। জ্বালানি সেক্টরের কোম্পানিগুলোকে আমলা নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হলেও পরিবর্তন করে সেই আমলাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কোম্পানিগুলোর পরিচালকমণ্ডলীতে।
গ্রিড নন-গ্রিড মিলে বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩১ হাজার ১৪৫ মেগাওয়াট। কিন্তু প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ সংকটে ১৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করতেই হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ। মূল সংকট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে। ১২ হাজার ৪৮ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজন ২২০০-২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। কিন্তু সর্বোচ্চ ১০০০-১১০০ মিলিয়ন ঘনফুটের অধিক গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব না হওয়ায় গ্যাস ব্যবহার করে ৭০০০-৮০০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। কয়লা, বিশেষত আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এখন ৫ হাজার ৬৮৩ মেগাওয়াট। কিন্তু প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে কয়লা আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। আদানি গ্রুপের ঝাড়খ-ে থাকা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা সম্ভব ২ হাজার ৬৮৬ মেগাওয়াট। সেখানেও সরবরাহকৃত বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধে সংকট আছে. আদানি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী একপেশে চুক্তি বাতিল বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এলএনজি সরবরাহ বাড়ানো বিষয়ে সামিট গ্রুপের সঙ্গে স্বাক্ষরিত তৃতীয় ভাসমান টার্মিনাল স্থাপন চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। নতুন করে টেন্ডার করে উদ্যোক্তা নির্বাচন এবং চুক্তি করতে ১-১.৫ বছর লেগে যেতে পারে। নিদেনপক্ষে তিনটি দরপত্র পাওয়ার বিষয়েও নিশ্চয়তা নেই। তাই ২০২৮-এর আগে এলএনজি সরবরাহ বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছি না।
এক্সসেলেব্রেট কর্তৃক গভীর সাগরে ভাসমান এলএনজি স্থাপনা থেকে সাবমেরিন পাইপলাইনের মাধ্যমে এলএনজি সরবরাহ চুক্তির বিষয়টিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ভারত থেকে পাইপলাইনে আর এলএনজি আমদানির আলোচনাও স্থগিত হয়ে আছে. দেশে এখন গ্যাস চাহিদা ৪২০০-৪৫০০ এমএমসিএফডি। ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানিকৃত এলএনজিসহ সর্বোচ্চ গ্যাস এলএনজি সরবরাহ ক্ষমতা ৩ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। শেভরন পরিচালনাধীন বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকেই আসছে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। ক্রমহ্রাসমান ধারায় উৎপাদন আতঙ্ক জনকভাবে কমছে। পেট্রোবাংলা/বাপেক্স ২০২৫ নাগাদ ৪৮ কূপ এবং ২০২৮ নাগাদ ১০০ কূপখননের পরিকল্পনা করলেও অতীত ইতিহাস এ সক্ষমতার প্রমাণ দেয় না। গভীর সংকট ঘনিয়ে আসছে।
এতো গেল গ্যাস উৎপাদনের দিক। সংকটের এ কঠিন সময়েও ভোলা দ্বীপের আবিষ্কৃত গ্যাস সরকারের দোদুল্যমানতার কারণে জাতীয় গ্রিডে আনা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার প্রাধিকার ভিত্তিতে ভোলায় বাপেক্সের পূর্ণ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ভোলায় অনুসন্ধান এবং উন্নয়ন কূপ খনন এবং পাশাপাশি আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করে ভোলা থেকে বরিশাল হয়ে খুলনা পর্যন্ত তিন বছরে গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন করার উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। সরকার কিন্তু ইতিমধ্যে বিশেষ আইন, ২০১০-এর অধীনে গাজপ্রমের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাতিল করেছে, গ্যাসকে সিএনজিতে রূপান্তর করে ঢাকার শিল্পাঞ্চলে সরবরাহের চুক্তি বাতিল হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গাজীপুর, মাওনা, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ এলাকায় থাকা শিল্পকারখানাগুলো তীব্র গ্যাস সংকটে আছে। কিছু শিল্পকারখানা গভীর রাতে বিশেষ ব্যবস্থায় সিএনজি ব্যবহার করে জরুরি চাহিদা মেটালেও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যানবাহনে সিএনজি সরবরাহ সংকটে আছে, এই সংকট সহসা কাটবে না।
তিতাস গ্যাস বিতরণ এলাকায় বিতরণ নেটওয়ার্কে হাজার হাজার ছিদ্রপথে গ্যাস লস হচ্ছে। বিতরণ নেটওয়ার্ক অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। সঠিক চেইন গ্যাস বিতরণ করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। অবৈধ গ্যাস ব্যবহার প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গাছে। তিতাস দেশের ৬০ শতাংশ গ্যাস বিতরণ করে থাকে। গ্যাস চাহিদা প্রায় ২ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। সরবরাহ ১৩০০-১৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ইতিমধ্যে পুরোনো বিতরণ লাইন প্রতিস্থাপন করে নতুন বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার দুটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশন থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিতাস গ্যাসের সমপর্যায়ের না হলেও সংকট আছে বিজিডিসিএল এবং কেজিডিসিএলেও। মোটকথা, সংকটে আছে গোটা গ্যাস সরবরাহ চেইন ম্যানেজমেন্ট। তদুপরি, পেট্রোবাংলা এবং কয়েকটি গ্যাস কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিরাজমান সংকট পরিস্থিতি জটিল করছে।
সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কত দ্রুত ভোলার গ্যাস গ্রিডে যায়? কীভাবে তিতাসসহ সব বিতরণ কোম্পানির গ্যাস চুরি, অবৈধ গ্যাস ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নেওয়া যায়। শিল্পগ্রাহকরাও এলপিজি, এসএনজি, জৈব এনার্জি ব্যবহার বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পারে। সরকারকে অবিলম্বে দেশের কয়লা উত্তোলন করার উদ্যোগ নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি সংকট মেটাতে হবে। শিল্পকে গ্যাস ব্যবহারে অগ্রাধিকার দিয়ে গৃহস্থালি এবং সিএনজিকে গ্যাস সরবরাহ ক্রমশ কমিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে।
এরপরও জানা সম্ভবপর হয়নি যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কী ভাবছে। ২০২৫ মার্চ এপ্রিলে কিন্তু তীব্র জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকট হতে পারে। এরই মাঝে সরকারকে সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে ভূরাজনৈতিক চাপ সামাল দিতে হতে পারে। সরকারকে দ্রুত জ্বালানি-বিদ্যুৎ সংকট উন্নয়নে পথনকশা তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনযোগ্য, দক্ষ পেশাদার দেশপ্রেমিকদের সুযোগ দেওয়া।