মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যে আন্দোলন ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এর শেষ কোথায় এ নিয়ে এখন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিভিন্ন মন্তব্য আসছে। একই সঙ্গে এ ছাত্র আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী এবং এটা যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচনে এর প্রভাব কতটা এ আলোচনা বেশ জোরেশোরে চলছে। ছাত্র আন্দোলন একসময় কমে যাবে। ধীরে ধীরে ছাত্ররা ফিরে যাবে পড়াশোনায়। কিন্তু যে আন্দোলনটা তারা শুরু করে চালিয়ে গেছেন এটা গোটা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে যে একটা বড় বিভেদ তৈরি হয়ে গেছে ইতিমধ্যে সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। আর সে বিভেদ প্রবীণ ও নবীনদের মধ্যকার বিভেদ।
স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের চিন্তা-চেতনায় মানবতাবাদী থাকে। এখানে ধর্মবর্ণ কোনো ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে না। কেননা যে আন্দোলনটা চলমান সেখানে সবাই কী মুসলমান বা সবাই কী খ্রিস্টান তা কিন্তু নয়। সব ধর্মের ছেলেমেয়েরা রয়েছে। এমনকি অনেক ইহুদি ছেলেমেয়েরাও এ আন্দোলনে রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ফলে শিক্ষার্থীদের চিন্তা-চেতনায় যে মানবতাবাদ সেটাই স্পষ্ট হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড ও বক্তব্যে বলছেন তাহলো তাদের এ আন্দোলন রাষ্ট্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নয়। তাদের এ আন্দোলন গাজায় মানবতার বিরুদ্ধে গিয়ে আক্রমণ করছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তা বন্ধে। তারা গাজায় ইসরায়েল যে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, সেটা তো আসলে কোনো যুদ্ধ নয়। একটা জাতিকে নির্মূল করার চিন্তা বা প্ল্যান। কেননা নারী-শিশুদের হত্যাকা- ঘটানো কোনো যুদ্ধের প্ল্যান নয়। কোনো বেসমারিক এলাকা বা স্থাপনায় হামলা কোনো সভ্য রাষ্ট্রেরও কাম্য নয়। এ কথাগুলোই তারা বলছে। এগুলো অবিলম্বে বন্ধ করা এবং ইসরায়েলে যে সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র, সেগুলো প্রত্যাহার করার দাবি এ ছাত্র আন্দোলনের মূলকথা।
ফলে এমন পরিস্থিতি এখন বর্তমান প্রশাসন সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। প্রথমে প্রশাসন ভেবেছিল পুলিশ দিয়ে কঠোর হলে এটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কিন্তু এটা হীতে বিপরীত হয়েছে। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি দিয়ে গত সপ্তাহে শুরু হওয়া এ ছাত্র আন্দোলন এখন প্রায় ৪০ থেকে ৪৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে গেছে। এর বাইরেও যারা রয়েছেন তারাও ফুঁসছেন। এমনকি এক তো গাজা ইস্যু রয়েছে, এরপর সহপাঠীদের ওপর পুলিশের কঠোরতম হওয়াটাকে তারা প্রেস্টিজ হিসেবে নিয়ে ফুঁসতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে এর রেশ ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বিষয়টি যে সহজেই মিটমাট হবে, তেমনটার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে প্রশাসন কৌশলী হয়ে ধৈর্যধারণ করে হয়তো সামাল দেবেন। কেননা ইতিমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানের আশপাশে বা ক্যাম্পাসে তাঁবু খাটিয়ে আন্দোলনরত ছাত্ররা অব্যাহত রাখছে, তাদের দাবি-দাওয়া সংবলিত আন্দোলন।
মূল দাবি কী, কীভাবে শুরু
গত ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া হাজা ও ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ প্রাথমিকভাবে বিশ্বের সবাই অবজার্ভ করেছে। কিন্তু এরপর ইসরায়েলি বাহিনীর সাঁড়াশি হামলায় বেসমারিক এলাকা ও নির্বিচারে শিশু ও মহিলা ও পুরুষ নিহত হওয়া ও তাদের ঘরবাড়িতে বিমান হামলা করে নিশ্চিহ্ন হওয়াটা মেনে নিতে পারছিলেন না অনেকেই। ক্রমশই এ হামলা অব্যাহত থাকায় সমালোচনা শুরু। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ক্লাসে এ নিয়ে আলোচনা হয় বলে খবর পাওয়া গেছে। যেখানে উঠে আসে গাজায় মানবতার বিষয়টা। ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীরা জোট বাঁধতে থাকে এবং নিরপরাধ ও বেসামরিক নারী-শিশুদের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদ চলতে থাকে।
ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় ওই হামলা শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র অনেকবার সহায়তা দিয়েছে। অর্থ ও অস্ত্র দ্বারাও সহায়তা করেছে ইসরায়েলকে এটা প্রকাশ্যে। ফলে ইসরায়েলি বাহিনীর এমন হামলার পেছনে প্রধান মদতদাতা হিসেবে শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রকেই দেখছে। এজন্যই তারা এসব সাহায্য সহযোগিতা বন্ধ এবং গাজায় ইসরায়েলের হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আন্দোলন শুরু করে।
আটক করা হচ্ছে আন্দোলকারীদের
ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে এমন আন্দোলন সামাল দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর বাইরেরও প্রেশার ছিল বলে জানা গেছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা বড় বড় দাতা (ডোনার)। তারা বেশ চাপ তৈরি করে এবং আন্দোলন বন্ধ না হলে ডোনেশন বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকেন। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিপাকে পড়ে যায়। বাধ্য হয়ে পুলিশকে অনুমতি দেয় আন্দোলন ঠেকাতে ক্যাম্পাসে প্রবেশের। সূচনা সেখানেই। শুধু শিক্ষার্থীদেরই নয় শিক্ষকদেরও আটক করেছে পুলিশ। পুলিশের ধারণা এ আন্দোলনে মদতদাতা বা আন্দোলন সফল করার পেছনে অনেক শিক্ষকের ভূমিকাও রয়েছে। এজন্য তারা শিক্ষক পরিচয় পাওয়ার পরও তাদের গ্রেফতার করতে দেখা গেছে। এ রিপোর্ট লেখাকালীন সময় (২৯ এপ্রিল) প্রায় ৯০০ শিক্ষার্থী আটক করেছে পুলিশ। এর মধ্যে শিক্ষকও রয়েছে।
এ আন্দোলন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যা ঘটেছে
অনেকেই শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন ইহুদিবিরোধী আন্দোলন হিসেবে রং দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পর্যবেক্ষণে এ বিষয় প্রমাণিত হয়নি। কারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সব ধর্মেরই লোক রয়েছে।
গাজায় আন্দোলন নিয়ে দ্বিমত আছে বিশ্বের সব দেশে। যুক্তরাষ্ট্রও এর বাইরে নয়। ফলে পক্ষে-বিপক্ষে সবাই কমবেশি বলছেন। এ আন্দোল নিয়ে হোয়াইট হাউসেও হয়েছে আলোচনা। তবে দেশটির প্রধান দুই দল ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকানের কেউই প্রকাশ্যে মুখ খোলেনি। এ ঘটনায় মুখে তালা মেরে বসে রয়েছেন তারা। কারণ এমন এক আন্দোলন যে আসামি নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে, সেটা ইতিমধ্যে বুঝে গেছেন তারাও। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে পটপরিবর্তনে নবীন-প্রবীণদের পার্থক্যটা বড় হয়ে গেলে নবীনদের জয়জয়কার দেখা গেছে। ফলে রাজনীতিবিদরা অহেতুক কেন জড়াবেন এতে।
রাজনৈতিক কী প্রভাব ঘটতে পারে
যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ নির্বাচন অত্যাসন্ন। ইতিমধ্যে নির্বাচনের মাঠে লড়াই শুরু হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই সে লড়াই রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে। কিন্তু ওই নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন কোনো প্রভাব ফেলবে কীÑএ প্রশ্ন জনমনে।
ইসরায়েলিদের সহায়তা প্রদান এটা যুক্তরাষ্ট্র বহু আগ থেকেই করে আসছে। বলা চলে যুক্তরাষ্ট্রই ইসরায়েলিদের লালনকর্তা। ফলে এদের বিপদ-আপদে সাহায্য সহযোগিতা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশ হিসেবে সে সহযোগিতা নিয়ে কারো মাথাব্যথা না থাকলেও ইসরায়েলিদের নির্বিচারে গাজাবাসীদের ওপর হামলায় ব্যথিত অনেক মার্কিনি। এদের মধ্যে তরুণ প্রজন্ম সর্বাগ্রে। মুসলিম ভোটারদের অনেকেই এ ঘটনা ব্যথিত। কারণ ফিলিস্তিন মুসলিম দেশ। গাজাবাসীরা মুসলমান। যেভাবেই হোক না কেন এবার ইসরায়েলের গাজাবাসীর ওপর নির্বিচারে হামলা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলেই ঘটলো। স্বাভাবিকভাবে মুসলমানদের অভিযোগের তীর বাইডেনের দিকেই। যে আন্দোলন শুরু এতে ভবিষ্যতে হয়তো এ ব্যাপারে নতুন চিন্তা করলে করতেও পারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা। কিন্তু এ মুহূর্তে? যেখানে গাজায় দীর্ঘদিনের আক্রমণে বিভিন্ন তথ্যমতে, ৩৬ হাজারের অধিক সাধারণ ও নিরীহ নারী-পুরুষ প্রাণ হারিয়েছেন বা নিহত হয়েছেন বা হত্যা করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য সহযোগিতা দিলেও ইসরায়েলকে কিছু শর্তের বেড়াজালে আটকালে হয়তো এভাবে নির্বিচারে হত্যাকা- চালাতে পারতো না ইসরায়েল, এমনই অভিমত অনেক মার্কিনিদের। এটা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ বলছেন তারা বাইডেন প্রশাসনকে। সেজন্য মুসলমান ভোটাররা বাইডেনকে ভোট দিতে হয়তো চিন্তা করবেন। একই সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যে নির্যাতনের শিকার তারাও ভোট যে ডেমোক্র্যাটদের বাক্সে দেবেন, সেটা এখন সন্দেহের মধ্যে পড়ে গেছে।
শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের সঙ্গে যদি শিক্ষার্থীরা ও তাদের অভিভাবকরা মুখ ঘুরিয়ে নেন, তাতে সুফল ঘরে তুলতে পারে রিপাবলিকানরা। এমনই এক হিসাবনিকাশ এক রাজনীবিদদের মধ্যে। এ নিয়ে সন্দেহের দোলাচল দুই পক্ষেই। তবে এটা এক্ষুনি কিছু বলার নেই। ভবিষ্যতে এমন একটা হিসাবনিকাশ চলেও আসতে পারে, যা ইতিমধ্যে বলাবলি শুরু এই আর কি!
তবে আরেকটি বিষয়ও এখানে উঠে এসেছে আলোচনায়, সেটা হলো গাজায় এখন আর অবশিষ্ট করার কিছু নেই, যা করার সেটা ইতিমধ্যে সেরে ফেলেছে ইসরায়েলিরা। বাকিটুকু করতে গেলে বিশ্বের কাছে চরমভাবে নাজেহাল হতে হবে ইসরায়েলকে। হয়তো এখন গাজায় ক্ষ্যান্ত দেওয়ার পালা। কিন্তু কিছু একটা বলে তো সেটাকে ইস্তফা দিতে হবে। এ শিক্ষার্থী আন্দোলন আমলে নিয়ে ইসরায়েলকে নতুন ম্যাসেজ পাঠালে সে ধারা অনুসারে ইস্তফা দেওয়া সহজতরও হতে পারে ইসরায়েলকে। তাছাড়া গাজার পর ইসরায়েল এখন ইরান নিয়ে ব্যস্ত। ফলে তাদের সেই নতুন পরিকল্পনায় গাজার ঝামেলা মাথায় রাখতে চাইছে না। বিষয়টি এভাবে ভাবলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না!