১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ০৪:০৩:৫৮ পূর্বাহ্ন


স্পর্শকাতর রাখাইন করিডোর বাংলাদেশকে গভীর সংকটে ফেলবে
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-০৭-২০২৫
স্পর্শকাতর রাখাইন করিডোর বাংলাদেশকে গভীর সংকটে ফেলবে রাখাইনের মানচিত্র


অবস্থাদৃষ্টিতে প্রতীয়মান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সচেতন বা অচেতনভাবে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারে পরাশক্তিগুলোর মল্লযুদ্ধের চারণ ভূমি হওয়ার ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে সম্পদ সমৃদ্ধ মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ এখন বিদ্রোহী বাহিনীর দখলে। মায়ানমার সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব সেখানে নেই বললেই চলে। রাখাইন এলাকা থেকে বিশাল রোহিঙ্গা গোষ্ঠীকে বাংলাদেশ পুশ করা হয়েছে। মায়ানমার সরকারি বাহিনী সেখানে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে। 

বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী সেখানে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করছে। অভিযোগ আছে সীমান্ত-সংলগ্ন বাংলাদেশ এবং ভারতের দুর্গম এলাকায় আশ্রয় নিয়ে বিদ্রোহী বাহিনী প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। সবাই জানে মূল্যবান খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ রাখাইন প্রদেশ তথা মায়ানমার নিয়ে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া সবার আগ্রহ থাকলেও এখন পর্যন্ত চীনের নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুুশ। চীন এ অঞ্চলের বন্দর সুবিধা ব্যবহার করে বঙ্গোপসাগরের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে অনেটাই এগিয়ে আছে। দীর্ঘদিন যাবৎ যুক্তরাষ্ট্র এই একাধিপত্বে ভাগ বসাতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তির জন্য তাই বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য এ অঞ্চল স্পর্শকাতর। অনেকের ধারণা রাখাইন কোরিডোর স্থাপনের তোড়জোড় অনেকটাই চীনের আধিপত্য খর্ব করার প্রয়াস। এ করিডোর স্থাপিত হতে পশ্চিমা শক্তি এই পথে বিদ্রোহী বাহিনীকে অস্ত্র এবং রসদ সরবরাহ করতে পারবে। সেই প্রক্রিয়া সংগত কারণেই চীন এবং মায়ানমার স্বার্থবিরোধী হবে। ভারত তার পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে বিধায় কোনোভাবেই এ প্রয়াসকে সমর্থন দেবে না। বাংলাদেশের হয়েছে উভয় সংকট। তথাকথিত ডিপ স্টেট পরিকল্পনায় সরকার পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার রাখাইন করিডোর বিষয়ে জোরালো অবস্থান নিতে পারছে না। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতির সঙ্গে হয়ত পরোক্ষভাবে রাখাইন করিডোর প্রসঙ্গ জড়িত আছে। বাংলাদেশ কোনোভাবেই নিজেদের উত্তরপূর্ব সীমান্ত অঞ্চলকে আঞ্চলিক সংঘাতের থিয়েটার বানানোর ঝুঁকি নিতে পারে না। বাংলাদেশের স্মরণ রাখতে হবে গাজা উপত্যকার পরিণতির কথা। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ইতোমধ্যেই প্রভাবশালী প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে। কোনোভাবেই সরকার চীন, রাশিয়ার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক স্থাপন করে স্বস্তিতে থাকতে পারবে না। আবার যুক্তরাষ্ট্রের খপ্পড়ে পড়লেও বাংলাদেশের অর্থনীতি দারুণ সংকটে পড়বে। সরকারের উচিত হবে রাখাইন করিডোর বিষয়ে দেশের সকল রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী এবং সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে পরিকল্পনা গ্রহণ।

এদিকে করিডোর দেওয়া প্রসঙ্গে দেশের অভ্যন্তরেও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এমন প্রসঙ্গে কথা বলছেন এবং তারা এতে সম্মতি নেই স্পষ্ট জানিয়েও দিয়েছেন। সরকার এটাতে যাচ্ছেনা বলে আশ্বস্ত করলেও অনেকেই সরকারের কথায় আশ্বস্থ হতে পারছেন না। গত মে মাসে এক অনুষ্ঠানে গৃহযুদ্ধে জর্জরিত মিয়ানমারের রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মানবিক করিডোরের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করেনি বলে জানিয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান।

৪ মে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন : আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর প্রভাব এবং ভবিষ্যত’ শীর্ষক এক সেমিনারে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এ কথা জানান।

নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, মানবিক করিডোর নিয়ে সরকার কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। এটি নিয়ে কেবল প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ আমেরিকার হয়ে আরাকানে প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করছে-এমন গুজব কিছু প্রতিবেশী দেশের গণমাধ্যম ছড়াচ্ছে, যা কখনো কাম্য নয়। খলিলুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের কখনোই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। যদি সেটা করা হয়, তাহলে বাংলাদেশ হবে প্রতিবেশী দেশগুলোর ডাম্পিং গ্রাউন্ড। সেমিনারে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বক্তব্য দেন।

মানবিক করিডোর দেওয়া নিয়ে এর আগে এপ্রিল মাসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ এটা হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ) হবে। কিন্তু আমাদের কিছু শর্ত রয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পর রাখাইনে করিডোর দেওয়া নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা ও সমালোচনা শুরু হয়। সামনে আসে নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টি।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যের পর করিডোর দেওয়া নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে ভিন্ন বক্তব্যও এসেছে। উপদেষ্টার বক্তব্যের দুদিন পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, সরকার জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে তথাকথিত মানবিক করিডোর নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি। এখনো রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। আমাদের অবস্থান হলো, যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে রাখাইনে মানবিক সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে বাংলাদেশ লজিস্টিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে। আমরা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। যথাসময়ে এ বিষয়ে দেশের প্রাসঙ্গিক স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।

এদিকে পরবর্তীতে ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর মুখপাত্র বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশ হয়ে করিডোর করে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে গেলে জাতিসংঘকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এটি পূরণ না হলে জাতিসংঘের সরাসরি ভূমিকা রাখার সুযোগ সীমিত।

শেয়ার করুন