১৮ অক্টোবর ২০২৫, শনিবার, ০৪:৩৫:৫২ পূর্বাহ্ন


দেশের ৫৬ ভাগ জেলে সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-১০-২০২৫
দেশের ৫৬ ভাগ জেলে সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত সংবাদ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ


দেশের প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষ মাছ ধরা, বাজারজাতকরণ, বিপনণ, ইত্যাদির সাথে সরাসরি জড়িত। এর মধ্যে প্রায় ৪ লক্ষ ৫০ হাজার জেলে সরাসরি ইলিশ মাছ ধরার সাথে জড়িত। আর এই ক্ষুদ্র জেলে এবং কৃষকরাই জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মুখসারির সংগ্রামী জনগোষ্ঠী। কিন্তু এরা ইলিশ আহরণের পরিমাণ হ্রাস পাওয়া, সহায়তা বিতরণে দেরি হওয়া, বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিকল্প আয়ের অভাব, জীববৈচিত্রের অবক্ষয়, ইকোট্যুরিজমের নামে জেলে পল্লীর জায়গা বেদখল এবং অনানুষ্ঠানিক ঋণের ফাঁদে পড়ে ক্ষুদ্র জেলে পরিবারের গভীর সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটে আছে। কিন্তু দেশের ৫৬ ভাগ ক্ষুদ্র জেলে সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত থাকেন।

“শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, নিরাপদ বিকল্প জীবিকা চাই: ক্ষুদ্র জেলেদের ন্যায্য সহায়তা নিশ্চিত করুন” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ১৩ অক্টোবর সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে কোস্ট ফাউন্ডেশন এক জাতীয় সংবাদ সম্মেলনে এসব বক্তব্য উঠে আসে। 

এতে বক্তারা ক্ষুদ্র জেলে পরিবারের গভীর সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটে মধ্যে পড়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁরা সরকারের প্রতি আহবান জানান যেন ক্ষুদ্র জেলেদের জন্য, বিশেষ করে নারী ও যুবকদের, সময়মতো সহায়তা প্রদান ও আয়ের বিকল্প কার্যক্রম সম্প্রসারণের পাশাপাশি স্বচ্ছ উপায়ে নির্বাচিত উপকারভোগীদের মাঝে সহায়তা বণ্টন নিশ্চিত করা হয়।

কোস্ট ফাউন্ডেশন নির্বাহী পরিচালক এম রেজাউল করিম চৌধুরী সভায় সভাপতিত্ব করেন। তিনি বলেন, আমরা এটা বিশ্বাস করি, ইলিশের পুনরুৎপাদনের জন্য মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা অত্যন্ত জরুরি, তবে এই নিষেধাজ্ঞা যেন ক্ষুধা বা অভুক্ত থাকার কারণে পরিণত না হয়। সরকারকে অবশ্যই নিষেধাজ্ঞা শুরুহওয়ার আগেই প্রতিটি নিবন্ধিত জেলে পরিবারকে ৪০ কেজি চাল ও ৮ হাজার টাকা প্রদান করতে হবে এবং অন্তত একজন সদস্যের জন্য বিকল্প আয়ভিত্তিক কাজের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।” তিনি আরও বলেন, যুব মৎস্যজীবীদের জন্য পেশাগত প্রশিক্ষণ ও বিকল্প জীবিকার সুযোগ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি ছোট নৌকায় (খাল ও নদীতে) বসবাসকারী মান্দা সম্প্রদায়কে জেলে কার্ড প্রদান ও নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে রাখার আহবান জানান।

কোস্ট ফাউন্ডেশনের উপ-নির্বাহী পরিচালক সনত কুমার ভৌমিক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, “দেশের ৫৬% ক্ষুদ্র জেলে সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত থাকেন। আবার শতকরা ৮৩ ভাগ নিষেধাজ্ঞার শেষে ১-২ মাস পরে গিয়ে সহায়তা পান। এছাড়া শতকরা ৮৭ ভাগ জেলে কোনো আয়ভিত্তিক কার্যক্রম বা দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় নেই। অপরদিকে ৭০ভাগ অনানুষ্ঠানিক উচ্চসুদ ঋণের কারণে ফাঁদে পড়ে টিকে থাকার জন্য অবৈধভাবে মাছ ধরতে বাধ্য হন। আর্থিক চাপের কারণে নিষেধাজ্ঞা চলাকালে জেলে পরিবারে পারিবারিক সহিংসতা ৩০-৪০ভাগ বৃদ্ধি পায়। তিনি বেআইনি জালের ব্যবহার বন্ধ ও জাল উৎপাদনকারী কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানান।

আর এজন্য কোস্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক (প্রশাসন) মোস্তফা কামাল আকন্দ পরামর্শ দিয়ে নারী ও যুবকদের জন্য পশুপালন, মৎস্যচাষ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা কর্মসূচির গ্রহণের দাবি জানান। তিনি বলেন, “জাতীয় পর্যায়ে প্রকৃত জেলেদের নিয়ে ডাটাবেইস দ্রুত হালনাগাদ করা, তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও অনুদান সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে জেলে পরিবারগুলো ভালো থাকতে পারে।”

ত্রিণমূল উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক খন্দকার ফারুক আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, “সংরক্ষণের পাশাপাশি খাদ্যনিরাপত্তা ও জীবিকার সুরক্ষা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠাই টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত।”

ক্লাইমেট চেইঞ্জ এন্ড রেসিলিয়েন্স, কোস্ট ফাউন্ডেশন এর প্রধান মো. আবুল হাসান বলেন, “ক্ষুদ্র জেলে এবং কৃষকরাই জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মুখসারির সংগ্রামী জনগোষ্ঠী। ইলিশ আহরণের হ্রাসের সঙ্গে ধ্বংসাত্মক মাছ ধরা, অপরিকল্পিত খনন, এবং উপকূলীয় অভয়ারণ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সম্পর্ক রয়েছে। বিকল্প জীবিকার জন্য পৃথক উন্নয়ন তহবিল গঠনের দাবি এখন সময়ের দাবি।”

মো. জাহিদুল ইসলাম, হেড-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট কোস্ট ফাউন্ডেশন, বলেন, “গত পাঁচ বছরে ইলিশ আহরণ ৩.৪% হ্রাস পেয়েছে। নারী ও যুবকদের আয়ভিত্তিক কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা গেলে পরিবারের আয় উলে-খযোগ্যভাবে বাড়বে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, “ইলিশ মাছকে নদীনির্ভর দেশীয় মৎস্য হিসেবে শ্রেণিবিন্যাস করলে, এটি সামুদ্রিক ভর্তুকি সংক্রান্ত ডব্লিউটিও-র সীমাবদ্ধতা থেকে সুরক্ষিত থাকবে।”

সব বক্তারা সম্মিলিতভাবে জানান, নিষেধাজ্ঞা চলাকালে সময়মতো খাদ্য ও অর্থ বিতরণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক আয়ভিত্তিক কর্মসংস্থান, স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা এবং প্রান্তিক মৎস্যজীবীদের সরকারি কর্মসূচিতে ন্যায্য অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা হোক, যাতে কোনো মৎস্যজীবী পরিবার ক্ষুধার মুখে না পড়ে।

শেয়ার করুন