১৮ অক্টোবর ২০২৫, শনিবার, ০১:৫৬:০৬ পূর্বাহ্ন


ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন ‘ডিসমিসাল কৌশল’
আদালতের ভেতরেই চলছে বহিষ্কার অভিযান
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-১০-২০২৫
আদালতের ভেতরেই চলছে বহিষ্কার অভিযান নিউইয়র্কের জেকব কে জাভিৎস ফেডারেল বিল্ডিংয়ে আইসিই অভিবাসী গ্রেফতারের জন্য কোর্ট হলগুলোতে ফেডারেল এজেন্টরা পাহারা দিচ্ছেন


প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন তার দ্বিতীয় মেয়াদে ‘মাস ডিপোর্টেশন’ বা ব্যাপক বহিষ্কার অভিযানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস) সম্প্রতি একটি বিতর্কিত নতুন কৌশল চালু করেছে, যেখানে তাদের সরকারি আইনজীবীরা ইমিগ্রেশন কোর্টে উপস্থিত অনাগরিকদের মামলাগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল বা ‘ডিসমিস’ করার অনুরোধ জানাচ্ছেন। আশ্চর্যের বিষয়, অভিবাসন বিচারকরা এসব আবেদন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনুমোদন করছেন। সরকার কর্তৃক নিযুক্ত এসব আইনজীবী অভিবাসীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই আদালতে মামলা বাতিলের আবেদন দাখিল করছেন। গত ২০ মে থেকে এ প্রবণতা প্রথম লক্ষ করা যায় এবং মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এটি যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তথ্য অধিকার আইনের আওতায় সংগৃহীত সরকারি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ তারিখের পর থেকে আইসিই আইনজীবীদের করা ‘মোশন টু ডিসমিস’ বা মামলা বাতিলের আবেদন হঠাৎ করে ৬৩৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।

এ নতুন কৌশলের মূল উদ্দেশ্য হলো-অনাগরিকদের নিয়মিত ইমিগ্রেশন কোর্ট প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দ্রুত বহিষ্কার প্রক্রিয়ায় পাঠানো, যেখানে বিচারিক সুরক্ষা ও আপিলের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। তথ্য অধিকার আইনের আওতায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মে ২০ থেকে জুলাই ২৮ পর্যন্ত সময়ে আইসিই মোট ৬ হাজার ২১০টি ডিসমিসাল আবেদন করেছে। এর মধ্যে ৮১ শতাংশই ছিল মৌখিক আবেদন, যদিও ইমিগ্রেশন কোর্টের নিয়ম অনুযায়ী, এ ধরনের আবেদন অবশ্যই লিখিত হতে হবে এবং নির্দিষ্ট নোটিস ও সময়সীমা মেনে জমা দিতে হয়।

অভিযোগ রয়েছে, আইসিই তাদের আইনজীবীদের নির্দেশ দিয়েছে, যেসব অভিবাসী ইতোমধ্যে কোর্টে হাজির বা শুনানির অপেক্ষায় আছেন, তাদের চিহ্নিত করে ডিসমিসাল আবেদন করতে, এবং সেই মুহূর্তেই কোর্ট ভবনে আটক করার জন্য আইসিই ডিটেনশন অফিসার ও আদালতের কর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় করতে। এর ফলে, অনেক অভিবাসী শুনানির দিনই গ্রেফতার হচ্ছেন এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাদের দ্রুত বহিষ্কারের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।

তথ্য অনুযায়ী, ইমিগ্রেশন বিচারকরা আইসিইর মৌখিক ডিসমিসাল আবেদনগুলোর ৮৬ শতাংশ ক্ষেত্রে একই দিনে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, যদিও আদালতের নিয়ম অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তির উত্তর দেওয়ার জন্য অন্তত ১০ দিন সময় পাওয়ার কথা। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এ তাৎক্ষণিকভাবে গৃহীত আবেদনের ৮০ শতাংশই অনুমোদিত হয়েছে। অর্থাৎ, বিচারকের সিদ্ধান্তে মামলাগুলো বাতিল হয়ে যাচ্ছে, যা আইসিইকে অবিলম্বে অভিযুক্তকে এক্সপেডাইটেড রিমুভাল প্রক্রিয়ায় পাঠানোর সুযোগ দিচ্ছে।

মানবাধিকার সংগঠন ও আইনজীবীরা বলছেন, এই প্রবণতা ইমিগ্রেশন কোর্টগুলোর নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলছে। আমেরিকান ইমিগ্রেশন কাউন্সিলের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিচারকরা এখন সরকারের বহিষ্কার যন্ত্রের অংশে পরিণত হচ্ছেন, যাদের ভূমিকা আর বিচারিক নয়, বরং প্রশাসনিক অনুমোদনের।

ইমিগ্রেশন কোর্টে ‘মোশন টু ডিসমিস’ বা মামলা বাতিলের আবেদন সাধারণত দুই পক্ষই করতে পারেন। সরকারপক্ষ (আইস) কিংবা অভিযুক্ত অভিবাসী। অভিবাসীরা সাধারণত এ আবেদন করেন তখন, যখন তাদের কোর্ট প্রক্রিয়ার বাইরে অন্য কোনো মাধ্যমে বৈধ থাকার বা আইনি সহায়তার সুযোগ রয়েছে। অতীতে আইসিইও এ ধরনের আবেদন করত তখনই, যখন কোনো মামলা সরকারি অগ্রাধিকার তালিকায় না থাকতো বা তা চালিয়ে যাওয়া প্রশাসনিকভাবে অপ্রয়োজনীয় ছিল।

কিন্তু এ বছর থেকে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। আইসিই এখন মামলা বাতিল করছে না সহানুভূতি বা ব্যয় সাশ্রয়ের কারণে, বরং দ্রুত বহিষ্কারের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য। আদালতের নিয়ম অনুসারে, এ ধরনের আবেদন অবশ্যই লিখিত আকারে দাখিল করতে হয় এবং শুনানির কমপক্ষে ১৫ দিন আগে (প্রথম শুনানির ক্ষেত্রে) বা ৩০ দিন আগে (পরবর্তী শুনানির ক্ষেত্রে) জমা দিতে হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ২০ মে-এর পর আইসিইর ৮১ শতাংশ আবেদনই মৌখিকভাবে কোর্টে তাৎক্ষণিকভাবে করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত।

তথ্য অধিকার আইনের আওতায় সংগৃহীত সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০ মে তারিখে একদিনেই মৌখিক ডিসমিসাল আবেদন ৬৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এর আগে টানা ১২ কর্মদিবস জুড়ে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৩২টি আবেদন দাখিল হচ্ছিল, কিন্তু ওইদিন থেকে হঠাৎই সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায়। এ প্রবণতা জুন ও জুলাই মাসেও অব্যাহত থাকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মে ২০ থেকে জুলাই ২৮ পর্যন্ত সময়ে কোর্টে গৃহীত ডিসমিসাল আবেদনগুলোর প্রায় চার-পঞ্চমাংশই মৌখিক এবং সেগুলোর সিদ্ধান্তও একই দিনে নেওয়া হয়েছে যা কার্যত অভিযুক্ত অভিবাসীদের আইনি প্রতিরক্ষার সুযোগকেই অস্বীকার করছে।

নিউইয়র্কভিত্তিক এক অভিবাসন আইনজীবী বলেন, এ কৌশল আইনের পরিপন্থী এবং বিচারিক ন্যায়বিচারকে সম্পূর্ণভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। একজন ব্যক্তি, যিনি আদালতে হাজির হচ্ছেন এবং নিয়ম মেনে আইনি প্রতিকার চাইছেন, তাকে সেই দিনই গ্রেফতার করা মানে আদালত ব্যবস্থাকেই অপব্যবহার করা। অন্য এক আইনজীবীর মন্তব্য, আমরা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে আদালত নিজেই আইসিইর অপারেশনের অংশে পরিণত হচ্ছে।

মে মাস থেকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আইসিইর এই নতুন কৌশলের বিরুদ্ধে জনঅসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করেছে। শত শত মানুষ, ধর্মীয় নেতা, সামরিক ভেটেরান, অভিবাসী অধিকারকর্মী এবং রাজনৈতিক নেতারা ইমিগ্রেশন কোর্ট ভবনের বাইরে প্রতিবাদ করছেন। অনেকেই স্বেচ্ছায় অভিবাসীদের সঙ্গে কোর্টে যাচ্ছেন, যেন আদালতের ভেতর বা বাইরে গ্রেফতারের ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে পারেন বা অন্তত তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেন।

কংগ্রেসের একাধিক সদস্য আইসিইর কাছে চিঠি পাঠিয়ে এই কোর্টহাউস অ্যারেস্টের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তারা লিখেছেন, যারা নিয়ম মেনে আদালতে হাজির হচ্ছেন, তাদের লক্ষ্যবস্তু বানানো আইনের চেতনার পরিপন্থী। এদিকে, আমেরিকান ইমিগ্রেশন কাউন্সিল, লাতিনোজাস্টিস পিআরএলডিএফ, অ্যাসাইলাম নেটওয়ার্কসহ একাধিক অধিকারভিত্তিক সংগঠন এই ডিসমিসাল-ভিত্তিক গ্রেফতারের বিরুদ্ধে ফেডারেল কোর্টে মামলা দায়ের করেছে।

অধিকারকর্মীরা বলছেন, এ প্রবণতা শুধু আইনি নয়, নৈতিক দিক থেকেও গভীরভাবে উদ্বেগজনক। কারণ এক্সপেডাইটেড রিমুভাল প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করার পর কোনো অভিবাসীর আপিল বা আইনি সহায়তার সুযোগ প্রায় থাকে না। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা, যারা ইংরেজিতে দুর্বল, কোনো আইনজীবী নেই, বা মামলার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সীমিত ধারণা রাখেন। এক অর্থে, এই সিদ্ধান্ত তাদের বিচারবহির্ভূত নির্বাসনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ১ মে থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত সময়ে আইসিই মোট ৬,২১০টি ডিসমিসাল আবেদন দাখিল করেছে। এর মধ্যে ৮১ শতাংশ মৌখিক আবেদন, যা নিয়মবিরুদ্ধ। বিচারকরা ৮৬ শতাংশ ক্ষেত্রে একই দিনে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, এবং এসব তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের ৮০ শতাংশই আইসিইর পক্ষে অনুমোদিত হয়েছে। এর ফলে হাজার হাজার অভিবাসীকে আদালত থেকে সরাসরি দ্রুত বহিষ্কার প্রক্রিয়ায় পাঠানো সম্ভব হয়েছে।

সবশেষে, বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে আইসিইর এই কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন বিচারব্যবস্থাকে এক নতুন ও বিপজ্জনক দিকের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আদালতের ভূমিকা আর নিরপেক্ষ বিচারকের নয়; বরং এখন সেটি সরকারের বহিষ্কার যন্ত্রের একটি সহায়ক অংশে পরিণত হচ্ছে। যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আদালতের ন্যায়বিচারের ভিত্তি ভেঙে পড়বে, এবং হাজারো পরিবার আইনি প্রতিকার ছাড়াইযুক্তরাষ্ট থেকে বিতাড়িত হবে। একজন আইনজীবী যেমন সতর্ক করেছেন, আদালত যদি সরকারের নির্বাহী শাখার হাতিয়ারে পরিণত হয়, তবে অভিবাসন প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচারের আশা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।

শেয়ার করুন