বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নেতৃবৃন্দ অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বৈষম্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে অভিযোগ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী সরকারে সাম্প্রদায়িক শক্তি দৃঢ়ভাবে অবস্থান করছে। নেতৃবৃন্দ আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে বিগত নির্বাচনের আগে সরকারি দলের দেয়া প্রতিশ্রুতি সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি ও পাবর্ত্য ভূমি কমিশনের আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্যে পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানান।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কর্তৃক জাতীয় প্রেসক্লাবে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন। তারা পূর্বেকার মতোই এবারের বাজেটেও পর্বত প্রমাণ বৈষম্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বৈষম্যের অবসান দাবি করেন। তারা বলেন, ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও কল্যাণে জাতীয় রাজস্ব বাজেট থেকে বার্ষিক বরাদ্দ প্রদান করে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টসমূহকে ‘ফাউন্ডেশন’-এ রূপান্তরিত করার, সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয় কার্যত সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রধর্মের পক্ষে কাজ করছে। এ কারণে এ অনুচ্ছেদের অন্য অংশে বিধৃত হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মের সমঅধিকার বাস্তবায়নার্থে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্যে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করার, ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বরাদ্দ নিরূপণকল্পে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঠিক শুমারির উদ্যোগ গ্রহণের এবং ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পাদন ও ধর্মীয় সংস্কৃতির উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মডেল মন্দির-প্যাগোডা-গির্জা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনে বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের দাবি জানান তারা।
লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত এবং তথ্যচিত্র উপস্থাপন করেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, কাজল দেবনাথ, বাসুদেব ধর, রবীন্দ্র নাথ বসু, উত্তম চক্রবর্তী, পদ্মবতী দেবী, অরবিন্দ ভৌমিক, অভিজিত ভট্টচার্য, অ্যাডভোকেট তপো গোপাল ঘোষ, মানিক লাল ঘোষ ও অলকা ঘোষ প্রমুখ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বৈষম্যেও বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এতে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এবারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য পরিচালন ব্যয় খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট পরিচালন ব্যয়ের পরিমাণ ৩১৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা তার মধ্যে বাংলাদেশ সচিবালয় ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিচালন ব্যয় ১৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বাদ দেয়ার পর ৩০৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকার মধ্যে ২৯৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা দেশের ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সাড়ে ৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের জন্য মোট বরাদ্দের হার ৯৭.৮৭ শতাংশ এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্যে ২.১৩ শতাংশ।
অভিযোগ করা হয়, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের নামে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ২১ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত এবং তৎপরবর্তীতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭৯ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত করে মূল স্থায়ী আমানতের ১০০ কোটি টাকা কখনো নগদায়ন না করার শর্তে তার সুদের টাকায় হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের পরিচালন ব্যয় নির্বাহের কথা রয়েছে। সেই যুক্তিতে বাজেটে বিগত কয়েক বছর আবর্তক খাতে কোনোরূপ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। উল্লেখ্য, প্রতিবছরে ব্যাংকে জমাকৃত অর্থ থেকে ৫ কোটি থেকে সাড়ে ৫ কোটি টাকা সুদ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি পেয়ে থাকে। উক্ত টাকা থেকে বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকা অফিস খরচ ও বাদবাকি ৪ কোটি টাকা দুস্থদের ও মন্দিরে অনুদান হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় করে থাকে। হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টে বর্তমানে জনবল রয়েছে ১১ জন, তার মধ্যে ৮ জন হিন্দু ও ৩ জন মুসলিম সম্প্রদায়ের।
নেতৃবৃন্দ বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চলমান প্রকল্পসমূহের বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরা বলা হয়, যে ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকল্পে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এ খাতে বরাদ্দ ৯ হাজার ৬১৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা সে ক্ষেত্রে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ ৩১২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ আনুপাতিক হারে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ ৯৬.৮৫ শতাংশ আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ ৩.১৫ শতাংশ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেটে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্যে চলমান প্রকল্পসমূহ তুলে ধরে বলা হয়, এ খাতে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ ৯ হাজার ৫৮২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, অথচ ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দিরভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম ও প্যাগোডাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পের বিপরীতে কোনোরূপ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। ৩১ ডিসেম্বর ২০২০-এর মন্দিরভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম (পঞ্চম পর্যায়) কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রায় ২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে, যাদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের। পুরোহিত ও সেবায়েত দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পটি হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে, যা সারা বাংলাদেশের ১৮টি জেলায় আউটসোর্সিং কর্মকর্তা ও কর্মচারী দ্বারা পরিচালিত হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে এই প্রকল্পের জনবলের মধ্যেও ১০ শতাংশ এর বেশি ইসলাম ধর্মাবলম্বী।
আরো বলা হয়, গত ২৪ মে ২০১৬-এর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বাজেটের বিভিন্ন খাতে বিদ্যমান বৈষম্যসমূহের অনতিবিলম্বে অবসানের এবং দীর্ঘ চার দশকের অধিককাল অব্যাহত ধর্মীয় বঞ্চনা-বৈষম্যের কারণে বিরাজমান অনগ্রসরতা পূরণকল্পে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়নে, কল্যাণে, তীর্থভ্রমণে, দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণে, সামাজিক উন্নয়ন ও গবেষণা পরিচালনায়, ধর্ম ও ধর্মীয় বিষয়সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সম্মেলন, সেমিনার ও সংলাপের আয়োজন ও অংশগ্রহণের জন্যে ন্যূনতম ২ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দের দাবি উত্থাপিত হয়। এর পরবর্তীতে সংসদে বাজেট অধিবেশন চলাকালে তাঁর বাজেট বক্তৃতার শেষাংশে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মঠ-মন্দির সংস্কার ও উন্নয়নের জন্যে ২০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ ঘোষণা করেন। সংসদে এই অর্থবরাদ্দের ঘোষণা দেয়া হলেও ২০১৬-১৭-এর অনুমোদিত বাজেটে তার কোনো উল্লেখ ছিল না। পরিতাপের বিষয়, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯, ২০২০-২১, ২০২১-২২, ২০২২-২৩-এ অর্থবছরগুলিতেও ঘোষিত বরাদ্দকৃত অর্থের পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি বাজেট বরাদ্দে সীমাহীন অবজ্ঞা, অবহেলা, বৈষম্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয়।
লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, বাংলাদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থার একমাত্র সরকার কর্তৃক স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি শিক্ষাবোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহে অর্থাৎ সংস্কৃত কলেজ/টোল/চতুষ্পাটিতে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ন্যায় সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা পদ্ধতি পরিচালিত হয়ে আসছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যার ফলশ্রুতিতে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষা থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে। এদেশে দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী হিন্দু সম্প্রদায় প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় চেতনাহীন ও নৈতিক শিক্ষাহীন হয়ে গড়ে উঠছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে বিরাট হুমকিস্বরূপ। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষক মাসিক সর্বসাকুল্যে ১৭৯ টাকা এবং কর্মচারীর মাসিক বেতন ৭৮ টাকা বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় শিক্ষায় এহেন লজ্জাষ্কর চিত্র সারাবিশ্বে রয়েছে কি না, তা আমাদের জানা নেই।