৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:৪২:৪৭ অপরাহ্ন


টাইম ম্যাগাজিনের খালাতো ভাই!
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৭-২০২৪
টাইম ম্যাগাজিনের খালাতো ভাই!


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতি সপ্তাহে মুদ্রণ আকারে প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিনের কথা আমরা অনেকেই জানি। মূলত রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহকে ঘিরেই এটি প্রকাশিত হয়। প্রচার সংখ্যার দিক থেকে এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ সাপ্তাহিক হিসেবে বিবেচিত এবং এর পাঠকের সংখ্যা প্রায় ২৫ মিলিয়ন। যার মধ্যে ২০ মিলিয়নই মার্কিনি। উল্লেখ্য, ১৯২৩ সাল থেকে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। 

তবে ইদানীং ‘দিস টাইম ম্যাগাজিন’ নামে একটি পত্রিকা নিউইয়র্কে চোখে পড়ছে। মার্কেটে চোখে না পড়লেও ফেসবুকে এর কপি দেখা যায়। আর প্রচ্ছদ কভারে শোভা পায় বাংলাদেশিদের ছবি। আর কভার পেজে যে বাংলাদেশির ছবি দেখা যায়, তাকে এই বলে বন্ধুমহলে প্রচারণা চালাতে দেখা যে, টাইম ম্যাগাজিনে আমার ছবি ছাপা হয়েছে। 

কমিউনিটিতে নানা ঝড়

আপাতত ডক্টরেট ঝড় থেমেছে কমিউনিটিতে। সর্বশেষ নিউইয়র্কে একজন বাংলাদেশি ইমাম একসঙ্গে দুটো ডক্টরেট নিয়েছেন। নিতেই যখন হবে তাহলে কম নিয়ে লাভ কি! অন্যরাও যারা অর্থ খরচ করে এসব ডিগ্রি নেওয়ার জন্য উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলেন তারাও আপাতত সে চেষ্টায় একটু বিরতি দিয়েছেন। এ নিয়ে সম্প্রতি লেখালেখি হওয়ায় সম্ভবত লোকলজ্জার ভয়েই এ সাময়িক বিরতি। 

এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়লো-

জ্ঞান তাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বৈঠকখানায় বসে লিখছেন। এমন সময় ঘরে ঢুকলেন ড. কাজী মাজহারুল ইসলাম। তিনি ড. শহীদুল্লার ছাত্র ছিলেন। ড. শহীদুল্লাহ লেখায় ব্যস্ত। তিনি সামনেই বসলেন। ড. শহীদুল্লাহ লিখেই চলছেন। তিনি উসখুস করছেন। কিন্তু ড. শহীদুল্লাহ তার দিকে চোখ তুলেও তাকাচ্ছেন না। অনেক্ষণ অপেক্ষা করে শেষমেশ বলেই ফেললেন-স্যার আমি দুটো ডক্টরেট নিয়েছি। ড. শহীদুল্লাহ চোখ না তুলে লেখায় ব্যস্ত থেকেই বললেন-হ্যাঁ, গরুরও তো দুটো শিং থাকে। এতে হয়েছে কি! সম্ভবত তার অহংকারী ছাত্রটিকে এভাবেই জবাব দেওয়াটা বেছে নিয়েছিলেন। 

মানবতার ফেরিওয়ালা এবং সব্যসাচী লেখক

কিছুদিন কমিউনিটিতে কথায় কথায় মানুষের বিশেষণ ছিল-মানবতার ফেরিওয়ালা, সাদা মনের মানুষ ইত্যাদি। অবশ্য তারা কতটা সাদা মনের মানুষ বা মানবতার ফেরিওয়ালা এগুলোর প্রমাণ কেউ নিতে যায়নি। গত সপ্তাহে খুবই সাড়ম্বরে সঙ্গে একটা সাহিত্য সংগঠনের অনুষ্ঠান হলো নিউইয়র্কের একটি কমিউনিটি সেন্টারে। সাহিত্য সংগঠনের অনুষ্ঠান বড় পরিসরে কমিউনিটি সেন্টারে হয় তা আমাদের গর্বিত করে। ফেসবুকে দেখলাম, সংগঠনের পরিচালিকাকে অনেকেই সব্যসাচী লেখক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আমাদের কমিউনিটিতে একজন সব্যসাচী লেখক পেলে অবশ্যই সবার গর্ব হবে। আমারও তাকে হিংসা করার কোনো কারণ নেই। তবে কথা থেকেই যায়। 

আসুন দেখি সব্যসাচী লেখক কাকে বলে

সব্যসাচী শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে, যার দুটো হাতই সমানে চলে অর্থাৎ দুই হাতেই কাজ করতে দক্ষ যিনি। শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল মহাভারতের অর্জুনের দক্ষতা বোঝাতে। দুই হাতেই অসামান্য দক্ষতায় শর নিক্ষেপ করতে পারতেন তিনি। তবে পরবর্তীতে এ শব্দটির ব্যাপক প্রসার ঘটে। কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের প্রতিটি কাজেই যিনি সমানভাবে পারদর্শী, তাকেই বলা হয় সব্যসাচী। ক্রিকেটে যে মানুষটা ব্যাটিং করতে পারেন তাকে ব্যাটসম্যান, যিনি বোলিং করতে পারেন তাকে বোলার, আর যিনি ব্যাটিং এবং বোলিং দুটো কাজই ঠিকভাবে করতে পারেন তাকে অলরাউন্ডার (সব্যসাচী) বলা হয়ে থাকে। 

সাহিত্যেরও অনেক ক্ষেত্র রয়েছে-কবিতা, গল্প, নাটক, সিনেমা, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছড়া ইত্যাদি। প্রত্যেক সাহিত্যিকই কয়েকটি ক্ষেত্রে কাজ করলেও একটি নির্দিষ্ট জায়গায় তার শক্তির জায়গা থাকে। তবে ব্যতিক্রম সব জায়গাতেই থাকে। কিছু কিছু লেখক সাহিত্যের সব জায়গাতেই বেশ দাপটের সঙ্গে পদচারণা করে থাকেন। এদেরকেই সব্যসাচী লেখক বলা হয়ে থাকে। 

বাংলাদেশে যাকে সব্যসাচী লেখক বলে আখ্যায়িত করা হয় তিনি হচ্ছেন সৈয়দ শামসুল হক। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, অনুবাদ তথা সাহিত্যের সব শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাকে ‘সব্যসাচী লেখক’ বলা হয়। তার লেখকজীবন প্রায় ৬২ বছরব্যাপী বিস্তৃত। সৈয়দ শামসুল হক মাত্র ৩১ বছর বয়সে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এ পুরস্কার লাভ করেছেন। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক এবং ২০০০ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। 

ভারতেও রবীন্দ্রনাথের পর বুদ্ধদেব বসুকে ‘সব্যসাচী লেখক’ বলা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশায় তার প্রভাবের বাইরে এসে যারা লেখালেখি করেছেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। ইংরেজি ভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধাদি রচনা করে তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি অসংখ্য কবিতা, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, অনুবাদ, ভ্রমণকাহিনি প্রভৃতি রচনা করেছেন। 

তার উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৭০ সালে পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে তপস্বী ও তরঙ্গিণী কাব্যনাট্যের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে স্বাগত বিদায গ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন। 

আসুন, আগে তাদের মতো হই বা হতে চেষ্টা করি। তারপর না হয় নিজেকে সব্যসাচী লেখক হিসেবে ঘোষণা দিই!

শোকের আয়ু কত দিন!

গ্রিসের নির্ভীক কবি, বিপ্লবী নাজিম হিকমত তার জেলখানার চিঠি কবিতায় লিখেছেনÑ

‘প্রিয়তমা আমার, তোমার শেষ চিঠিতে তুমি লিখেছ;

মাথা আমার ব্যথায় টনটন করছে, দিশেহারা আমার হৃদয়। 

তুমি লিখেছ; যদি ওরা তোমাকে ফাঁসি দেয়

তোমাকে যদি হারাই, আমি বাঁচব না। 

তুমি বেঁচে থাকবে, প্রিয়তমা বধূ আমার;

আমার স্মৃতি কালো ধোঁয়ার মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে,

তুমি বেঁচে থাকবে আমার হৃদয়ে রক্তকেশী ভগিনী,

বিংশ শতাব্দীতে, মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।’

জেলখানায় বসে প্রিয়তমা স্ত্রীকে লেখা এই কবিতার প্রতিটি লাইন জ্বলজ্বলে সূর্যের মতো প্রদীপ্ত! এতো শুধু কবিতা নয়, এক বিপ্লবীর আত্মপোলব্ধি!

তিনি বলেছেন, মানুষের মৃত্যুশোকের আয়ু এক বছর। কিন্তু টাকার শোকের আয়ু কত দিন তা তিনি বলেননি। তবে আমরা জানি, টাকার শোকের কোনো মেয়াদকাল নেই। এ শোক থাকে আজীবন। 

কথাটা বললাম এজন্য, গত দুই সপ্তাহ আগে স্মল ওয়ার্ল্ডের অর্থ প্রেরণ নিয়ে একটা লেখা ছাপা হয়েছিল সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায়। এরপর থেকেই বেশ কিছু মানুষ ফোনে এবং ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেছেন আমার সঙ্গে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের নাজমুল হুদার প্রতারণা নিয়ে একটু লেখার জন্য। আমি বললাম এটা ডেড ইস্যু। এতোদিন পর এটা নিয়ে লিখে কী লাভ!

এদের একজন কাজী হোসেন গত ১২ জুলাই এসেছিলেন আমার অফিসে। তিনি ফুড তৈরির কাজ করেন বার্গার কিংয়ে। সারাদিন চুলার আঁচের ওপর থাকতে হয় তাকে। কঠিন কষ্টের জীবন তার। এতো কষ্টের উপার্জনের অর্থ সঞ্চয় করে দেশে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করার জন্য ৪ হাজার ৩২৫ ডলারের টিকেট কিনেছিলেন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ট্রাভেল থেকে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী নাজমুল হুদা টিকেট কনফার্ম না করে অন্য অনেকের মতো তার অর্থ নিয়েও উধাও হয়ে যান। তিনি দেশে যেতে পারেননি। সে অর্থও ফেরত পাননি। আর একজন মোহন খান। ৩ হাজার ৭০০ ডলারের টিকেট কিনেছিলেন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড থেকে। তিনিও দেশে যেতে পারেননি। তবে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে দেনদরবার করে ২ হাজার ডলার ফেরত পেয়েছিলেন। বাকি ১ হাজার ৭০০ ডলার আজ পর্যন্ত পাননি। 

আরো এসেছিলেন বেশ কয়েকজন। কত জনের কথা উল্লেখ করবো। অন্য একজন এসে বললেন, নাজমুল হুদা নাকি আবার নিউইয়র্কে উদয় হয়েছেন। সন্ধ্যার পর এস্টোরিয়ায় একটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নাকি তাকে বসে থাকতে দেখা যায়। 

নাজমুল আপনার এ জীবনটা কি সুখের? পাওনাদারদের ভয়ে আলো ঝলোমলো নিউইয়র্কে আপনাকে রাতের জীবন বেছে নিতে হয়। এটা কত লজ্জার, কত অপমানের, ব্যাপারটা কি আপনি হ্রদয়ঙ্গম করতে পারেন? এ লজ্জা আপনার, আপনার পরিবার-পরিজনের এবং সমগ্র প্রবাসী বাংলাদেশির। ওই অর্থ আপনাকে হয়তো সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু সুখ আর শান্তি দিতে পেরেছে কি?

যদি সম্ভব হয় পাওনাদারদের সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করে তাদের কমবেশি অর্থ দিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিন, যা হবে আপনার জন্য সম্মানের। আর সাধারণ খেটে খাওয়া মানষগুলো কমবেশি অর্থ হাতে পেয়ে নিজেদের দুঃখবোধটা কিছুটা হলেও ভুলতে পারবেন। 

শেয়ার করুন