৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:৪৯:৫৭ অপরাহ্ন


সর্বদলীয় সরকার গঠনের পরামর্শ
ষড়যন্ত্র অব্যাহত : ছাত্রশক্তি সজাগ থাকুক
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-১১-২০২৪
ষড়যন্ত্র অব্যাহত : ছাত্রশক্তি সজাগ থাকুক


কুচক্রী মহলের কুট চাল বাস্তবায়নের অপকৌশলে বিভ্রান্ত হয়ে এই মুহূর্তে ভুল সিদ্ধান্তের পথে হেঁটে দেশে সংকট সৃষ্টির সিদ্ধান্ত থেকে আপাতদৃষ্টিতে সরে এসেছে সরকার। বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো হুটহাট রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে সরকারকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে ভালো কাজ করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ কোনো রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম নয়। ওদের ব্যবহার করে কোনো রাজনৈতিক শক্তি নিজেদের ফায়দা লোটার জন্য দেশে অগণতান্ত্রিক শক্তিতে ক্ষমতায় এনে গণতন্ত্রযান প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করুক সেটি দেশপ্রেমিক কারো কাম্য নয়। ছাত্রশক্তি অবশ্যই সজাগ থাকা প্রয়োজন যেন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কোনো অশুভ শক্তি গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত না করে। 

কিছুটা বিলম্বে হলেও সরকার নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া হিসেবে নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যে সার্চ কমিটি গঠন করেছে। সার্চ কমিটিকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিজনের জন্য দুইজন করে যোগ্য, অভিজ্ঞ, দল নিরপেক্ষ ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সব অংশীজনের সঙ্গে আলাপ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুত সময়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করবে এটাই প্রত্যাশা। বলা যায়, সরকার অবশেষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে হাঁটতে শুরু করেছে। নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্য সংস্থাগুলো বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় সরকার এগুলোর অতিপ্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত সমাধান করে সরকার দ্রুততম সময়ে নিরপেক্ষ, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করুক এটাই সবার কামনা। মনে রাখতে হবে, এক রাজনৈতিক সংস্কারকাজ অরাজনৈতিক, অনির্বাচিত সরকার করতে পারবে না। তবে গণতন্ত্রায়নের পক্ষে ন্যূনতম যতটুকু প্রয়োজন সেটুকু তারা যত দ্রুত শেষ করে সেটি মঙ্গল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজকে মনে রাখতে হবে কোনো মীমাংসিত বিষয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে যেন নতুন করে বৈষম্য সৃষ্টি না হয়। দোষী খুনিদের সঠিকভাবে বিচার হোক, প্রচলিত বিচারব্যবস্থা বা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে স্বচ্ছ নিরপেক্ষভাবে বিচারের মাধ্যমে দোষী খুনিরা শাস্তি পাক। কিন্তু বিচারের আগেই যেন জোর করে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থাকে দ- পেতে না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। জুলাই-আগস্ট, এমনকি এখনো দেশে অনেক অপরাধ হচ্ছে। কোনো অপরাধীকেই আইনের দৃষ্টিতে বৈষম্য করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সব নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিয়েছে ছাত্র-জনতা। কনস্টিটিউশন বজায় রেখে সেটি সমুন্নত রাখার শপথ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তিন মাস পর এসে কোনো জুজুর ভয় দেখিয়ে সেখান থেকে সরে এসে সংকট সৃষ্টি আত্মঘাতী হতে পারে।

আরো একটি ঘটনা যেটি অবশেষে ঘটেছে, সেটি হলো দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান এবং শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগ। বলতে দ্বিধা নেই এ কমিশন কখনোই স্বাধীন-নিরপেক্ষ ছিল না। বিগত সময়ে যে অবাধ দুর্নীতি হয়েছে, তাকে বরং পৃষ্ঠপোষকতা করেছে আমলানিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি দমন কমিশন। মহাদুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনার কোনো ব্যবস্থাই গৃহীত হয়নি। যদি কমিশন কার্যকর থাকতো, তাহলে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট করে বিদেশে পাচার হতো না। সব সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির চারণ ভূমিতে পরিণত হতো না। সরকার কমিশনে নতুন চেয়ারম্যান এবং শীর্ষ কর্মকর্তা নিয়োগের পাশাপাশি সেখানেও প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে পারবে। পূর্ববর্তী কমিশন চেয়ারম্যান এবং কর্মকর্তাদের কার্যক্রম অনুসন্ধান করে দুর্নীতির সহায়ক ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে পারে। এ সরকারের কার্যকালে অন্তত ২০ জন শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের বিচার হয়ে শাস্তি হলে অন্য দুর্নীতিবাজরা কঠিন সংকেত পাবে। রাজনীতিতে কালো অর্থ এবং পেশির অশুভ প্রভাব দূর হবে।

রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হয়েছে, শুভ লক্ষণ। একটি মিডিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রশক্তির একজন নেত্রীকে বলতে শুনেছি তারা কোনো রাজনৈতিক দলের ছায়া প্রতিষ্ঠান নয়। আশ্বস্ত হওয়ার মতো কথা। দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ওদের ছিল মুখ্য ভূমিকা। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিষ্ঠার অতন্দ্র প্রহরী হয়ে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ। শুভ কাজে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে সমাজে বিরাজ করুক আশা করবো। সেই সঙ্গে সামাজিক কাজে ছাত্রদের অধিকতর অংশগ্রহণ সমাজ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর শুভ প্রভাব আশু পড়বে নিঃসন্দেহে। দেশ সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে গণতন্ত্রায়নের পথে এগিয়ে যাক, প্রার্থনা।

দেশে প্রাধিকার নির্ধারণ এখন জরুরি 

জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের ফলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সংবিধান সুসমন্বিত রেখে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এখন অসংখ সমস্যা এবং সংকট। দীর্ঘদিনের জবাবদিহিতাহীন একনায়কতন্ত্রের কারণে রাষ্ট্রীয় জীবনে, সমাজ জীবনে পুঞ্জীভূত হয়েছে নানা সমস্যা, নানা সংকট। একটি অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে সব সমস্যা সংকট সীমিত সময়ে সমাধান করে দ্রুত নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। জাতির এ সংকট মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ন্যূনতম ইস্যুর ভিত্তিতে দেশপ্রেমিক শক্তিগুলোর একটা প্রাধিকার নির্ধারণ। কৌশলগত কারণে এ মুহূর্তে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি বুদ্ধিমানের কাজ নয়। দেখছি, শুনছি স্বল্প অভিজ্ঞ ছাত্রনেতাদের সুরে সুর মিলিয়ে কিছু প্রান্তিক নেওয়া সরকারকে সংবিধান স্থগিত করে বিপ্লবী সরকার বা সর্বদলীয় সরকার গঠনের পরামর্শ দিচ্ছে। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের পরামর্শ কতটা বাস্তব সম্মত?

সরকার গঠনের তিন মাস হতে চললো। সরকার কিন্তু সংবিধানের অধীনে বর্তমান রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছে। এখনো সংবিধান বহাল আছে। দেশে আইনের শাসন এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পুলিশ পূর্ণমাত্রায় কাজ শুরু করেনি। জনপ্রশাসনেও অস্থিরতা। আন্দোলন উচ্ছৃঙ্খলা চারদিকে। সিন্ডিকেট, দখল বাণ্যিজ্যের হাত পরিবর্তন হয়েছে। এ মুহূর্তে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নতুন করে সংকট সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে বিপ্লবী সরকার গঠন করতে হলে অন্যতম স্টেকহোল্ডার সেনাবাহিনীর কথা ভাবতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলে কি প্রতিক্রিয়া হয়, সেটিও বিবেচনাযোগ্য। সবকিছু বিবেচনা করার কথা বলে অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি ঝটপট কিছু না করার পরামর্শ দিয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় কোনো দল বা গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ করা সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। একটি অরাজনৈতিক সরকার এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ভুল করেছে সময়েই তার জবাব মিলবে। পতিত সরকার শেষ মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে ভুল করেছিল।

বর্তমান সরকার এখনো কিন্তু জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ড, লুটপাট, ধ্বংসযজ্ঞের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেনি। হত্যাকাণ্ডের মামলাসমূহ করা হয়েছে ত্রুটিপূর্ণভাবে। আন্তর্জাতিক মহলেও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে ইতিমধ্যেই সংশয় সৃষ্টি হতে শুরু করেছে। দেশে কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সামরিক বাহিনী অনির্দিষ্টকাল মাঠে থাকবে না। জনগণ কিন্তু এখনো স্বস্তি পাচ্ছে না, সমাজজীবনে কিন্তু গুণগত পরিবর্তন আসেনি। যতদিন যাবে, জনমনে ক্ষোভ বৃদ্ধি পাবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা সর্বস্তরে বৈষম্য দূর করার জন্য কাজ করলে ভালো হয়। সাধারণ মানুষ এখনো কিন্তু নিদারুণ বৈষম্যের শিকার। দেশে কে প্রেসিডেন্ট, কে প্রধান উপদেষ্টা, সেটিতে কিন্তু খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কিছু যায়-আসে না। তারা চায় সারাদিনের পরিশ্রম শেষে দুই মুঠো ক্ষুধার অন্ন, শান্তিতে নিরাপদে ঘুমাতে। গত তিন মাসে সেটি কিন্তু নিশ্চিত হয়নি। কবে সেটি কীভাবে করা যায়, সেটি এখন প্রাধিকার হওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, রাজপথে কিন্তু ছাত্রদের সঙ্গে জনতা ছিল, এখন কিন্তু জনতাকে ভুলে গেলে চলবে না। জনতার শক্তি বিশাল শক্তি।

এখন যারা মিডিয়ায় আওয়ামীবিরোধী, ভারতবিরোধী বিপ্লবী কথা বলছে, তাদের কেউ কেউ যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল, তখন ভারত তোষণ করেছে, ভারতের কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে এনে ব্যবসার সুযোগ করতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি। ভারতের আগ্রাসন বিষয়ে নিশ্চুপ থেকেছে। আমি মনে করি, কারো কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখে দ্রুত ন্যূনতম সংস্কার করে নির্বাচনী পথনকশা ঘোষণা করা। জনগণের পাশাপাশি মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো ধৈর্য হারালে কিন্তু বিপদে পড়বে সরকার। একতা বিনষ্ট হলে কিন্তু সরকারের বৈধতা নিয়ে শুরু হয় মৃদু গুঞ্জন স্লোগানে রূপান্তরিত হবে, হাজার ছাত্র-জনতার আত্মাহুতি তখন বৃথা যাবে। যার জন্য প্রধান উপদেষ্টা ইতিমধ্যে জাতিকে সতর্ক করেছেন।

মনে রাখতে হবে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করে বিপ্লবী সরকার বা সর্বদলীয় সরকার গঠনের মতো অনুকূল পরিবেশ এখন দেশে নেই। এটি জোর গলায় যে যাই বলুক, বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। এখন প্রাধিকার সর্বস্তরে যতটা সম্ভব জাতীয় ঐক্য ধরে রাখা এবং আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির প্রতি নজর দেওয়া। বাংলাদেশ কিন্তু কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়, ভৌগোলিক বাস্তবতাও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশকে। 

শেয়ার করুন