৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:১৯:৪৩ পূর্বাহ্ন


দেশকে বাঁধন
স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছিল দায়বদ্ধতা ভয় পাইনি
আলমগীর কবির
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৮-২০২৫
স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছিল দায়বদ্ধতা ভয় পাইনি আজমেরী হক বাঁধন


পাঁচ আগস্ট। জুলাই বিপ্লব’ এর বর্ষপূর্তি। গত বছরের এই সময়টাতে বদলে গিয়েছিল পুরো দেশের চিত্র। আন্দোলনের মুখে হঠাৎ করেই পতন ঘটে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের। রাজপথে সাধারণ মানুষের সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনও। ছিলেন সামনে থেকে নেতৃত্বে, নানা রকম ঝুঁকি নিয়ে। সেই অভিজ্ঞতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, প্রত্যাশা আর নিজের ভেতরে জমে থাকা কথাগুলো নিয়ে কথা বললেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির

প্রশ্ন: আজকের দিনটা নিয়ে কেমন অনুভব করছেন?

বাঁধন: এটা খুব আবেগের একটা দিন আমার জন্য। অনেক বড় অর্জনের দিন। সেই সময়ে আমরা শুধু একটা সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াইনি, দাঁড়িয়েছিলাম অন্যায় আর ভয়ের বিপরীতে। রাজপথে যারা ছিল, তাদের অনেকেই প্রাণ দিয়েছে, কেউ আহত হয়েছে। তাদের কথা মনে হলেই বুকটা কেঁপে ওঠে। আমরা চেয়েছিলাম একটা মানবিক রাষ্ট্র, যেখানে মানুষ কথা বলার সুযোগ পাবে। এখনো মনে হয় সেই স্বপ্নটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো কিছু না। এটাও ঠিক, আমি উদযাপন-ধরনের কিছুতে ততটা বিশ্বাস করি না। বরং মনে করি, আমরা যেন ভুলে না যাই কেন রাস্তায় নেমেছিলাম।

প্রশ্ন: কবে বুঝলেন, আপনাকে রাজপথে নামতেই হবে?

বাঁধন: রিয়া গোপ নামের একটা শিশুর মৃত্যুর পর সবকিছু বদলে যায় আমার ভেতরে। ছাদে খেলছিল, মাথায় গুলি লাগে। তখন শুধু একটা কথাই মাথায় এসেছিল-এই জায়গায় তো আমার মেয়েও থাকতে পারত। এরপর আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। ‘দৃশ্যমাধ্যম সমাজ’ নামে একটা প্ল্যাটফর্মে আমরা কয়েকজন শিল্পী এক হই। নির্মাতা আকরাম খানের ডাকে সাড়া দিই। এরপর থেকেই নিয়মিত রাস্তায় ছিলাম। কোথায় ছিলাম না-আনন্দ সিনেমা হল, প্রেস ক্লাব, শহীদ মিনার, শাহবাগ। আমি শুধু উপস্থিত ছিলাম না, ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলেছি, স্লোগান দিয়েছি।

প্রশ্ন: ভয় লাগেনি একবারও?

বাঁধন: আসলে তখন ততটা ভয় কাজ করেনি। কারণ, চারপাশে এত মানুষ ছিল! এত ছেলেমেয়ে, এত সাধারণ মানুষ যখন রাস্তায় ছিল, তখন মনে হয়েছে, ওরা যদি পারে, আমি কেন পারব না? পরে অবশ্য ভাবলে মনে হয় ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। আমরা জানতাম না সামনে কী হবে। তখনকার সরকার আমাদের যে কোনো কিছু করতে পারত। কিন্তু আন্দোলনের মধ্যে থেকেই আমি সাহস পেয়েছি। ভয় নয়।

প্রশ্ন: আপনাকে তো হুমকি দেওয়া হয়েছিল?

বাঁধন: হ্যাঁ, অনেক রকম হুমকি পেয়েছি। ফোনে বলা হয়েছে চুপ থাকুন, না হলে দেখে নেওয়া হবে। এমনও শুনেছি, অ্যাসিড মারা হতে পারে। কেউ কেউ মেসেজে বলেছে, ‘তোমার মুখটাই মুছে দেওয়া হবে’। এই হুমকিগুলো খুব সহজে নেওয়া যায় না। মাঝে মাঝে গা শিউরে ওঠে। কিন্তু একবারও মনে হয়নি পিছিয়ে যাব। বরং আরও বেশি শক্তভাবে দাঁড়াতে শিখেছি।

প্রশ্ন: অনেকেই আন্দোলনের পরে বিভিন্ন সুবিধা পেয়েছেন, আপনি পাননি। কেন?

বাঁধন: সত্যি কথা বলতে, আমি চাইলেই সেই পথে যেতে পারতাম। আমিও সুবিধা নিতে পারতাম। কিন্তু সেটা করতে চাইনি। আমি নিজে থেকে সবকিছু থেকে দূরে থেকেছি। কারণ, আন্দোলনের মূল্য এভাবে মেপে দেখলে সেটা আন্দোলন থাকে না। আমি কোনো পদ চাইনি, কোনো পুরস্কারও না। শুধু চেয়েছিলাম সত্যের পাশে থাকতে। এখনো সেটাই চাই।

প্রশ্ন: আন্দোলনে নারীদের বড় অংশগ্রহণ দেখা গিয়েছিল। এখন তাঁরা অনেকটাই নীরব। কেন এমন হলো বলে মনে করেন?

বাঁধন: এটা খুবই পরিচিত একটা চিত্র আমাদের সমাজে। যখন দরকার হয়, তখন নারীকে সামনে রাখা হয়। প্রয়োজন ফুরালে তাঁকে ঘরে ফেরত পাঠানো হয়। জুলাই আন্দোলনেও আমরা নারীরা খুব জোরালোভাবে ছিলাম। কিন্তু এখন আমাদের অনেককে বলা হয়, ‘তুমি না বোঝ, রাজনীতি তোমার কাজ না’। এটা আসলে একটা গভীর সামাজিক সমস্যা।

প্রশ্ন: যে স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলনে গিয়েছিলেন, সেটার কতটা পূরণ হয়েছে বলে মনে হয়?

বাঁধন: খুব কম। বলার মতো তেমন কিছু পরিবর্তন আমি দেখি না। হয়তো সরকারের মুখ বদলেছে, কিন্তু ভেতরের কাঠামোটা আগের মতোই রয়ে গেছে।

মিথ্যা মামলা, ভয় দেখানো, নারী বিদ্বেষ, মব দিয়ে হামলা-এসব তো বন্ধ হয়নি। বরং নতুনভাবে মাথা তুলেছে। এত মানুষ রাজপথে নেমে আশা করেছিল সত্যিকারের একটা পরিবর্তন আসবে। সেটা এখনো চোখে পড়েনি।

প্রশ্ন: শহীদদের বিচার ও আহতদের চিকিৎসা প্রসঙ্গে আপনার ভাবনা কী?

বাঁধন: আমি মনে করি, এই কাজগুলো অনেক আগেই শুরু হওয়া উচিত ছিল। যারা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের জন্য আমরা কেবল ফুল দিয়ে দায় শেষ করতে পারি না। তাঁদের পরিবার, আহত মানুষদের চিকিৎসা, নিরাপত্তা-সবকিছুই জরুরি ছিল। যত দেরি হবে, তত ভুলে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। এটা যেন না হয়।

প্রশ্ন: এই আন্দোলন কি আপনার ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলেছে?

বাঁধন: হ্যাঁ, প্রচণ্ডভাবে। আমার তিনটা সিনেমা বাতিল হয়েছে। প্রযোজকরা প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ। এমনকি ভারতের একটি বিজ্ঞাপন কাজও বাতিল হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘আপনাকে সাধারণ মানুষ চেনে না’। সবচেয়ে কষ্ট হয়েছে যখন জানতে পারলাম আড়াই বছর ধরে আমাকে ভারতীয় ভিসা দিচ্ছে না। কারণ, ভিপি নূরের সঙ্গে আমার একটা ছবি ছিল। এতো হাস্যকর কারণেও কীভাবে একটা শিল্পীকে থামিয়ে দেওয়া হয়, সেটা আমি বুঝে উঠতে পারি না।

প্রশ্ন: এই অবস্থায় কখনো মনে হয় আপোষ করলে ভালো হতো?

বাঁধন: না, কখনোই না। বরং আমি গর্বিত। আমি জানি আমি সঠিক পক্ষে ছিলাম। আমি কাউকে আঘাত করিনি, কারও বিরুদ্ধে গিয়েও সুবিধা নিইনি। আমার আত্মসম্মানটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

প্রশ্ন: আগামী বাংলাদেশকে আপনি কেমন দেখতে চান?

বাঁধন: আমি চাই একটা মানবিক বাংলাদেশ। যেখানে কেউ কাউকে ভয় না দেখায়, কেউ কারও অধিকার কেড়ে না নেয়। নারী, ধর্ম, ভাষা, পরিচয়ের ভেদাভেদ থাকবে না। সবাই সম্মান পাবে, কথা বলার সুযোগ পাবে। এই স্বপ্নটা এখনো বাঁচিয়ে রেখেছি আমি।

প্রশ্ন: শেষে যদি কিছু বলতে চান?

বাঁধন: সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সৎ থাকার অনুরোধ করব। পরিবর্তন বাইরে থেকে আসে না, আসে নিজের ভেতর থেকে। আমরা সবাই যদি একটু সততার সঙ্গে চলতে পারি, তাহলে হয়তো একদিন সত্যিই বদলে যাবে আমাদের দেশটা।

শেয়ার করুন