৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৭:৩১:০০ অপরাহ্ন


রোহিঙ্গা সব ক্যাম্পেই যৌন হয়রানি হচ্ছে
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৯-২০২৫
রোহিঙ্গা সব ক্যাম্পেই যৌন হয়রানি হচ্ছে একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত গবেষণার ফলাফল প্রকাশ ও সংলাপ অনুষ্ঠানে অতিথিবৃন্দ


রোহিঙ্গা সব ক্যাম্পেই যৌন হয়রানি হচ্ছে। এছাড়া, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে এবং প্রায় অর্ধেক অংশগ্রহণকারী (৪৮%) মনে করেন পুরুষ ও ছেলেদের জন্য কাউন্সেলিং জরুরি। এর পাশাপাশি, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে গড়ে ওঠা সশস্ত্র গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য এবং মাদকের বিস্তার তাঁদের নিরাপত্তা ও সুস্থতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুতির অষ্টম বছরে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরী মেয়েদের সুরক্ষার ঝুঁকি ও ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষার ওপর একটি নতুন গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় উঠে এসেছে তাঁদের জীবনযাত্রার বহুমুখী চ্যালেঞ্জের তথ্য। আর একে এধরনের ঘটনাকে সবচেয়ে ‘বড় উদ্বেগের’ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

গবেষণা অনুযায়ী প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যত বিষয়, বেশিরভাগ নারী (ক্যাম্পভেদে ৫০-৮২%) মিয়ানমারে নিরাপদে প্রত্যাবাসনের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তবে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা তৃতীয় কোনো দেশে অভিবাসনের কথা বলেছেন।

এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা নারী ও মেয়েদের জন্য অবিলম্বে জেন্ডার-সংবেদনশীল সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের প্রয়োজন বলে গবেষণায় সুপারিশ করা হয়েছে। এবং রোহিঙ্গা সংকটে মানবিক সাড়াদান, জলবায়ু কার্যক্রম এবং শান্তি-সম্প্রীতি নিশ্চিত করার জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।

গত ৩১ আগস্ট রোববার গুলশানের একটি হোটেলে একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত গবেষণার ফলাফল প্রকাশ ও সংলাপ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য উঠে আসে। ‘আরার হেফাজত: রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীদের কণ্ঠস্বর মাধ্যমে তাদের সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ, দূতাবাস, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, দাতা সংস্থা, গবেষক, বিশেষজ্ঞ এবং গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা অংশ নেন। 

অনুষ্ঠানের শুরুতে একশনএইড বাংলাদেশ-এর হেড অব হিউম্যানিটারিয়ান প্রোগ্রাম মো. আব্দুল আলীম সংস্থার মানবিক কর্মসূচির একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেন। গবেষণার মূল তথ্য ও ফলাফল উপস্থাপন করেন সংস্থাটির পলিসি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার তামাজের আহমেদ। এরপর গবেষণার রোহিঙ্গা নারী ও মেয়েদের সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটি সংলাপ পরিচালনা করেন একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির।

সংলাপে উঠে আসা মূল আলোচনা:

সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরী মেয়েদের সুরক্ষার বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দেন। তাঁরা বলেন, এই গবেষণার ফলাফল শুধু একটি তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন নয়, বরং এটি রোহিঙ্গা শরণার্থী নারীদের কণ্ঠস্বর, যা তাঁদের বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরে। 

একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, আমাদের গবেষণাটি ছিল অংশগ্রহণমূলক। রোহিঙ্গা নারীরা এখানে নিজেদের কথা বলার চেষ্টা করছেন। সেটাই আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এই নারীরা এখানে আছেন প্রায় আট বছর ধরে। মিয়ানমারে থেকে অন্যায়-অত্যাচার হয়েছিল বলেই তারা এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা যখন এখানে আশ্রয় নেন তখন প্রাথমিক কোনও শেল্টার ছিল না। এখন কিছু হয়েছে। কিন্তু তারপরও তাদের প্রতি সহিংসতা কমেনি, বরং সহিংসতার ধরন বদলেছে। 

এই সংকট মোকাবিলায় অবিলম্বে অধিকারভিত্তিক ও জেন্ডার-সংবেদনশীল কৌশল প্রয়োজন উল্লেখ করে ফারাহ্ কবির বলেন, “এই গবেষণায় আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই, রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীরা আজ বহুমুখী ঝুঁকির মুখে। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিতে এখনই কৌশলগত পরিবর্তন এনে দীর্ঘমেয়াদি, অধিকারভিত্তিক ও জেন্ডার-সংবেদনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।” 

বক্তারা মনে করেন, এই সংকটকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা উচিত নয়, বরং এটিকে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সামগ্রিকভাবে মোকাবিলা করা প্রয়োজন। বাল্যবিবাহ, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা এবং নারী ও মেয়েদের চলাফেরার সীমাবদ্ধতা যে শুধু প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিকতার কারণেই নয়, বরং রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর ভেতরে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা এবং মৌলিক চাহিদা পূরণের সীমাবদ্ধতার কারণেও ঘটছে, তা আলোচনায় উঠে আসে। 

অংশগ্রহণকারীরা জোর দিয়ে বলেন, ক্যাম্পের ভেতরে নারীদের ও কিশোরীদের জন্য নিরাপদ ও পর্যাপ্ত আলোযুক্ত টয়লেট এবং গোসলের স্থান নিশ্চিত করা, নারী নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ দেওয়া এবং নারীদের নেতৃত্বে সুরক্ষা কমিটি গঠন করা জরুরি। পাশাপাশি, সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রভাব কমাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আরও শক্তিশালী করা এবং আইনি সহায়তা সহজলভ্য করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

ইউএন উইমেন-এর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ গীতাঞ্জলি সিং সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলোকে কেবল নারী ও মেয়েদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, সকল ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর জন্য নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে নারী ও মেয়েদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এমন তহবিল হ্রাসের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার বিষয়ে সুপারিশ করেন।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) -এর ডেপুটি কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ জুলিয়েট মুরেকেইসনি জোর দিয়ে বলেন যে, “নারীদের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা এবং পুরুষতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক বাধাগুলো এখনও বড় চ্যালেঞ্জ, এবং পুরুষদের অসম্পৃক্ততা এই অগ্রগতিকে আরও সীমিত করছে।” তিনি ভুক্তভোগী বিশেষত নারী-কিশোরী মেয়েদের দৃষ্টিকোণ সরাসরি কর্মসূচি ও নীতি-নির্ধারণে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়ে জোর দেন।

আইআরসি-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিনা রহমান বলেন, নারীদের দুর্বলতার মূল কারণ মোকাবিলায় ক্ষমতায়ন কর্মসূচির সঙ্গে শিক্ষাকে যুক্ত করা জরুরি। উন্নয়ন কার্যক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল বন্ধের পর জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার ঘটনা বাড়তে পারে বলে তিনি সতর্ক করেন বলেন, তহবিল প্রত্যাহারের প্রভাব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। এই প্রেক্ষাপটে, তিনি তহবিল প্রত্যাহারের পরিণতিগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও ট্র্যাক করার গুরুত্বের ওপর জোর দেন।

এছাড়া, সংলাপে পুরুষ ও ছেলেদের মানসিকতা পরিবর্তন এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাউন্সেলিং কর্মসূচির গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা হয়। এসময় নারী-বান্ধব স্থান, শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগ বৃদ্ধি করে তাঁদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়, যা তাঁদের ঝুঁকি হ্রাস করতে সাহায্য করবে।

এদিকে সুপারিশ বা করণীয় প্রসঙ্গে বলা হয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যথাযথ আলোর ব্যবস্থাসহ সুরক্ষিত, জেন্ডার-ভিত্তিক পৃথক টয়লেট ও গোসলের স্থান নিশ্চিত করা। নারী নিরাপত্তা কর্মী ও নারী-নেতৃত্বাধীন সুরক্ষা কমিটি গঠন করা। সশস্ত্র গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য কমাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যক্রম জোরদার করা এবং মর্যাদা নিশ্চিত করে এমন নারীবান্ধব রিপোর্টিং সিস্টেম স্থাপন করা যা বিদ্যমান প্রক্রিয়াগুলোকে জোরদার করবে। পুরুষ ও কিশোরদের জন্য সচেতনতা ও কাউন্সেলিং কর্মসূচি চালু করা এবং নারী-বান্ধব স্থান, শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগ বৃদ্ধি করা।

এছাড়াও, অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে ইউরোপীয় কমিশনের সুশাসন ও মানবাধিকার বিষয়ক প্রোগাম ম্যানেজার লায়লা জেসমিন, ঢাকায় নিযুক্ত নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের জেন্ডার ও সিভিল সোসাইটি-এর সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজর মুশফিকা সাতিয়ার, এনআরসি-এর পার্টনারশিপ কো-অর্ডিনেটর কানিজ ফাতিমা, জিআইজেড-এর প্রতিনিধি আরসালান সাবিরবেকভ এবং অগ্রযাত্রা-এর নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার চৌধুরীসহ জাতিসংঘ, দূতাবাস, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, দাতা সংস্থা, গবেষক, বিশেষজ্ঞ এবং গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

শেয়ার করুন