নানা প্রাকৃতিক এবং বৈষয়িক সংকটের কারণে বাংলাদেশ এখন ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছে। এর মধ্যে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলোর লাগাতার আন্দোলন। সড়ক মহাসড়কগুলোতে যান চলাচল বিঘ্নিত হওয়ায় জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। উচ্চ আদালতে বিষয়টি বিচারাধীন। সব পর্যায়ে সংযম যখন আকাঙ্ক্ষিত তখন সরকারকে অস্থির মনে হচ্ছে। সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ইতিমধ্যে তাদের নিজস্ব পর্যালোচনা করার পর প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে কিছু কথা বলেছেন সেটি তিনি না বললেও পারতেন।
আন্দোলনকারীরা তাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে স্মারক লিপি দিয়েছে। সরকারপ্রধান এই বিষয়টি দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সচিবের ওপর ছেড়ে দেওয়া সমীচীন। প্রধানমন্ত্রী ভারত, চীন সফর বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিষয়বস্তুর ওপর বক্তব্য সীমিত রাখলে প্রতিক্রিয়া হতো না। আন্দোলনকারীরা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সুযোগ পেতো না। এরপর ছাত্রলীগের সঙ্গে কোটা আন্দোলনকারীদের মধ্যে যা ঘটলো তা রীতিমতো নজিরবিহীন। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এমনটা কেউ প্রত্যাশাও করেনি। আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলার দৃশ্যগুলো মোটেও ভালো লাগেনি।
আমি একই সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের রাজাকার বলে স্লোগান দেওয়াকেও ধৃষ্টতা বলে নিন্দা জানাচ্ছি।
সত্যিকার আর্থেই দেশের পরিস্থিতি কিন্তু ভালো না। অর্থনৈতিক সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের অনিয়ন্ত্রিত ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি-বিদ্যুৎ সংকটের পাশাপাশি দুর্নীতির সাগর চুরি একের পর এক উন্মুক্ত হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়েও জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। এ মুহূর্তে বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী নানাভাবে সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়ে যে কোনো আন্দোলনকে উসকে দিতে পারে। কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি আছে। এমন একটি প্রসঙ্গ নিয়ে সরকারকে আরো সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন। ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক, আইনমন্ত্রী, তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কথা বলেছেন। সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন এ বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার করেছে। এমতাবস্থায় সরকারপ্রধান নতুন করে এমন কিছু বলা হয়তো সঠিক হয়নি। সব বিষয়ে কেন সরকারপ্রধানকে কথা বলতে হবে?
প্রধানমন্ত্রী দেশের সরকারপ্রধান। যে কোনো সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেষ ভরসা। এমন কিছু তার বলা উচিত নয়, যা বিতর্ক সৃষ্টি করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই শান্তিপূর্ণ সমাধান কাম্য।
কোটাবিরোধী আন্দোলন স্থবির করেছে বাংলাদেশ
এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোটাবিরোধী আন্দোলন স্থবির করেছে বাংলাদেশকে। চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনের আড়ালে ‘বাংলা ব্লকেড’ ঢাকাসহ সমগ্র দেশকে অচল করে ফেলেছে। নানা গুজব ডালপালা মেলছে। ধারণা করা হয়েছিল শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। শেষ পর্যন্ত হলোও তাই। দেশজুড়ে নানা ধরনের দুর্নীতির রূপকথা উন্মোচন এবং দেশব্যাপী বিরাজমান গ্যাস-বিদ্যুৎ মহাসংকট ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। তবে চলতি সংকট অবিলম্বে উত্তরণ করা না হলে সরকার বিপদে পড়তে পারে। এমনিতেই নানা কারণে সাধারণ জনসাধারণ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে আছে। সরকারবিরোধী রাজনীতি দিশেহারা, তাই সরকারের কাছে সুযোগ আছে অবিলম্বে কোটা আন্দোলনকারীদের এক দফার দাবি কোটা সংস্কার যৌক্তিকভাবে করে আন্দোলনের ইতি টানার। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।
বিস্ময় জেগেছে কেন বর্তমান আন্দোলন থেকে ‘বাংলা ব্লকেড’ কথাটির উৎপত্তি ঘটলো। বাংলা বলতে কোনো দেশ নেই। আর ব্লক কথাটা সচরাচর বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হলেও আন্দোলনে এটা বাক্য নতুন। মূল সমস্যা ২০১৮ সালে সরকারি চাকরির কয়েকটি পর্যায়ে কোটা বাতিল পরিপত্র আদালতে বাতিল ঘিরে। সেই আদেশ আপিলেট ডিভিশন স্থগিত করেছে। ৭ আগস্ট হেয়ারিংয়ের পর চূড়ান্ত আদেশ ঘোষিত হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ১৯৭১। মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানে বাংলাদেশ। স্বাধীনতা এবং শোষণহীন সমাজব্যবস্থা ছাড়া কিছুই চাননি কোনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পরেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বা রাজাকারদের তালিকা হয়নি। অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের উল্টো স্রোতে নিয়ে গেছে। দেশজুড়ে দুর্নীতি, অপরাজনীতি। মেধাবী জনগোষ্ঠী সার্বিকভাবে বঞ্চিত। বেকার সমস্যা প্রকট। এমতাবস্থায় দেশের কনস্টিটিউশন অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার সংস্কার যৌক্তিক দাবি। ৫৩ বছর পর আমি মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখা যুক্তিযুক্ত নয়। আর সরকারি চাকরিতে প্রশ্ন ফাঁসসহ স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতির ভয়াবহ রূপ এখন দৃশ্যমান।
এ ব্যাপারে সরকারপ্রধান অবিলম্বে উদ্যোগী হয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা যৌক্তিকভাবে সংস্কার করার জন্য জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়ন করেন। ছাত্রদের প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে অঙ্গীকার করা হলে ছাত্রসমাজ পড়ার টেবিলে ফিরে যাবে। দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ করতে হলে মেধার প্রকৃত মূল্যয়ন অপরিহার্য। বিদ্যমান অবস্থায় এবং সরকারি চাকরিতে দুর্নীতি নির্মূল না হলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শই ভূলুণ্ঠিত হতে থাকবে। মেধাহীন দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ভেঙে পড়বে। এমনিতেই কিন্তু নানা সংকটে আধার ঘনিয়ে আসছে। কোটাবিরোধী আন্দোলন অবিলম্বে ইতি টানা জরুরি।