১৮ অক্টোবর ২০২৫, শনিবার, ০৪:৩৬:২৭ পূর্বাহ্ন


অধিবাসী ভাড়াটিয়া ঢাকায় ৮০ ভাগ
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-১০-২০২৫
অধিবাসী ভাড়াটিয়া ঢাকায় ৮০ ভাগ আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা


ঢাকায় শতকরা ২০ ভাগ অধিবাসী জমির মালিক এবং শতকরা ৮০ ভাগ অধিবাসী ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করেন। এই ৮০ ভাগের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ অধিবাসী বস্তিতে বসবাস করেন। বিশ্ব বসতি দিবস ২০২৫ উপলক্ষে ‘নগরে সকলের জন্য নিরাপদ আবাসন’ শীর্ষক পরিকল্পনা সংলাপে এসব তথ্য দেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান এসব তথ্য দেন। 

ড. আদিল মুহাম্মদ খান এসব তথ্য দিয়ে আরও বলেন, এমন উপাত্ত নগরবাসীর আবাসন বৈষম্যকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় ৮ শ্রেণীর মহল্লা ও আয়ভিত্তিক বেশ কয়েকটি সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে। তাই নগরের সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য সুষম ও নিরাপদ আবাসন নিশ্চিত করতে মহল্লা ও আয়ভিত্তিক পৃথক আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি। 

পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান আরও বলেন, মানুষের শিক্ষা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের আগে আবাসনের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি নিম্নআয়ের মানুষ, অথচ তাদের জন্য নিরাপদ আবাসনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। তিনি আরও বলেন, নিরাপদ আবাসন রাষ্ট্রের দায়িত্ব হওয়া উচিত। সরকারের আবাসন নীতিমালায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত ২০ শতাংশ ইউনিট নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সংরক্ষণের বিধান থাকা প্রয়োজন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ঢাকাকেন্দ্রিক হাউজিং মডেল থেকে সরে এসে এখন সারাদেশব্যাপী ভারসাম্যপূর্ণ হাউজিং মডেল তৈরি করা প্রয়োজন। প্রতিটি শহরে নিরাপত্তা, অবকাঠামো ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে সবার জন্য বাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। নগর পরিকল্পনার সাথে আবাসন পরিকল্পনার কার্যকর সমন্বয়ের অভাবে রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, গাজীপুরসহ দেশের অন্যান্য নগরগুলোও ক্রমান্বয়ে অবাসযোগ্য হয়ে পড়ছে। 

বিআইপি’র সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসানের সঞ্চালনায় পরিকল্পনা সংলাপ সভাপতিত্ব করেন। 

শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান পরিকল্পিত নগরায়ন ও নিরাপদ আবাসন নিশ্চিতকরণে বিআইপি’র চলমান কার্যক্রম এবং নিয়মিত পরিকল্পনা সংলাপ আয়োজনের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। তিনি জানান, এসব পরিকল্পনা সংলাপে উপস্থাপিত মূল সারাংশ, পরিকল্পনা পেশাজীবী ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত এবং সুপারিশসমূহ সংকলন করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে উপস্থাপন করা হবে, যাতে তারা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে পরিকল্পিত নগরায়ন ও নিরাপদ আবাসনকে অন্তর্ভুক্ত করে তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। 

পরিকল্পনা সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইপি’র উপদেষ্টা পরিষদের আহ্বায়ক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. আকতার মাহমুদ। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, আবাসন শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁই নয় এটি মানুষের নিরাপত্তা, মর্যাদা, স্বাস্থ্য ও জীবিকার ভিত্তি। আমাদের সংবিধান নাগরিকের মানসম্মত গৃহায়ন নিশ্চিত করাকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করেছে। তবে বর্তমানে সরকার আবাসন প্রদানকারী নয়, বরং সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। রিয়েল এস্টেট খাতের অবদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই খাত দেশের জিডিপিতে ৭-৮ শতাংশ অবদান রাখলেও তা মূলত উচ্চবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সাশ্রয়ী আবাসনে এই খাতকে যুক্ত করতে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বভিত্তিক (PPP) মডেল, অন্তর্ভুক্তিমূলক আবাসন (Inclusionary Zoning), ভর্তুকি ও ভাড়াভিত্তিক আবাসন উন্নয়ন কার্যক্রম প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের আবাসন খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো ভূমির অভাব, জমির উচ্চমূল্য, নির্মাণ ব্যয়ের বৃদ্ধি, সাশ্রয়ী ঋণের ঘাটতি এবং সরকারি পরিকল্পনার ধারাবাহিকতার অভাব। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি উল্লেখ করেন, সরকারের দৃঢ় পরিকল্পনা, মান নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও টেকসই নকশার সমন্বয় থাকলেই সাফল্য আসে। পরিশেষে ড. মাহমুদ বলেন, সবার জন্য আবাসন কেবল নীতি নয়-এটি সামাজিক ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদার প্রশ্ন। সরকার, বেসরকারি খাত ও নাগরিক সমাজের যৌথ উদ্যোগেই এর বাস্তবায়ন সম্ভব। 

বিআইপি কোষাধ্যক্ষ পরিকল্পনাবিদ ড. মু. মোসলেহ উদ্দীন হাসান বলেন, আমাদের দেশের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা এখনো সারাদেশব্যাপী নয়; এটি মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও সুষম উন্নয়নের জন্য রিয়েল এস্টেট খাতকে বিকেন্দ্রীকরণ করা জরুরি। তিনি আরও বলেন, এই খাতে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় যদি তা গোষ্ঠী স্বার্থে আঘাতও হানে, তবুও আমাদের সরকারি বেসরকারি সকল প্রকল্পে কাজ চালিয়ে যেতে হবে, কারণ সমাজটি আমাদের সবার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রাশেদা রওনক খান তাঁর ভাষানটেক ও কড়াইল বস্তি নিয়ে পরিচালিত গবেষণার ফলাফল ও সুপারিশ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভাষানটেকসহ বিভিন্ন সরকারি আবাসন প্রকল্প মূলত দরিদ্র ও গৃহহীন জনগোষ্ঠীর জন্য নেওয়া হলেও সঠিক টেকনিক্যাল জ্ঞানের অভাব, জটিল প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, দুর্নীতি এবং মধ্যস্থভোগীদের প্রভাবের কারণে প্রকৃত বস্তিবাসীরা কাঙ্ক্ষিত সুবিধা পাচ্ছেন না। এ ধরনের সমস্যা এড়াতে লক্ষ্যগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থা, চাহিদা ও বাস্তব প্রয়োজন বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে হবে। 

বিআইপি’র উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পরিকল্পনাবিদ সালমা বলেন, ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চলের আবাসন সমস্যা সমাধানে বিআইপি ও রিহ্যাবের মতো সংস্থা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা জরুরি। তিনি আরও উল্লেখ করেন, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব এবং সরকারি খাস জমিতে পুনঃউন্নয়নের মাধ্যমে উচ্চ ভবন নির্মাণ করে বৈষম্য দূর করা ও নিরাপদ ও সহজলভ্য আবাসন নিশ্চিত করা সম্ভব।

রিহ্যাব-এর সহ-সভাপতি প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ নিরাপদ ও টেকসই আবাসন নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ অপরিহার্য এবং বিআইপি ও রিহ্যাব যৌথভাবে এ ক্ষেত্রে কাজ করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. কাশফিয়া নাহরিন বলেন, উন্নত বিশ্বে বর্তমানে যেখানে পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, সেখানে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে জলবায়ু সহনশীল ও স্বল্পমূল্যের আবাসন নিয়ে ভাবা আরও জরুরি। 

বিআইপি সাবেক সহ-সভাপতি পরিকল্পনাবিদ মোঃ আরিফুল ইসলাম বলেন, সরকারি বা বেসরকারি উভয় উদ্যোগই এখন পর্যন্ত ‘সবার জন্য আবাসন’ ধারণা থেকে অনেক দূরে রয়েছে। বেসরকারি খাতের আবাসন কার্যক্রম মূলত উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য পরিকল্পিত, যেখানে মধ্যবিত্তদের জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি। 

বিআইপি যুগ্ম সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ তামজিদুল ইসলাম বলেন, আবাসন মূলত দুইভাবে সংগঠিত- মালিকানা ও ভাড়াভিত্তিক। নগরের নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠী প্রধানত ভাড়াবাসে বসবাস করে। এই জনগোষ্ঠীর আবাসন সমস্যা সমাধানে সরকারের একটি সুস্পষ্ট ও কার্যকর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। তিনি আরও বলেন, নগরায়নের ধারায় দরিদ্র মানুষের আবাসনের প্রশ্নটি দীর্ঘদিন উপেক্ষিত রয়ে গেছে। এছাড়াও অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন, বিআইপি বোর্ড সদস্য পরিকল্পনাবিদ উসওয়াতুন মাহেরা খুশি, পরিকল্পনাবিদ মোঃ ফাহিম আবেদিন সহ নাগরিক ও পরিকল্পনা পেশাজীবীগণ।

শেয়ার করুন