জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান চলাকালে দেশজুড়ে ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে যে হত্যাকান্ড হয়েছে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হিসেবে এর সব দায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ১৪ অক্টোবর মঙ্গলবার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার যুক্তি উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইবুনাল-১ এ মঙ্গলবার শুরুতেই মামলার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) থেকে দেওয়া ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদনটি পড়ে শোনান চিফ প্রসিকিউটর।
এরপর জুলাই আন্দোলনের বিভিন্ন তথ্যচিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি শেখ হাসিনার সঙ্গে হাসানুল হক ইনু, মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের টেলিফোনে কথোপকথনসহ কয়েকটি অডিও ফোনালাপ শোনানো হয়। একই সঙ্গে এ মামলায় পাঁচটি অভিযোগের সপক্ষে বিভিন্ন সাক্ষীর দেওয়া বর্ণনা উপস্থাপন করা হয়। পাশাপাশি গত বছর ১৪ জুলাই গণভবনে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন ও পরদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও প্রদর্শন করা হয়।
এরপর তাজুল ইসলাম বলেন, গণঅভ্যুত্থান চলাকালে শেখ ফজলে নূর তাপস, হাসানুল হক ইনু, অধ্যাপক মাকসুদ কামালের সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথনে সরাসরি হত্যার নির্দেশ দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। অন্যসব তথ্য-উপাত্ত বাদ দিলেও এই সরাসরি নির্দেশই শেখ হাসিনার অপরাধ প্রমাণে যথেষ্ট।
অডিওর বিষয়ে তিনি আরও বলেন, এসব কথোপকথনে কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছে। এর মধ্যে তাপসের সঙ্গে কথোপকথনে মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ, হেলিকপ্টার দিয়ে মানুষ হত্যার বিষয়ে স্পষ্টীকরণ এবং ড্রোন দিয়ে ছবি তুলে আন্দোলকারীদের অবস্থান নির্ণয়ের বিষয় উল্লেখযোগ্য।
ইনুর সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথন বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এই কথোপকথনে কারফিউয়ের পর যেন আন্দোলনকারীরা মাঠে নামতে না পারে, সে জন্য আওয়ামী লীগ ও অন্য দলগুলোকে মাঠে নামানো, আন্দোলনকারীদের জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করা, জামায়াত-শিবিরকে দমনে ইনুকে দেওয়া নির্দেশনার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। এখানে তাঁর ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’র বিষয়টি স্পষ্ট।
যুক্তিতর্কে তাজুল ইসলাম বলেন, পুলিশের বিভিন্ন নির্দেশনা বিশ্লেষণ করে জানা যায়, প্রতিটি থানার সামনে এলএমজি পোস্ট স্থাপনের নির্দেশনা ছিল। এই নির্দেশনা ছিল আন্দোলনকারীদের হত্যার উদ্দেশ্যে। আন্দোলনে নিহতদের শরীর থেকে উদ্ধারকৃত বুলেট ও পিলেট থেকে বিশ্লেষণ করে মারণাস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এদিকে কুষ্টিয়ায় ছয় হত্যার অভিযোগে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের ওপর আগামী ২৩ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। আসামিপক্ষের সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ মঙ্গলবার এ আদেশ দেন।
স্বৈরাচার হাসিনাকে হাজির হতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ
‘জয় বাংলা ব্রিগেড’-এর অনলাইন মিটিংয়ে অংশ নিয়ে অংশ নিয়ে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে উৎখাত ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় স্বৈরাচার হাসিনাসহ ২৬১ জন আসামিকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত।
মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) আদালত পুলিশের প্রতিবেদনের পর পলাতক আসামিদের হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আদেশ দেন। এর আগে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। তবে পুলিশ আদালতকে জানিয়েছে, আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ম অনুযায়ী পলাতক আসামিদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে পত্রিয়ায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আদেশ দেন মহানগর হাকিম জুয়েল রানা।
সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. সালাহউদ্দিন বলেন, আগামী ১১ নভেম্বর মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন বিচারক।
এদিকে সাবেক সংসদ সদস্য সাবিনা আক্তার তুহিনসহ ২৪ জনকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
গ্রেপ্তার দেখানো অপর আসামিরা হলেন- মো. ইব্রাহীম খলিল বিপুল, মো. আব্দুস সবুর, মোছা. ছানোয়ারা খাতুন, মেহেদী হাসান আকাশ, এ কে এম আকতারুজ্জামান, কে এম রাশেদ, মোছা. মেরিনা খাতুন মেরি, সুশান্ত ভৌমিক, নিজাম বারী, জাহাঙ্গীর আলম, শেখ আনিচুজ্জামান আনিচ, মো. আকরামুল আলম, মো. নুর উন নবী মন্ডল দুলাল মাস্টার্স, মো. সাইফুল ইসলাম সর্দার, কাজী আবুল কালাম, মোছা.ফেন্সী, কে এম শাহ নেওয়াজ ওরফে শিবলু, রফিকুল ইসলাম, জিন্নাত সুলতানা ঝুমা, মেহেদী হাসান ঈশান ওজনি চন্দ্র সূত্রধর।
সিআইডির পক্ষ থেকে এই ২৪ জনকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়। তাদের পক্ষে জামিন আবেদনের শুনানি করেন আইনজীবীরা। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জামিনের বিরোধিতা করা হয়। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এর আগে এ মামলায় একজন আসামিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল। নতুন ২৪ জনকে নিয়ে গ্রেপ্তার আসামির সংখ্যা হল ২৫ জন।
গত ২৭ মার্চ শেখ হাসিনাসহ ৭৩ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে আদালতে মামলাটি করেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মো. এনামুল হক। তদন্ত শেষে গত ৩০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ ২৮৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তিনি।
১৪ অগাস্ট অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। গত ১১ সেপ্টেম্বর আসামিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রাব্বী আলমের নেতৃত্বে ‘জয় বাংলা ব্রিগেড’-এর জুম মিটিংয়ে অংশ নেন কয়েকশ নেতাকর্মী। এ সময় শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের সামনে ‘দেশবিরোধী’ বক্তব্য দেন। এতে হাসিনা বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উৎখাতের নির্দেশ দেন। এ বক্তব্য সারা দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
খুলনার যুবলীগ নেতা পারভেজ খান ইমন, চট্টগ্রাম ‘জয় বাংলা ব্রিগেড’ প্রধান কবিরুল ইসলাম আকাশ, ‘জয় বাংলা ব্রিগেড বরিশাল বিভাগের অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সোহানা পারভীন রুনা, হাফিজুর রহমান ইকবাল, অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান মধু, এলাহী নেওয়াজ মাছুম, সাজ্জাদুল আনামও রয়েছেন মামলার আসামিদের মধ্যে।