সকাল ৮টা বাজতেই টোকিওর কোলাহল পেছনে ফেলে যাত্রা শুরু করল আমাদের বাস। ‘জাপান প্যানোরামিক ট্যুরস’-এর সাদা-নীল রঙের এই বাস যেন ভোরের আলোয় নিজেই এক চলমান গল্পের বই। সিটে বসে আমি জানালার বাইরে তাকাই, আর পথ যেন আস্তে আস্তে কবিতার ছন্দে ভরে ওঠে। টোকিও অফিসপাড়ার উঁচু উঁচু টাওয়ারগুলো সোনালি রোদে ঝলমল করছে। আমরা হাইওয়েতে পা রাখলাম। বাস এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। তারপর কংক্রিটের দেয়াল ভেঙে আস্তে আস্তে উঁকি দিচ্ছে প্রকৃতি।
হাইওয়ের দুপাশে ঝাঁকড়া সবুজ পাহাড়, সারি সারি সিডার আর পাইনগাছ বাতাসে দুলছে। ছোট ছোট গ্রাম পেরিয়ে যাচ্ছি আমরা। ছাদের ওপর নীল টালি, উঠোনে ঝুলছে রঙিন কিমোনো শুকানোর জন্য। কখনো দেখা দেয় সরু নদী, যার জল ঝিকমিক করে সূর্যের আলোয়, যেন আকাশ নিজের আয়না রেখে দিয়েছে পৃথিবীর বুকে। পাহাড়ি নদী রুপালি আলোয় ঝিকমিক করছে আর কৃষিজমি সুশৃঙ্খল রেখায় সাজানো যেন কারো আঁকা চিত্র।
হঠাৎই গাইড ঘোষণা করলেন-‘এবার শুরু হচ্ছে মেলোডি রোড।’ সবার চোখে কৌতূহল। রাস্তা তো কেবল রাস্তা-সেখানে আবার সুর বাজবে কীভাবে? গাইড জানালো জাপানে কিছু বিশেষ রাস্তা আছে যেখানে গাড়ি চালালে রাস্তার খাঁজগুলো থেকে সংগীত বাজে! টায়ারের ঘর্ষণ আর রাস্তায় কাটা বিশেষ খাঁজ মিলিয়ে সুর তৈরি হয়।
এগুলোকে বলা হয় মেলোডি রোড। ফুজি ফাইভ লেকস অঞ্চলের কাছে, বিশেষ করে ফুজি সুউবারু টোল রোড) এ।গাড়ি নির্দিষ্ট গতিতে (প্রায় ৪০ কিমি/ঘণ্টা) চালালে টায়ারের কম্পন রাস্তার খাঁজে আঘাত করে, আর তাতেই সুর বের হয়। এখানে বাজে বিখ্যাত জাপানি লোকগান Fuji no Yama। যার মানে ফুজির পাহাড়-এটা শিশুদের স্কুলে শেখানো হয়, একধরনের জাপানি জাতীয় গান ফুজিকে ঘিরে। গানটি ফুজি পর্বতের সৌন্দর্য আর পবিত্রতাকে প্রশংসা করে। আমরা আমাদের ট্যুরিস্টদের আনন্দ দানের জন্য এই মেলোডি রোডে নিয়ে এসেছি।
মেলোডি রোড দিয়ে আপনি যখন গাড়ি চালাবেন, তখন মনে হবে রাস্তা যেন আপনাকে গান শোনাচ্ছে। গাড়ি যদি দ্রুত বা ধীরে চালান সুর ভেঙে যাবে। তাই সঠিক গতিতে চালানোই মূল মজা। গাইডের কথা শেষ না হতেই আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। চাকার ঘর্ষণে রাস্তা যেন গাইতে শুরু করল। প্রথমে মৃদু কম্পন, তারপর স্পষ্ট সুর।
Fuji no Yama…
একটি প্রাচীন জাপানি গান, ফুজি পর্বতের প্রশংসায় লেখা, ধীরে ধীরে ভেসে এল। বাসের ভেতর সবাই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ ভিডিও করছিল, কেউ হাসিমুখে সুরের সঙ্গে তাল মিলাচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল আমরা শুধু রাস্তা পেরোচ্ছি না-প্রকৃতির সঙ্গে এক মেলবন্ধনে যাচ্ছি, যেন ফুজি নিজেই গান শোনাচ্ছে আমাদের। জানালার বাইরে তখন লেকের ঝিলিক, দূরে মেঘে ঢাকা পর্বতের চূড়া। সংগীত আর দৃশ্য মিলেমিশে তৈরি করেছিল এক অপার্থিব মুহূর্ত। মনে হচ্ছিল, এ ভ্রমণ কেবল চোখে দেখার নয়, কানে শোনারও। যাত্রা যখন শেষ হলো, সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসল। কারো মুখে কোনো কথা নেই, শুধু চোখে মুগ্ধতা। যেন বাসের সেই কয়েক মিনিট আমাদের জন্য আজীবনের এক স্মৃতি হয়ে রইলো।
মেলোডি রোড শিখিয়ে দিলো
প্রকৃতি শুধু দেখার নয়, শোনারও। আর মাউন্ট ফুজি? সে কেবল পাহাড় নয়, সে এক জীবন্ত কবিতা, এক অনন্ত গান। আস্তে আস্তে বাস পাহাড় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঁচু পথে উঠতে থাকল। অনেকটা দার্জিলিংয়ের মতো।
হঠাৎ দূরে দেখা দিলো সেই কাক্সিক্ষত দৃশ্য-
তুষার ঢাকা মাউন্ট ফুজি, নীল আকাশের বুক চিরে সগৌরবে দাঁড়িয়ে। বাসের ভেতর সবাই একসঙ্গে নিঃশ্বাস আটকে তাকিয়ে রইল, এ যেন প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ে যাওয়া। যে প্রেমের টানে আমিও ছুটে এসেছি নিউইয়র্ক থেকে এই জাপানে। মাউন্ট ফুজির বিশাল আর নিরব উচ্চশৃঙ্গটিকে দেখে মনে হচ্ছিলো প্রকৃতির এক অপূর্ব ক্যানভাস সামনে সাজানো। তার চূড়োটা বরফের সাদা সোনালি ঢাকনায় ঢাকা, আর নিচের পাদদেশে সবুজ বনভূমি যেন সোনালী জলে ডুবে আছে। হাওয়ায় ঠান্ডার সঙ্গে যে স্বচ্ছন্দ, হালকা শীতল কুয়াশা ভাসছে, তা মাউন্ট ফুজির চারপাশে যেন এক মায়াবী চাদর। দূরের পাখির ডাক আর নিঃশব্দে ঝরনাগুলোর সঙ্গ যেন প্রকৃতিকে কাব্যধর্মী করে তুলেছে।
মাউন্ট ফুজি দেখে মনে হচ্ছিলো এই পাহাড় শুধুই শিলা আর বরফের সমষ্টি নয়-এটি আত্মার এক ধ্যান, চোখের এক প্রার্থনা, আর হৃদয়ের এক গভীর নিশ্বাস। মুহূর্তের সেই নীরব সৌন্দর্য, যেন চিরকাল মনে থাকার মতো এক স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমরা বাস থেকে নেমে ফুজি লেকের পাশে পৌঁছলাম। সামনে বরফে ঢাকা মাউন্ট ফুজির শৃঙ্গ। সূর্যের রশ্মি ধীরে ধীরে বরফের ওপর সোনালি ছোঁয়া দিচ্ছে আর লেকের শান্ত জলে প্রতিফলিত হয়ে যেন স্বপ্নের মতো এক দৃশ্য তৈরি হচ্ছে। হাওয়ায় শীতলতা আর কুয়াশার মৃদু পরশ একসঙ্গে মিলেমিশে মনে করিয়ে দিচ্ছে-এ পাহাড় শুধু দেখার নয়, অনুভবেরও।
আমরা ধীরে ধীরে লেকের ধারে হাঁটছি। প্রতিটি পাথর, প্রতিটি গাছ যেন নিজস্ব কাব্য শোনাচ্ছে। দূরের পাখির ডাক, ঝরনার ধারা, আর সেই বিশাল মাউন্ট ফুজি-সব মিলিয়ে যেন একটা অবর্ননীয় পরিবেশ। বাতাসে হালকা তাজা গন্ধ, পাহাড়ের ঠান্ডা স্পর্শ-সব মিলিয়ে মনে হয় প্রকৃতি নিজেই কথা বলছে। আমরা শুধু শোনছি, তাকাচ্ছি এবং নিঃশ্বাস নিচ্ছি।
লেক থেকে বেরিয়ে আমরা এক ছোট ক্যাফেতে বসে চা খাচ্ছিলাম। জানালা দিয়ে ফুজির দিগন্ত রেখা দেখা যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো এটি শুধু পাহাড় দেখা নয়, এটি একদিনের কাব্যিক যাত্রা, যা মনে অমোঘ ছাপ ফেলে। প্রতিটি মুহূর্ত যেন চিরকাল স্মৃতিতে থাকবার মতো। বিদায় নেওয়ার সময় মনে হচ্ছিলো এই দিনটা শেষ নয়-এটি এক অভিজ্ঞতা, যা হৃদয়ে বেঁচে থাকবে চিরকাল।
আওকিগাহারা : মৃত্যুর বনে জীবনের প্রতিধ্বনি
আমরা বাসে গিয়ে বসলাম। এবারের গন্তব্য আওকিগাহারা বা সুইসাইড ফরেস্ট। এটা মাউন্ট ফুজির কাছেই। বাস ছুটে চলেছে পাহাড়ি পথ ধরে। জানালা দিয়ে চোখে ভেসে উঠছে পথের ছবি। বাইরে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল দৃশ্যপট-উঁচু দালানগুলোর জায়গা নিচ্ছে সবুজ পাহাড়, গ্রামীণ বাড়িঘর আর ধানক্ষেতের মায়াবী ছবি। ধূসর নগরীর পর সবুজে মোড়া উপত্যকা, ছোট ছোট গ্রাম, ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা। একটু পর আমরা পৌঁছে গেলাম আর এক রহস্যময় অরণ্য আওকিগাহারায়। এটা মাউন্ট ফুজির পাদদেশে বিস্তৃত এক ঘন অরণ্য, যার নাম শুনলেই হৃদয়ে নেমে আসে শীতলতা।
গাইড নিকিতা আমাকে শোনাচ্ছিল আওকিগাহারার ইতিহাস
আওকিগাহারার জন্ম হয়েছিল প্রায় ১২০০ বছর আগে, ফুজির ভয়াল আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের পর। গলিত লাভা স্তরে স্তরে জমে তৈরি করেছিল এই অরণ্যের পাথুরে মাটি। পরবর্তীকালে ঘন বৃক্ষরাজি এখানে জন্ম নিল, আর ধীরে ধীরে তা হয়ে উঠল রহস্যময় এক বন। কিন্তু প্রকৃতির সেই সৃষ্টি মানুষের কাহিনিতে পেলো অন্য নাম-‘সুইসাইড ফরেস্ট।’
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জাপানের লোককথায় এই বনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে মৃত্যু আর আত্মত্যাগের ইতিহাস। কেউ বলে, প্রাচীন যুগে এখানে দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের বয়স্ক বা অসুস্থ আত্মীয়দের ফেলে রেখে আসতো, যা ‘উবাসুতে’ নামে পরিচিত। আধুনিক কালে এই বনটি পরিচিত হয় আত্মহত্যার কেন্দ্র হিসেবে; অসংখ্য মানুষ তাদের শেষ যাত্রা বেছে নিয়েছে এই নিস্তব্ধ অরণ্যে।
বাস থেকে নেমে যখন বনের ভেতরে পা রাখলাম, তখনই বুঝলাম কেন এই জায়গা এতো রহস্যঘেরা। সূর্যের আলো বৃক্ষরাজির ঘন জালের ফাঁক দিয়ে সামান্যই প্রবেশ করে। পায়ের নিচে পাথুরে জমিন, যেটি লাভার স্তরে তৈরি। বাতাস ভারী আর আশ্চর্যভাবে নীরব। মাটির ভেতরের চৌম্বক প্রভাবের কারণে এখানে কম্পাস কাজ করে না-যেন বন নিজেই দর্শনার্থীকে দিকভ্রান্ত করে ফেলে।
আমার মনে হচ্ছিল বনের প্রতিটি গাছ যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে, প্রতিটি নিস্তব্ধতা যেন চাপা কান্না। তবুও এর মাঝে লুকিয়ে আছে অদ্ভুত সৌন্দর্য-ঝরনার মৃদু কলকল ধ্বনি, আর মাঝে মাঝে পাখির ডাক। মনে হলো মৃত্যু ও জীবনের এক অদ্ভুত সহাবস্থান ঘটেছে এই বনে। পাখির কণ্ঠে ভেসে আসছে নতুন দিনের গান। মনে হলো প্রকৃতি যেন বলছে-
‘মৃত্যু এখানে ঘনিয়ে এলেও, জীবন এখনো থেমে যায়নি।
কেউ কেউ বলে, এখানে হারিয়ে গেছে শত শত প্রাণ, মানুষের একাকিত্ব আর বেদনার গল্প মিশে আছে গাছের গায়ে। হাঁটতে হাঁটতে আমি অনুভব করলাম সেই নীরব কান্না, বাতাসে ভেসে বেড়ানো অদৃশ্য প্রশ্ন-
‘জীবন কি সত্যিই এত ভারী?’
আওকিগাহারার ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে যখন হঠাৎ এক ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম, দূরে মাউন্ট ফুজি দেখা দিল। সাদা তুষারের সেই পর্বত যেন বনের অন্ধকার ভেদ করে আলোর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হলো, ফুজি পাহাড় যেন ফিসফিস করে বলছে-
‘অন্ধকার যত গভীর হোক, জীবনের আলো একদিন এসে তাকে ছাপিয়ে যাবে।
মাউন্ট ফুজির সাদা তুষারশিখর যখন বনের মাথার ওপর থেকে তাকিয়ে থাকে, তখন সে যেন জীবনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। মৃত্যুর অন্ধকার বন আর জীবনের আলোর পর্বত-এই দুই বিপরীত সত্তা একই ভ্রমণে আমাকে শিখিয়ে দিল এক গভীর শিক্ষা। আওকিগাহারা আমার কাছে কেবল একটি বন নয়, বরং মানুষের বেদনা ও প্রকৃতির নীরব মহিমার মিলনস্থল। এখানে মৃত্যু আছে, আছে অন্ধকার ইতিহাস। তবুও একই সঙ্গে আছে জীবনের অমোঘ শিক্ষা-‘অস্তিত্বের ভার যতই অসহনীয় হোক, প্রকৃতি সব সময় আমাদের টেনে নেয় আলোয়।’ টোকিও থেকে মাউন্ট ফুজির পথে যে রঙিন দৃশ্যপট আমি দেখেছি, তা যেন ছিল জীবনের উজ্জ্বল দিক। আর আওকিগাহারার অরণ্য-মৃত্যুর স্মৃতিচিহ্নে মোড়া সেই নীরবতা-আমাকে মনে করিয়ে দিল, জীবনের সৌন্দর্য সবচেয়ে গভীরভাবে টের পাওয়া যায় মৃত্যুর ছায়ার কাছে এসেই।
হাকোনে রোপওয়ে-আকাশপথে এক স্বপ্নযাত্রা
এবারে আমাদের গন্তব্য হাকোনে রোপওয়ে। জাপানের কানাগাওয়া প্রদেশের পাহাড়ঘেরা হাকোনে অঞ্চল যেন প্রকৃতির কোলে লুকিয়ে থাকা এক নীরব আশ্রম। চারপাশে সবুজ পাহাড়, আগ্নেয় মাটি আর উষ্ণ প্রস্রবণের ধোঁয়ায় ঢাকা রহস্যময় পরিবেশ-এ সবকিছুর মাঝখানেই বিস্তৃত সেই বিখ্যাত হাকোনে রোপওয়ে। এটি কেবল একটি যাত্রাপথ নয়, বরং আকাশের ওপরে ঝুলে থাকা এক কাব্যিক স্বপ্ন।
গাইড নিকিতা জানায়, রোপওয়ের ইতিহাস শুরু হয় ১৯৬০ সালে। তখন জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে থেকে ধীরে ধীরে পুনর্জন্ম নিচ্ছিল। এই রোপওয়ের সূচনা কেবল প্রযুক্তির উন্নতি নয়, বরং নতুন আশার প্রতীক ছিল। পাহাড়ের গা বেয়ে, আগ্নেয়গিরির ধোঁয়া পেরিয়ে যখন রোপওয়ে এগোয়, মনে হয় জাপানের নিজস্ব সাহস আর পুনরুত্থানের গল্পও যেন একসঙ্গে উড়ছে আকাশে।
আমাদের যাত্রা শুরু হয় সুনজান পাহাড়ি স্টেশন থেকে। ক্যাবল কারটি ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু করলে নিচে দেখা যায় বিস্তীর্ণ বন, ছোট নদী, আর দূরে নীলাভ লেক আশি। হাওয়ায় একধরনের তাজা শীতল গন্ধ, মনে হয় প্রতিটি নিঃশ্বাসে প্রকৃতির স্পর্শ মিশে আছে। রোপওয়ে যখন মেঘের স্তরে ঢুকে পড়ে, জানালার কাচে ছোট ছোট জলের ফোঁটা জমে আর বাইরে সাদা কুয়াশার আড়ালে দেখা যায় মাউন্ট ফুজির পরমশ্বেত চূড়া। সেই দৃশ্য এক মুহূর্তে মনকে থামিয়ে দেয়।
রোপওয়ের মাঝপথে আসে সবচেয়ে বিখ্যাত স্টেশন-ওওয়াকুদানি, যার অর্থ ‘বড় ফুটন্ত উপত্যকা’। প্রায় তিন হাজার বছর আগে এক ভয়াবহ আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে এ উপত্যকা সৃষ্টি হয়েছিল। আজও এখানকার মাটি থেকে বের হয় উষ্ণ ধোঁয়া, সালফারের তীব্র গন্ধে চারপাশ ভরে থাকে। রোপওয়ে থেকে নামতেই বাতাসে ভেসে এলো সালফারের গন্ধ। চারপাশে গরম ধোঁয়া উঠছে, যেন মাটির গভীর থেকে পৃথিবীর নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসছে। স্টেশনটি পাহাড়ের মাঝে চারদিক জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ধূসর পাথর আর বাষ্পে ঢাকা গর্ত। পায়ের নিচের মাটি উষ্ণ, বাতাসে ধোঁয়ার কুয়াশা, আর দূরে পাহাড়ের কোলে সূর্যের আলো যেন প্রকৃতি নিজেই এখানে এক অনন্ত পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছে।
ওওয়াকুদানির সবচেয়ে বিখ্যাত আকর্ষণ হলো Kuro-tamago, অর্থাৎ ‘কালো ডিম’। সালফারের গরম পানিতে সিদ্ধ করার ফলে ডিমের খোসা কালো হয়ে যায়। লোককথায় আছে, একটি ডিম খেলে আয়ু সাত বছর বাড়ে! স্টেশনের পাশে ছোট্ট দোকানে এই ডিম কিনে পর্যটকেরা ধোঁয়ায় ভরা পাহাড়ের ধারে দাঁড়িয়ে ফুজি পর্বতের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ডিমের উষ্ণতা আর প্রকৃতির ঠান্ডা বাতাস, জীবন ও আগুনের অদ্ভুত মিলন যেন। গাইড নিকিতা জানায়, পরিষ্কার দিনে এখান থেকে দেখা যায় মাউন্ট ফুজির মহিমান্বিত চূড়া। ধোঁয়ার আড়াল থেকে যখন হঠাৎই ফুজির সাদা তুষারময় মাথা দেখা দেয়, তখন মনে হয় প্রকৃতি নিজেই পর্দা সরিয়ে দিলো। ওওয়াকুদানির ধোঁয়ার ভেতর দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি, চারপাশে আগ্নেয়গিরির নিঃশ্বাস, বাতাসে সালফারের গন্ধ, মনে হচ্ছিল জীবন আর আগুনের মাঝের রেখাটা কত সূক্ষ্ম,তবু কত গভীরভাবে সুন্দর।
ওওয়াকুদানি শুধুই একটি স্টেশন নয়-এটি পৃথিবীর গভীরের গল্প, যেখানে আগুন, ধোঁয়া, আর নিস্তব্ধতার মধ্যেও জীবন গান গায় নিজের ভাষায়। ওওয়াকুদানির পর রোপওয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামে, সামনে উন্মোচিত হয় নীল লেক আশির জলরাশি। তার পাড়ে টোরি গেট মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, জলে তার প্রতিফলন দুলছে। দূরে মাউন্ট ফুজি তখনো স্থির আকাশে মেঘ ভাসছে, আর সূর্যের আলো ক্রমে নরম হয়ে আসছে।
হাকোনে রোপওয়ে কেবল পরিবহন নয়, এটি এক ধ্যানমগ্ন যাত্রা। প্রতিটি কেবল কার যেন আকাশে ভাসমান এক নীরব কবিতা, যার প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি বাঁক মনে শান্তি এনে দেয়। ইতিহাস, প্রকৃতি ও প্রযুক্তির মিলনে এই রোপওয়ে জাপানের এক অনন্য গর্ব, যেখানে প্রতিটি যাত্রাই মনে হয় আকাশছোঁয়ার মতো এক মুগ্ধ অভিজ্ঞতা।
সামুরাই ভিলেজে দুপুরের বিরতি
হাকোনো রোপওয়ে থেকে নামার পর আমরা লেক আশির পথে রওনা হলাম। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলতে চলতে হঠাৎই গাইড জানালেন, ‘এখানে এক পুরোনো সামুরাই গ্রাম আছে, একটু থামবো।’
গাড়ি থামতেই মনে হলো, সময় যেন কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে গেল। গ্রামের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে আছে কাঠের তৈরি পুরোনো ফটক। তার ওপরে জাপানি প্রতীক খোদাই করা যেন এক প্রাচীন শক্তির চিহ্ন। ভেতরে ঢুকতেই দেখা মিললো খড়ের ছাউনির নিচে তৈরি সামুরাই বাড়িগুলোর, যেখানে প্রতিটি জানালা, প্রতিটি কাঠের ফালি বলছে ইতিহাসের গল্প।
মেঝেতে রাখা তলোয়ার, পুরোনো বর্ম, কাঠের ঢাল
যেগুলো একদিন যুদ্ধক্ষেত্রে গর্জে উঠেছিল,
আজ সেগুলো নিস্তব্ধতার স্মৃতিচিহ্ন হয়ে আছে।
তাদের ঘর নিখুঁত, উঠোনে বয়ে চলা ছোট্ট পানির ধারা, আর ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো প্রাচীন ক্যালিগ্রাফি যেন তাদের মানসিক অনুশাসনের প্রতীক। গ্রামের মাঝখানে ছোট্ট একটি কাঠের ঘরে আমাদের লাঞ্চের আয়োজন ছিল। নিচু টেবিল, টাটামি মাদুরে বসা, আর জানালার পাশে বয়ে চলা পাহাড়ি হাওয়া-সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল আমি যেন কোনো প্রাচীন সামুরাইয়ের আতিথ্যে আছি।
প্লেটে পরিবেশন হলো তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার।
ভাত, মিসো স্যুপ, গ্রিল করা মাছ, সামান্য আচার,
আরেক পাশে সাজানো ছোট্ট এক বাটি চা।
গাইড নিকিতা জানালো, এটাই সামুরাইদের জীবনদর্শন-‘সাদামাটা খাবার, কিন্তু মন পূর্ণ তৃপ্তিতে।’
লাঞ্চ শেষে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
দূরে পাহাড়ের কোলে সূর্যের আলো নরম হয়ে আসছে। বাতাসে হালকা পাতার শব্দ। আমি ভাবছিলাম, এ মানুষগুলো শুধু যুদ্ধ করেনি, তারা জীবনের শৃঙ্খলা শিখিয়েছে সময়কে। তাদের তলোয়ারের ঝলক শুধু আগুন নয়, ছিল দায়িত্ব, সততা, আর আত্মসংযমের প্রতীক।
লেক আশি : পাইরেট শিপে এক ঘণ্টার জাদুকরী ভ্রমণ
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লেক আশি। আজকের ভ্রমণসূচীতে এটাই আমাদের শেষ গন্তব্য। মাউন্ট ফুজি থেকে অল্প দূরে, পাহাড়ের কোলে লুকানো লেক আশি যেন স্বপ্নের মতো। এখানে, সময় যেন ধীর হয়ে যায়। আর এই শান্ত লেককে ঘিরে সবচেয়ে জনপ্রিয় আকর্ষণ হলো ‘পাইরেট শিপ’-ভ্রমণকারীদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
জাপান প্যানারমিক ট্যুরসের মাধ্যমে সারাবিশ্বের ৪৫ জন যাত্রী এই ভ্রমণে। জলদস্যুদের জাহাজের অবিকল বানানো এই জাহাজে আমাদের ভ্রমণ। জাহাজের সামনে একজন জলদস্যু আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত। জাহাজের ঢেকে কামান লাগানো। পুরো জাহাজটিতে একটি পাইরেট জাহাজের আবহ তৈরি করা হয়েছে।
বিকালের সূর্য সোনালি আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল লেক আশির তীরে। দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম সেই বিশাল, কালো ‘পাইরেট শিপ’-যা জাপানের ঐতিহ্যবাহী লেক ক্রুজের অন্যতম আকর্ষণ। জাহাজের শিকড়ের মতো দেহ ও উঁচু মূর্ত শুঁড়, এবং উড়ন্ত পতাকার সঙ্গে একে যেন সরাসরি কার্টুন বা গল্পের বই থেকে বেরিয়ে এসেছে মনে হচ্ছিল।
জাহাজের ডেকে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে মনেই হচ্ছিলে আমি যেন কোনো সাহসিক গল্পের চরিত্র। কালো পতাকা বাতাসে দুলছে, জাহাজের কাঠের শব্দে যেন অতীতের গল্প ফিরে আসে। ধীরে ধীরে জাহাজ চলতে শুরু করলে লেকের শান্ত নীল জলে প্রতিফলিত হয় আশেপাশের সবুজ পাহাড়। দূরে দেখা দেয় মর্যাদাশীল মাউন্ট ফুজির শীর্ষ লেকের সৌন্দর্যের সঙ্গে মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
শিশুরা জাহাজের ডেকে চিৎকার করে খেলছে, পর্যটকরা ক্যামেরায় মুহূর্তগুলো ধরে রাখছে। মাঝখানে রাখা চায়ের দোকান থেকে তাজা সবুজ চা আর স্থানীয় মিষ্টি কিনে বসার সঙ্গে সঙ্গে অনুভূতি আরো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। লেকের ধারে ধারে ছোট ছোট বোট হাউস, ঐতিহ্যবাহী কাঠের বাড়ি আর সাদা সিক্কদারী রেস্তোরাঁ যেন ইতিহাসের পাতা খুলে দিচ্ছে।
জাহাজটি লেকের মাঝখানে থেমে দাঁড়ালে, চারপাশের নীরবতা, হালকা কুয়াশা এবং ফুজির পেছনের সাদা বরফাচ্ছন্ন শীর্ষ এক অনন্য অনুভূতি সৃষ্টি করে। এই এক ঘণ্টার ভ্রমণ শুধু দৃষ্টি নয়, মনকেও জাগিয়ে তোলে।
শেষে ঘাঁটিতে ফিরে আসার পর, মনে হয় যে এই পাইরেট শিপ ভ্রমণ কেবল দর্শনীয় স্থান নয়, বরং জাপানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যকে ছোঁয়ার এক জাদুকরী অভিজ্ঞতা।
বাসে এলেও টোকিও ফেরার ব্যবস্থা ছিল বুলেট ট্রেনে। গাইড আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেল ট্রেন স্টেশনে। ট্রেন ছুটে চললো টোকিওর পথে। জানালার বাইরে অন্ধকারে ম্লান হয়ে গেল পাহাড়ের ছায়া। কিন্তু মনে রয়ে গেল এক অদ্ভুত প্রশান্তি-যেন ফুজির নিঃশব্দ সৌন্দর্য, আউকিগাহারার রহস্য, হাকোনের মেঘভেজা আকাশ আর লেক আশির নীল জল মিলেমিশে হৃদয়ে রচনা করেছে এক দিনের অনন্ত কবিতা।
১০ অক্টোবর ২০২৫