৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:১৭:১১ অপরাহ্ন


মব জাস্টিসের নামে তৎপরতার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-০৯-২০২৪
মব জাস্টিসের নামে তৎপরতার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক ভেঙে দেয়া একটি মাজার


ধর্মের নামে, জাতপাতের নামে, মোরাল পুলিশিং এর নামে কিংবা মব জাস্টিসের নামে যতরকম তৎপরতা চলছে সেগুলোর বিরুদ্ধে নিজ নিজ এলাকায় ফ্যাসিবাদবিরোধী সকলকে সাথে নিয়ে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য গণঅভ্যুত্থান শিক্ষার্থী জনতাকে আহবান জনালেন লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, গবেষক, চিন্তক ও এক্টিভিস্টদের উদ্যোগে গণপ্রতিরোধ যাত্রা থেকে।

সারাদেশে মাজারে-দরবারে ফ্যাসিবাদী হামলার প্রতিবাদে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ঢাকায় লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, গবেষক, চিন্তক ও এক্টিভিস্টদের উদ্যোগে একটি গণপ্রতিরোধ যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ১১ টায় হাইকোর্ট মাজার গেটে জমায়েত হয়ে শুরু হয়ে আগে একটি সমাবেশ হয়। এসময় গণপ্রতিরোধ যাত্রার আয়োজকদের পক্ষ থেকে মাজারে হামলার বিষয়ে তাদের লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন শিল্পী ও সংগঠক বীথি ঘোষ। এরপর সেখানে সংহতি জানিয়ে মাজারে হামলার বিরোধী এমন নানান মত ও পথের মানুষেরা বক্তব্য রাখেন। এসময় সেখানে সংহতি জানিয়ে উপস্থিত ছিলন গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের আওতাধীন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, আমাদের পাঠশালা, সমগীত, উদীচী, চারণ, ভাববৈঠকীরসহ নানান সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চর্চার মানুষ। গোলাপ শাহ মাজার, মোতালেব শাহ মাজার, আশেকিনে আউলিয়া ঐক্য পরিষদসহ নানান মাজার-দরবারের মানুষও এসময় উপস্থিত ছিলেন।এসময় সেখানে সংহতি জানিয়ে যারা বক্তব্য রাখেন তাদের মধ্যে ছিলেন শিল্পী অরুপ রাহী, শিল্পী অমল আকাশ, লেখক সালহউদ্দিন শুভ্র, কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, আশেকিন আউলিয়া ঐক্য পরিষদের প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া হোসাইন, নারী নেত্রী সীমা দত্ত প্রমুখ। সমাবেশ ও গণপ্রতিরোধ যাত্রাটি সঞ্চালনা করেন গবেষক ও এক্টিভিস্ট মাহতাব উদ্দীন আহমেদ।

গণপ্রতিরোধ যাত্রার আয়োজকরা তাদের বক্তব্যে বলেন, যেকোনো চিন্তা-মতাদর্শ নিয়ে সমাজের যে কারো সমালোচনা থাকতে পারে । কিন্তু শুধুমাত্র ভিন্ন চিন্তা-মত-পথের হওয়ার জন্য কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের উপর হামলা করা যায় না। মাজারগুলোতে ইসলামের যে বয়ানের চর্চা হয় সেই বয়ান কোনো গোষ্ঠী/সংগঠন/রাজনৈতিক দলের পছন্দ নাও হতে পারে। কিংবা মাজার নিয়ে কারো অন্য কোনো সমালোচনা থাকতেই পারে। কিন্তু কারো বয়ান পছন্দ না হলেই, কিংবা কারো চিন্তাধারা নিজেদের সাথে না মিললেই কিংবা কাউকে নিয়ে কোনো সমালোচনা থাকলেই যদি কোনো গোষ্ঠী মনে করে যে, তার উপর হামলা চালানো জায়েজ তাহলে বুঝতে হবে তারা পরিষ্কারভাবেই ফ্যাসিবাদকে অন্য রূপে, অন্য রঙে ফিরিয়ে আনতে চাইছে। তারা ধর্ম কিংবা নানান বাহানায় আসলে নিজেদের জুলুম-লুটপাটের রাজত্বই এদেশে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর একারণেই আমরা দ্ব্যার্থহীনভাবে বলতে চাই সারাদেশের মাজারে-দরবারে যেসব গোষ্ঠী যেকারণেই হামলা চালাক না কেন তার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন খুবই জরুরি।

আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সাথে লক্ষ্য করছি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা এই অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত মাজার ও দরবারগুলোর সুরক্ষায় কোনো দৃশ্যমান কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি! এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যদিও অবশেষে সরকারের পক্ষ থেকে মাজারে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থা নেয়ার কথা ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা সরকারকে প্রশ্ন করতে চাই, কেন এই ঘোষণা আসতে এত দেরি হল? কেন এতগুলো মাজার ভাঙ্গার জন্য অপেক্ষা করতে হল? যেখানে আমরা দেখতে পেলাম আগাম ঘোষণা দিয়ে বুলডোজার নিয়ে মাজারে হামলা চালানো হচ্ছে, মাজারের কবর থেকে দেহাবশেষ তুলে নিয়ে যাচ্ছে, আগুন দিচ্ছে, আগতদের পেটাচ্ছে, হতাহত করছে, সেই সময় সরকারের দিক থেকে আপাত নীরবতা কেন ছিল? এই নীরবতায় আমাদের উদ্বিগ্ন। আমরা অবিলম্বে মাজারে হামলার বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর হওয়ার ঘোষণার দৃশ্যমান বাস্তবায়ন দেখতে চাই। তবে আমরা মনে করি, এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা না থাকলে সরকারের পক্ষে এই ঘোষণার কার্যকর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

আমরা এটাও মনে করি যে, মাজারগুলোতে হামলা চালানো গোষ্ঠীগুলো, এবং নানান সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী বা ব্যক্তিরা যেভাবে সমাজে ধর্মের নামে, মব জাস্টিসের নামে বিভাজন তৈরি করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে সেই অপচেষ্টা অনতিবিলম্বে বন্ধ না করতে পারলে, পূর্বের বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ভুয়া বিচারের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে সেটি এই সরকারের স্ট্যাবিলিটিকেই হুমকির মুখে ফেলবে। এইসব প্রবণতা এখনই আইনীভাবে বন্ধ করা না গেলে সেটি সমাজের বিভিন্ন বর্গের মধ্যে গণতন্ত্র প্রশ্নে ঐক্যমত্যের সম্ভাবনাকেই ধ্বংস করে দিবে।"

গণপ্রতিরোধ যাত্রা থেকে সরকারের কাছে ৫ টি দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলো হল- ১. মাজার ও দরবারগুলোর উপর চালানো প্রতিটি হামলায় যারা জড়িত তাদেরকে অনতিবিলম্বে খুঁজে বের করে কঠোর বিচারের আওতায় আনতে হবে। যেহেতু সরকার ইতিমধ্যেই তাদের বিচারের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছে ফলে আমরা সেই ঘোষণা অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা শুরু হয়েছে সেটি দেখতে চাই। ২. মাজারকে মাজারের মতো থাকতে দিয়ে সকল মাজার ও দরবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। ভেঙ্গে ফেলা প্রত্যেকটি মাজার সরকারের পক্ষ থেকে পুননির্মাণ করে দিতে হবে। ৩. মাজারের উপর হামলার কারণে যারা আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকারকে নিতে হবে। এক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে সম্মানজনক ক্ষতিপূরণ ও ন্যায়বিচার দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. সকল প্রকার মব জাস্টিস, মোরাল পুলিশিং, নারীবিদ্বেষী প্রচারণা বন্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে এবং যারা এগুলো করছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুততম সময়ে আইনী ব্যবস্থা নিতে হবে। ৫. সরকারের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা দিতে হবে এবং এটা নিশ্চিত করতে হবে যে শুধুমাত্র ভিন্ন মতের হওয়ার কারণে, কিংবা যেকোনো মাধ্যমে যেকোনো প্রকার ভাল বা মন্দ কথা বা উক্তির জন্য কেউ কারো উপর হামলা করতে পারবে না। হামলা করলে সরকার তার বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নিবে। সেই সাথে গণপ্রতিরোধ যাত্রা থেকে এলাকায় ধর্মের নামে, জাতপাতের নামে, মোরাল পুলিশিং এর নামে কিংবা মব জাস্টিসের নামে যতরকম তৎপরতা চলছে সেগুলোর বিরুদ্ধে নিজ নিজ এলাকায় ফ্যাসিবাদবিরোধী সকলকে সাথে নিয়ে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য গণঅভ্যুত্থান শিক্ষার্থী জনতাকে আহবান করা হয়। তারা আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থান সকলকে প্রশ্ন করা শিখিয়ে গেছে। তাই গণঅভ্যুত্থানকে বজায় রাখতে, প্রত্যেককেই প্রশ্নের মুখে রাখুন। জবাবদিহির মুখে রাখুন।

আয়োজকদের বাইরে বিভিন্ন মত পথের যারাই বক্তব্য রাখেন তারাও নিজ নিজ দৃষ্টিকোন থেকে মাজারে হামলা বন্ধে সরকারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে আহবান জানান। সমাবেশ শেষে মাজারে হামলা চলবে না, দেশটা কারো বাপের না- এই শ্লোগান দিতে দিতেন উপস্থিত নারীদের নেতৃত্বে গণপ্রতিরোধ যাত্রাটি শুরু হয়। এটি প্রেসক্লাবে পৌঁছালে সেখান থেকে একটি প্রতিনিধিদল উপরোক্ত দাবি ও বক্তব্য সংবলিত একটি স্মারকলিপি নিয়ে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর জমা দিয়ে আসে।

শেয়ার করুন