৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:১৯:৫৪ অপরাহ্ন


গোপন ওয়াচলিস্ট কর্মসূচি বন্ধ করলো ডিএইচএস
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০৬-২০২৫
গোপন ওয়াচলিস্ট কর্মসূচি বন্ধ করলো ডিএইচএস ইউএস হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট (ডিএইচএস)


৯/১১ হামলার পর নিরাপত্তা জোরদারের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় নজরদারি কাঠামোর অংশ হিসেবে ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (টিএসএ)-এর মাধ্যমে চালু হয় ‘কুইয়েট স্কাইস’ বা গোপনে ওয়াচলিস্ট কর্মসূচি। এর ফলে বহু নিরপরাধ মুসলিম হয়রানির শিকার হন। এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল এমন এয়ারপোর্টে যাত্রীদের চিহ্নিত করা, যারা অতীত রেকর্ডে সন্দেহভাজন না হলেও আচরণগত দিক থেকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হতে পারেন যেমন- অস্বাভাবিকভাবে অস্থির থাকা, গভীরভাবে তাকানো বা ঘন ঘন মাথা ঘোরানো। মূলত, এটি টিএসএ এবং বিমানবন্দরের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর জন্য মুসলিমদের ওপর প্রোঅ্যাকটিভ নজরদারির একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

২০১৮ সালে কেয়ার এই কর্মসূচি এবং সমগ্র ফেডারেল ওয়াচলিস্ট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি সাংবিধানিক মামলা দায়ের করে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ৯-০ ভোটে একটি রায় দেয়, যা এই ধরনের নজরদারির বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে। এর ফলস্বরূপ, ইউএস হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট (ডিএইচএস) গত ৫ জুন ঘোষণা দেয় যে তারা বিতর্কিত ‘কুইয়েট স্কাইস’ বিমানযাত্রী নজরদারি কর্মসূচি বন্ধ করছে। ডিএইচএস জানায়, এই কর্মসূচি শুরু থেকে একটি সন্ত্রাসী হামলাও প্রতিরোধ করতে পারেনি, অথচ এতে প্রতি বছর প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার করদাতার অর্থ ব্যয় হয়েছে। একই সঙ্গে তারা দাবি করে, এই কর্মসূচি ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ ছদ্মাবরণে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে টার্গেট ও মিত্রদের সুবিধা দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে যে, ‘কুইয়েট স্কাইস’ কর্মসূচি মুসলিম, আরব ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বৈষম্যমূলক আচরণ করতে ব্যবহৃত হয়েছে। টিএসএর কিছু কর্মকর্তা ও স্বাধীন গবেষকরাও বলেন, আচরণভিত্তিক এই নজরদারি পদ্ধতি প্রায়ই ভুল সিদ্ধান্ত দেয় এবং বৈজ্ঞানিকভাবে এটি অবিশ্বস্ত।

ডিএইচএস সেক্রেটারি ক্রিস্টি নোএম এক বিবৃতিতে বলেন, স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে ‘কুইয়েট স্কাইস’ কর্মসূচিটি বাইডেন প্রশাসনের রাজনৈতিক টার্গেটিংয়ের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। এটি দেশের নিরাপত্তার বদলে ক্ষমতাসীনদের বন্ধুবান্ধবকে উপকার দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি এই বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ কংগ্রেসনাল তদন্তের আহ্বান জানান।

এই কর্মসূচির আওতায় ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (টিএসএ) নিয়মিতভাবে যাত্রীদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করতো, যেমন- অস্থিরভাবে বসা, গভীরভাবে তাকানো বা ঘন ঘন মাথা ঘোরানোর মতো কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে তাদের সন্দেহভাজন হিসেবে টার্গেট করা হতো। তবে বহু মানবাধিকার সংগঠন ও কিছু আইনপ্রণেতা এই মডেলকে বৈষম্যমূলক ও অবৈজ্ঞানিক বলে নিন্দা করেছেন।

সাম্প্রতিক এক অভ্যন্তরীণ তদন্তে ডিএইচএস দাবি করে, তারা এমন নথিপত্র ও যোগাযোগ পেয়েছে যা কর্মসূচির অপব্যবহার ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের প্রমাণ দেয়। তারা জানিয়েছে, নিউ হ্যাম্পশায়ারের সিনেটর জিন শাহিনের স্বামী উইলিয়াম ‘বিলি’ শাহিন এই নজরদারির আওতায় পড়েছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তাকে ওয়াচলিস্ট থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।

তবে বিলি শাহিনের সঙ্গে ভ্রমণকারী অভিবাসন আইনজীবী সেলিন আতাল্লাহ জানান, তিনিই সেই ‘সন্দেহভাজন সহযাত্রী’। তিনি একজন মার্কিন নাগরিক, লাইসেন্সধারী আইনজীবী এবং কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নন। তিনি বলেন, এটি একেবারেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

ডিএইচএস জানিয়েছে, এখন থেকে টিএসএ শুধু প্রকৃত বাণিজ্যিক বিমান নিরাপত্তা হুমকির ভিত্তিতে যাত্রী যাচাইয়ের কাজ চালাবে এবং ২০২৫ সালের মে মাসে চালু হওয়া ‘রিয়েল আইডি’ আইন নিরাপত্তা আরো জোরদার করবে।

কেয়ারের সিনিয়র আইনজীবী গাদেয়ার আব্বাস বলেন, এই ধরনের নজরদারি কর্মসূচি নির্দোষ নাগরিকদের রাজনৈতিক কারণে টার্গেট করার সুযোগ তৈরি করে। এটি বন্ধ হওয়া অত্যন্ত জরুরি ছিল। তবে তিনি সতর্ক করেন, এখনো ফেডারেল সরকারের গোপন ওয়াচলিস্ট রয়ে গেছে, যা বাস্তব নিরাপত্তা না দিয়ে শুধু করদাতার অর্থ অপচয় করে। ২০১৮ সালে, কেয়ার যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ওয়াচলিস্টিং ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি বিস্তৃত সাংবিধানিক মামলা করে। এই মামলায় বিতর্কিত ‘কুইয়েট স্কাইস’ কর্মসূচিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। মামলাটি মেরিল্যান্ডের ইউএস ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে দায়ের করা হয় ২০ জন ব্যক্তির পক্ষে, যাদের এই তালিকার মাধ্যমে টার্গেট করা হয়েছিল। মামলায় বলা হয়, এই ওয়াচলিস্ট ব্যবস্থা আমেরিকান নাগরিকদের ওপর ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত’ চাপিয়ে দেয়।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে কেয়ার জানায়, তারা মিলান কোভাক বনাম ক্রিস্টোফার রেমামলায় একটি সার্টিওরারি পিটিশন দাখিল করেছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টকে অনুরোধ করা হয় পঞ্চম সার্কিট কোর্টের সেই রায় পর্যালোচনা করতে, যেখানে সরকারের ‘অরওয়েলিয়ান’ ওয়াচলিস্ট ব্যবস্থাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল।

নভেম্বর ২০২৪-এ কেয়ার খাইরুল্লাহ বনাম গারল্যান্ড মামলায় ম্যাসাচুসেটসের একটি ফেডারেল আদালতে শুনানিতে অংশ নেয়। এটি ছিল ১৫ জন মার্কিন মুসলিমের পক্ষ থেকে দায়ের করা মামলা, যাদের অন্যায়ভাবে সন্ত্রাসবাদী ওয়াচলিস্ট ও ‘নো ফ্লাই লিস্ট’-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেই বছরের মার্চে, কেয়ার যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের ৯-০ রায়কে স্বাগত জানায়, যেখানে আদালত সরকারের আপত্তি সত্ত্বেও ইউনুস ফিকিরের পক্ষের মামলা চলতে দেওয়ার অনুমতি দেয়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট বিতর্কিত ওয়াচলিস্টিং কর্মসূচি বন্ধ করার সিদ্বান্ত নেয় । কেয়ার একে মুসলিমদের জন্য একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে বর্ণনা করে।

বিশ্লেষকদের মতে, ‘কুইয়েট স্কাইস’-এর অবসান যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও গোপন নজরদারি ব্যবস্থা ও এর রাজনৈতিক অপব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত নাগরিক স্বাধীনতা হুমকির মুখে থাকবে।

শেয়ার করুন