পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট কোনো আঞ্চলিক সংকট নিয়ে এটি বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার অন্যতম প্রধান সংকট। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকটকে জাতীয় নিরাপত্তার সংকট হিসেবে চিহ্নিত করে এর সমাধানে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গত ১২ অক্টোবর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ আয়োজিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট ও বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা শীর্ষক’ ওয়েভিনারে এসব কথা বলেন বক্তরা। রোহিঙ্গা সংকট, রাখাইন প্রদেশে আরাকান আর্মির আধিপত্য, ভারতের প্ররোাচতায় বাংলাদেশে নতুন করে শুরু হওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে বলেও মনে করেন বক্তারা।
বিডস আয়োজিত ওয়েভিনারে প্যানালিস্ট হিসেবে বক্তব্য রাখেন-অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বায়েজিদ সারোয়ার, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড টেকটিক রিসার্চ-এর প্রেসিডেন্ট আবু রুশদ, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যান্টাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. নাজমুস সাকিব নির্ঝর। ওয়েভিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন-বিডসের নির্বাহী পরিচালক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. মোহাম্মদ ইমরান হোসাইন আনসারী। ওয়েভিনারটি সঞ্চলনা করেন সাংবাদিক সৈয়দা জোহরা শাম্মী।
ওয়েভিনারে দেওয়া বক্তব্যে ব্রিগেডিয়ার বায়েজিদ সারোয়ার বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক উত্তেজনায় তরুণ প্রজন্মের উগ্রপন্থী হওয়ার আলামত স্পষ্ট হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সুবাধে যেভাবে মিস ইনফরমেন্স, ডিস ইনফরমেন্স ছড়ানো হচ্ছে তা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে জোরদার করছে। এ নিয়ে সিভিল মিলিটারি সবাইকে ভাবতে হবে। জুম্মু ছাত্র-জনতার ব্যানারে যে সাম্প্রতিক আন্দোলন হয়েছে তার পেছনে ছিল ইউপিডিএফ। এছাড়া বাংলাদেশে পাহাড়িদের এখন ছয়টি সশস্ত্র গ্রুপ অ্যাকটিভলি কাজ করছে। তাদের রশদ আসছে ভারত থেকে, এটি আমাদের তদন্ত করে দেখতে হবে। তিনি আরো বলেন, আগের শান্তিবাহনীর চেয়ে এখন পাহাড়িদের তিনটি শক্তি যোগ হয়েছে। আর তা হচ্ছে-সোশ্যাল মিডিয়া, এনজিও ও আন্তর্জাতিক সমর্থন। যেখানে একটি নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি হবার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়া যায় না।
তিনি মনে করেন, রাখাইন প্রদেশে আরাকান আর্মির উত্থান পাহাড়ি যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় সিভিল প্রশাসনের উপস্থিত বাড়াতে হবে। পরিস্থিতি জটিল হলে ওই এলাকাকে অপারেশন এরিয়া ঘোষণা করে সেনা অভিযান চালাতে হবে। পাশাপাশি পাহাড়িদের সঙ্গে বাঙালিদের সম্পর্ক বাড়াতে হবে, তাদের সমাজের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে এক্ষেত্রে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও এনজিওদের উসকানি রয়েছে। তারা ইস্যুটি জিইয়ে রাখতে চায়। এছাড়া এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা ও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
আবু রুশদ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকটের মূল পর্বই শুরু হয় নাগরিকত্বের প্রশ্নে। ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমান পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যাওয়ার যে পরামর্শ দিয়েছিলেন-তা থেকেই পাহাড়িদের বাংলাদেশ প্রশ্নে সন্দেহ ও সংশয় শুরু হয়। তিনি আরো মনে করেন, আমরা মনে করছি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতায় শুধু ভারত থেকে অস্ত্র আসছে এটি মনে করা ঠিক হবে না। এ অঞ্চলে চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র সমভাবে কাজ করছে। আজকে আমাদের যুক্তরাষ্ট্রের বার্মা অ্যাক্টের প্রভাবের বিষয়টি মাথায় রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
ড. নাজমুস সাকিব বলেন, পাহাড়িরা পুনরায় অস্ত্র হাতে নেওয়ার মাধ্যমে শান্তিচুক্তি লঙ্ঘন করেছে, সেহেতু এর কার্যকারিতা আছে বলে মনে করি না। সুতরাং ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন সরকারের আর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের অখন্ডতা রক্ষায় বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সামরিক অ্যালাইনমেন্টে যেতে হবে। অভ্যন্তরীণভাবে শান্তিচুক্তির আগে, যেখানে সেনাক্যাম্প ছিল সেখানে আর্মি ক্যাম্প পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
স্বাগত বক্তব্যে ড. ইমরান আনসারী বলেন, আজকের পৃথিবীতে, যেখানে কোনো এক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক সংকট একটি দেশের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে, সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের আমাদের কাছে শুধুই একটি ‘আঞ্চলিক’ বিষয় নয়-এটি জাতীয় সংহতি ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত একটি চ্যালেঞ্জ। জাতীয় নিরাপত্তার প্রদান বিষয় হিসেবে এটিকে বিবেচনা করে সামরিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা সময়ের দাবি।