১৮ অক্টোবর ২০২৫, শনিবার, ০৪:৪৫:৪৯ পূর্বাহ্ন


টোকিও ন্যাশনাল মিউজিয়ামে একদিন
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-০৯-২০২৫
টোকিও ন্যাশনাল মিউজিয়ামে একদিন টোকিও টাওয়ার


টোকিওর উয়েনো পার্কে ঢুকতেই মনে হলো, আমি যেন শহরের কোলাহল থেকে বেরিয়ে এক শান্ত মন্দিরে এসে পড়েছি। আমার সামনে সবুজে লেখা একটা কবিতার বই। চারদিকে বিশাল সবুজ, পাখির ডাক, আর হালকা বাতাসে চেরি গাছের পাতার দোল। সেই সবুজের বুকেই দাঁড়িয়ে আছে টোকিও ন্যাশনাল মিউজিয়াম, যা জাপানের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর শিল্পকলার এক জীবন্ত ভান্ডার। জাপানের আত্মাকে ধারণ করে রাখা এক বিশাল অট্টালিকা। মিউজিয়ামের বিশাল প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ভেতরে ঢকতেই মনে হলো আমি যেন সময়ের ঘূর্ণিপাকে পিছিয়ে যাচ্ছি। আমি আর সাধারণ দর্শক নই। আমি এক সময়ের ভ্রমণকারী।

ভেতরে ঢুকতেই প্রথম যে দৃশ্য আমাকে স্তব্ধ করে দিলো, তাহলো সমুরাইদের বর্ম আর তলোয়ার। কাচের ঘেরাটোপে রাখা সে বর্মের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করতেই যেন শুনতে পেলাম-ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ, যুদ্ধক্ষেত্রের হাঁকডাক আর তলোয়ারের ঝলসানো আগুন। মনে হলো, সমুরাইরা এখনো জীবন্ত, কেবল নিদর্শনে আবদ্ধ। প্রতিটি বর্মে ইতিহাসের দাগ, আর প্রতিটি তলোয়ারে লেখা সাহসের গান। চকচকে লোহার সাজপোশাকে কল্পনা করলাম সে সাহসী যোদ্ধাদের, যারা একসময় যুদ্ধক্ষেত্রে লড়েছিল নিজের সম্মান আর রাজ্যের জন্য। একটু এগিয়ে গিয়েই পড়লাম রঙের এক স্বপ্নরাজ্যে। দেওয়ালে সাজানো জাপানি চিত্রকলা ও ক্যালিওগ্রাফি। এখানে মৃদু তুলির আচঁড়ে ফুটে উঠেছে পাহাড়, নদী, ফুল আর ঋতুর গান। কখনো বসন্তের চেরিফুল, কখনো শরতের লাল পাতার নরম বিষাদ। একটি ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হলো, আমি যেন প্রবেশ করলাম এক শরতের বনে, চারদিকে শুধু আগুন-রঙা পাতার ঝরনা। তুলির আঁচড় যেন নিজেই নাচছিল কাগজের গায়ে। আমি ক্যামেরায় ধরে রাখলাম, এক শরতের বনভূমি আঁকা ছবি, যার লাল পাতার রঙ লেন্সের ভেতর দিয়ে যেন আমার চোখে সরাসরি ঢুকে গেল।

এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা বুদ্ধের মূর্তি আমাকে থামিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করা সে মুখে অদ্ভুত প্রশান্তি। মনে হলো, পৃথিবীর সব দুঃখ ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে। তার শান্ত মুখ দেখে মনে হলো, চারদিকের কোলাহল মুছে গিয়ে মন ভরে যাচ্ছে প্রশান্তিতে। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি ছবিতে, প্রতিটি খোদাই করা মূর্তিতে যেন একেকটি গল্প লুকিয়ে আছে। 

চীন, কোরিয়া ও অন্যান্য এশীয় দেশের শিল্পকর্মও এখানে সাজানো, যা বলে দেয় জাপানের সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ইতিহাস কত গভীর। আর জাপানের ঐতিহ্যবাহী কিমোনো, সিরামিকস, প্রাচীন চা-পাত্র দেখে বিস্মিত হলাম, কী নিখুঁতভাবে শিল্প আর জীবনকে মিলিয়ে নিয়েছিল তারা। মনে হচ্ছিল প্রতিটি জিনিস যেন ফিসফিস করে বলছে, ‘আমরা শুধু বস্তু নই, আমরা যুগের সাক্ষী’। কল্পনায় দেখলাম, এক জাপানি নারী প্রাচীন কিমোনো পরে জানালার ধারে বসে আছেন, হাতে চায়ের কাপ আর বাইরে চেরি ফুল ঝরছে।

মিউজিয়ামের করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো আমি আসলে ইতিহাসের বুকের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। যেখানে ইতিহাস গল্প বলে, নিদর্শনগুলো কবিতা হয়ে ওঠে আর প্রতিটি গ্যালারির আলো-অন্ধকারে লুকিয়ে আছে শত শত বছরের স্মৃতি। আলো আর অন্ধকারের খেলা, নিদর্শনের নীরবতা আর মানুষের সৃষ্টির মহিমা মিলিয়ে এখানে তৈরি করছে এক অন্তহীন সিম্ফনি। মিউজিয়ামের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, উয়েনো পার্কের সবুজে ছড়িয়ে পড়েছে সূর্যের আলো। রোদ ঝরে পড়েছে চেরি গাছের পাতায়। মনে হলো, টোকিও ন্যাশনাল মিউজিয়াম শুধু ইতিহাস দেখায় না, বরং এক কবিতার মতো অতীতকে ছুঁতে দেয় এবং বর্তমানে বাঁচতে শেখায়। এটি শুধু একটি জাদুঘর নয়, সময়ের সেতুবন্ধন, অতীত আর বর্তমানকে মিলিয়ে দেওয়া এক জীবন্ত পাঠশালা।

শপিং ও এন্টারটেনমেন্টের স্বর্গ-শিনজুকু

শিনজুকু টোকিওর এমন এক এলাকা, যেখানে দিনরাত সমান জমজমাট। বিশাল শপিংমল, ডিপার্টমেন্ট স্টোর, ইলেকট্রনিকস মার্কেট আর ফ্যাশন বুটিক-সবই এখানে একসঙ্গে পাওয়া যায়। একদিকে লাক্সারি ব্র্যান্ডের ঝলমলে শোরুম, অন্যদিকে সস্তা কিন্তু স্টাইলিশ দোকান, যা প্রতিটি ক্রেতার মন ভরায়। শুধু শপিং নয়, শিনজুকু রাত নামলেই হয়ে ওঠে এন্টারটেনমেন্টের রাজধানী। কাবুকিচোর নিয়ন আলো, ইজাকায়া (জাপানি পানশালা), সিনেমা হল আর লাইভ শো মিলিয়ে এখানে রাত যেন শেষ হয় না। তাই টোকিও ভ্রমণে আসলে শিনজুকু ঘুরে দেখা মানে একসঙ্গে শপিং আর বিনোদনের ভিন্নমাত্রার অভিজ্ঞতা পাওয়া।

আমার হোটেলটি এ সিনজুকু এলাকায়। এটি টোকিওর সবচেয়ে ব্যস্ত, আধুনিক ও প্রাণবন্ত এলাকার মধ্যেই অবস্থিত। সিনজুকুর রাস্তা সব সময় ব্যস্ত এবং জীবন্ত। সকালে মানুষ অফিস বা স্কুলের পথে, বিকালে শপিং এবং ডিনারের জন্য শহরের পথে। গাঢ় আলো ও লাল-নীল সাইনবোর্ড, হাইটেক বিল্ডিং আর ট্রেন ও বাসের হুইসেল-সব মিলে শহরের গতিশীলতায় ও আধুনিকতার ছাপ ফেলেছে।

সিনজুকুতে আছে বিশাল শপিংমল, ইলেকট্রনিকস দোকান, রেস্তোরাঁ ও স্ট্রিট ফুড স্টল। ডিপার্টমেন্ট স্টোরের জানালায় ঝলমল করা ভিজ্যুয়াল আর মানুষের ভিড় শহরের প্রাণকে স্পন্দিত করে। সিনজুকুর রাতের দৃশ্য একেবারেই ভিন্নরূপে দেখা যায়। বার, নাইট ক্লাব, রেস্তোরাঁগুলো আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শহরের ব্যস্ততা এখানে নতুন রূপ নেয়, আলো আর মানুষের মিলন শহরের রাতকে প্রাণবন্ত করে।

সিনজুকু স্টেশন হলো টোকিওর অন্যতম বড় ট্রান্সপোর্ট হাব। যেখানে জেআর লাইন, মেট্রো, বাস সব মিলিয়ে শহরের যে কোনো কোণে পৌঁছানো যায়। ট্যাক্সি বা সাইকেল ভাড়া করেও শহরের আশেপাশ ঘুরে দেখা সম্ভব। শহরের মধ্যে ছোট পার্ক ও গাছপালা শহরের ব্যস্ততাকে কিছুটা প্রশান্তি দেয়। মানুষ এখানে চা বা কফি নিয়ে বসে শহরের ভোর বা বিকেল উপভোগ করে। সংক্ষেপে বলা যায় সিনজুকু হলো শহরের ব্যস্ততা, আধুনিকতা, শপিং এবং রাতের আলোকোজ্জ্বলতার মিলনক্ষেত্র। প্রতিটি মোড়, রাস্তা ও শপিং স্ট্রিট যেন জীবন্ত শহরের গল্প বলে। সিনজুকু এলাকায় দেখার মত অনেক স্থান রয়েছে।

সিনজুকু গিয়োগেন্ডো পার্ক : এটি একটি বিশাল, শান্ত উদ্যান যা শহরের ব্যস্ততার মাঝেও প্রশান্তি দেয়। জাপানি, ফরাসি ও ইংরেজি স্টাইলের উদ্যান মিলেমিশে রয়েছে। বসন্তে চেরি ব্লসম, গ্রীষ্মে সবুজের ছোঁয়া, শরতে লাল-সোনালি পাতা-সব কিছুই চোখে আনন্দ দেয়।

টোকিও মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট বিল্ডিং : ২৪৫ মিটার উঁচু এ স্কাইস্ক্র্যাপার থেকে ফ্রি অবজারভেশন ডেক থেকে পুরো টোকিও শহরের প্যানোরামিক দৃশ্য দেখা যায়। রাতে শহরের আলো ঝলমল করে আর দূরে মাউন্ট ফুজিও দেখা যায় স্বচ্ছ দিনগুলোতে।

ওকিউডু আর্টস সেন্টার ও থিয়েটার : সিনজুকুতে বিভিন্ন আর্ট গ্যালারি ও লাইভ পারফরম্যান্স কেন্দ্র রয়েছে। জাপানের আধুনিক শিল্প ও সংস্কৃতি অনুধাবনের জন্য এটি আদর্শ স্থান।

ওকুবো কোরিয়ান টাউন : বিভিন্ন কোরিয়ান রেস্তোরাঁ, বেকারি ও স্ট্রিট ফুডের জন্য বিখ্যাত। এখানকার রঙিন মার্কেট, খাবারের ঘ্রাণ ও মানুষের ভিড় শহরের প্রাণকে আরো প্রাণবন্ত করে।

নাইটলাইফ ও বার এলাকা : সিনজুকুর Kabukicho হল টোকিওর সবচেয়ে ব্যস্ত নাইটলাইফ এলাকা। রেস্তোরাঁ, বার, ক্লাব এবং লাইটেড গলিপথ রাতে শহরের আলো ঝলমল করে।

শপিং এলাকা : সিনজুকুতে আছে Takashimaya, Isetan, OdaKzu, Keio-এর মতো ডিপার্টমেন্ট স্টোর। স্ট্রিট শপিং, ইলেকট্রনিকস, ফ্যাশন, স্মার্টফোন খোঁজার জন্য উপযুক্ত।

থিয়েটার ও সিনেমা হল : সিনেমা, কনসার্ট, থিয়েটার এবং লাইভ পারফরম্যান্স শহরের বিনোদনকে পূর্ণ করে। সংক্ষেপে, সিনজুকু হলো-প্রকৃতি, আকাশচুম্বী বিল্ডিং, শপিং, নাইটলাইফ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের এক জীবন্ত মিলনক্ষেত্র। এখানকার প্রতিটি মোড়, গলি ও স্ট্রিট শহরের রূপ, আধুনিকতা ও জীবনধারার গল্প বলে।

আকাশছোঁয়া টোকিও টাওয়ার 

ছবি দেখে অনেকে প‍্যারিসের আইফেল টাওয়ার বলে ভুল করবেন। আসলে কিন্তু তা নয়। এটি জাপানের টোকিও টাওয়ার। টোকিওর আকাশরেখায় চোখে পড়ার মতো যে স্থাপনা দিনের আলো থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত শহরকে আলোকিত করে রাখে, সেটি হলো এই টোকিও টাওয়ার। এটা শুধু ইস্পাতের কাঠামো নয়, এটি হলো জাপানের পুনর্জন্ম, আধুনিকতা আর স্বপ্নের প্রতীক। ১৯৫৮ সালে যখন টোকিও টাওয়ারের নির্মাণ শেষ হয়, তখন জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল। ফরাসি আইফেল টাওয়ারের অনুপ্রেরণায় তৈরি হলেও এটি তার থেকেও প্রায় ৩৩৩ মিটার উচু। টাওয়ারের ইস্পাতের একাংশ নেওয়া হয়েছিল কোরীয় যুদ্ধের মার্কিন ট্যাঙ্ক থেকে। শুরুতে এর মূল উদ্দেশ্য ছিল টেলিভিশন সম্প্রচার, কিন্তু ধীরে ধীরে এটি হয়ে উঠেছে টোকিও শহরের আইকন।

টোকিওর মানুষ একে কেবল একটি সম্প্রচার টাওয়ার হিসেবে নয়, বরং নতুন যুগের আশার প্রতীক হিসেবে দেখে। এ টাওয়ার, জাপানের আধুনিকতা এবং স্থাপত্যের এক চিহ্ন। একসঙ্গে এটি একটি পর্যটক আকর্ষণ ও টেলিভিশন সম্প্রচারের কেন্দ্র। দিনের আলোয় সূর্যের কিরণে ঝলমল করতে করতে যখন এটি দাঁড়িয়ে থাকে, তখন মনে হয় যেন কোনো শিল্পীর হাতে আঁকা এক বিশাল তুলি। চারপাশের কোলাহল, রাস্তায় গাড়ির ভিড়, মানুষের ব্যস্ততা-সবকিছুর মাঝেও টাওয়ারটি যেন শান্ত সৌন্দর্যে আকাশ ছুঁতে চায়।

সূর্য অস্ত গেলেই টাওয়ার পরিণত হয় এক আলোকমালার কন্যায়। রাতেই প্রকাশ পায় এর আসল সৌন্দর্য। হাজার হাজার বাতি জ্বলে ওঠে যেন টোকিও শহরের প্রাণকেন্দ্রে এক বিশাল প্রদীপ প্রজ্বলিত হয়েছে। প্রেমিকযুগল টাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন বোনে, পর্যটকরা ক্যামেরায় বন্দি করে শহরের রূপকথা। টাওয়ারে জ্বলে ওঠে প্রায় ১৮০টি আলো, যা ঋতু আর উৎসব অনুযায়ী রং বদলায়। কখনো সোনালি, কখনো নীল, আবার কখনো লাল-সবুজে ভরে ওঠে এর শরীর। দূর থেকে মনে হয় যেন টোকিও শহর নিজেই এক বিশাল লণ্ঠন জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে।

টাওয়ারের ওপর উঠে শহরকে দেখলে মনে হবে টোকিওর প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি নদী, প্রতিটি সেতু যেন নিচে ছোট ছোট গল্প হয়ে বসে আছে। দূরে ফুজি পর্বতের শীতল ছায়া, কাছে অসংখ্য উজ্জ্বল ভবন-সব মিলিয়ে যেন আকাশ থেকে পৃথিবী দেখার এক কাব্যিক জানালা খুলে দিয়েছে এ টোকিও টাওয়ার। টোকিও টাওয়ার শুধু একটি পর্যটনকেন্দ্র নয়; এটি টোকিওর স্বপ্ন, মানুষের আশা আর সময়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠা সৌন্দর্যের প্রতীক। প্রতিবার তাকালে মনে হয়, এ শহর যতই বদলাক, এ টাওয়ারের বুকে জ্বলে থাকা আলো চিরকাল টোকিওর কবিতা হয়ে আকাশে লেখা থাকবে।

টাওয়ারের প্রতিটি স্তর ইতিহাসের ছোঁয়া বহন করে। এটি কেবল পর্যটক স্থান নয়, বরং জাপানের আধুনিক স্থাপত্য, টেলিভিশন সম্প্রচার এবং অর্থনৈতিক উত্থানের সাক্ষী। শহরের আলো, মানুষ এবং জীবনের ছন্দ একত্রে প্রবাহিত হয়। এখানে দাঁড়িয়ে শুধু দৃশ্য নয়, শহরের আত্মাকে অনুভব করা যায়।

জাপানের প্রথম অলিম্পিক স্টেডিয়াম

জাপানের ক্রীড়ার ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় শুরু হয়েছিল টোকিওতে আর তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ন্যাশনাল স্টেডিয়াম (কোকুরিৎসু কিয়োগিজো)। এটি ছিল জাপানের প্রথম অলিম্পিক স্টেডিয়াম, যেখানে ১৯৬৪ সালে এশিয়ার মাটিতে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয় গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পর জাপান যখন নতুন করে দাঁড়াচ্ছিল, তখন অলিম্পিক আয়োজক হওয়ার মাধ্যমে তারা বিশ্বকে জানাতে চেয়েছিল ‘আমরা ফিরে এসেছি’। ১৯৫৮ সালে নির্মিত ন্যাশনাল স্টেডিয়ামকে কেন্দ্র করেই সাজানো হয় ১৯৬৪ সালের অলিম্পিকের আয়োজন। এটি কেবল একটি ক্রীড়াঙ্গন নয়, বরং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আধুনিক জাপানের আত্মপ্রকাশের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

১৯৬৪ সালের উদ্বোধনী দিনে যখন সম্রাট হিরোহিতো অলিম্পিকের সূচনা ঘোষণা করেন, গোটা বিশ্বের দৃষ্টি ছিল এ স্টেডিয়ামের দিকে। জাপান প্রদর্শন করেছিল তাদের প্রযুক্তি, সংস্কৃতি আর সংগঠনের দক্ষতা। এখানে হয়েছিল অ্যাথলেটিকস, ফুটবলসহ নানা খেলা। এখানেই জন্ম নেয় অগণিত স্মৃতি-বিশ্বের চোখ ধাঁধানো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। অ্যাথলেটদের দৃঢ় প্রত্যয় আর রেকর্ড ভাঙার মুহূর্ত। টোকিওর আকাশে জ্বলে ওঠা অলিম্পিকের মশাল ২০১৫ সালে পুরোনো ন্যাশনাল স্টেডিয়াম ভেঙে ফেলা হয়, আর তার জায়গায় তৈরি হয় নতুন জাতীয় স্টেডিয়াম, যা স্থপতি কেনগো কুমার ডিজাইনে ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকের জন্য নির্মিত হয়। বাঁশ ও কাঠ দিয়ে সাজানো এ আধুনিক স্থাপনা প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের মিশেলে তৈরি এক স্থাপত্যকীর্তি।

প্রথম অলিম্পিক স্টেডিয়াম ছিল জাপানের আত্মবিশ্বাসের প্রতীক, আর নতুন স্টেডিয়াম হলো ভবিষ্যতের স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। ইতিহাসের পাতায় ১৯৬৪ সালের সে স্টেডিয়াম আজও জীবন্ত-যেখানে ক্রীড়াঙ্গন হয়ে উঠেছিল এক দেশ পুনর্জাগরণের কবিতা।

সেন্সোজি মন্দিও : এক কাব্যিক ভ্রমণগল্প

টোকিও শহরের ব্যস্ততা, গাড়ির শব্দ আর আকাশছোঁয়া বিল্ডিংয়ের ভিড় থেকে বের হয়ে যখন আসাকুসা পৌঁছাই, মনে হলো সময় যেন হঠাৎ ধীরে বইতে শুরু করলো। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে টোকিওর প্রাচীনতম রত্ন-সেন্সোজি মন্দির। প্রবেশপথে বিশাল লাল লণ্ঠন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কামিনারিমন (থান্ডার গেট)। লণ্ঠনের ওপর খোদাই করা অক্ষরগুলো যেন ইতিহাসের কণ্ঠস্বর। গেট পার হতেই শুরু হলো নাকামিসে দোরি-দুই পাশে দোকানের সারি, যেখানে রঙিন কিমোনো, জাপানি মুখোশ, মিষ্টি সেনবেই আর গরম গরম ইয়াকিসোবার ঘ্রাণ ভেসে আসছে। ভিড়ের মাঝেই আমি হাঁটছিলাম, মনে হচ্ছিল প্রতিটি দোকান যেন এক একটি গল্প শোনাচ্ছে।

ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম মন্দিরের মূল প্রাঙ্গণে। বিশাল ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষ ধূপ জ্বালাচ্ছে। ধোঁয়া উড়তে উড়তে আকাশ ছুঁতে লাগলো আর মনে হলো সবার প্রার্থনাও ভেসে যাচ্ছে সে ধোঁয়ার সঙ্গে। আশপাশে সবার মুখে একই বিশ্বাসের ছায়া-কেউ সাফল্যের জন্য, কেউ স্বাস্থ্যের জন্য, কেউ আবার কেবল মনের শান্তির জন্য প্রার্থনা করছে।

পাশেই দাঁড়িয়ে আছে পাঁচতলা প্যাগোডা। সোনালি আলোয় ঝলমল করতে করতে এটি যেন আকাশকে ছুঁয়ে দিয়েছে। আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম। শহরের কোলাহল মিলিয়ে গেল, কেবল শুনতে পেলাম ঘণ্টার শব্দ আর প্রার্থনার মৃদু সুর। গাইড জানায়, সন্ধ্যা নামতেই সেন্সোজি যেন আরো মোহনীয় হয়ে ওঠে। লাল লণ্ঠনের আলো জ্বলে উঠলে মন্দিরের দেওয়ালে পড়ে রহস্যময় ছায়া। মনে হয় এ যেন টোকিওর বুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা চিরন্তন কবিতা, যেখানে ইতিহাস, বিশ্বাস আর সৌন্দর্য মিলে তৈরি করেছে এক অদ্ভুত শান্তি।

টোকিও মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট বিল্ডিং

শিনজুকুর ভিড়ের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম টোকিও মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট বিল্ডিংয়ে। দূরে থেকেই দেখা যাচ্ছিল দুটি আকাশছোঁয়া টাওয়ার, মনে হচ্ছিল যেন শহরের দুই রক্ষক মাথা উঁচু করে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। টোকিও মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট বিল্ডিং-একটি আধুনিক স্থাপত্যকীর্তি, যা শুধু প্রশাসনিক কেন্দ্র নয়, বরং টোকিওর স্বপ্ন ও আশার প্রতীক।

TM-এ বিল্ডিংয়ের পরিকল্পনা শুরু হয় ১৯৮০-এর দশকে এবং নির্মাণ সম্পন্ন হয় ১৯৯১ সালে, বিখ্যাত স্থপতি কেনজো তানগের নকশায়। এটি দুটি আলাদা টাওয়ার নিয়ে গঠিত, যার উচ্চতা প্রায় ২৪৯ মিটার। এটির অবজারভেশন ডেকের মাধ্যমে টোকিও শহরের বিস্তৃত দৃশ্য উপভোগ করা যায়, যা দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ।

TM-এ বিল্ডিং শুধু প্রশাসনিক অফিস নয়; এটি টোকিওর আধুনিক স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনার মহাকাব্যিক দৃষ্টান্ত। শহরের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই ভবনটি যেন বলছে, ‘এখানে শহর শাসন করে, শহর স্বপ্ন দেখে’।

উপরের অবজারভেশন ডেক থেকে শহরটা দেখলে মনে হয় টোকিও যেন এক বিশাল ক্যানভাস। সূর্যাস্তের আলোতে কাচের ফধপ-অডগুলো ঝলমল করে আকাশের সঙ্গে মিলেমিশে যায়। সন্ধ্যার আলোয় শহরের ঝলমলে আলো যেন নীহারিকায় ভাসমান নক্ষত্রের মতো। প্রতিটি রাস্তা, সেতু, নদী যেন একক ভাসমান লাইন, আর টাওয়ারের ছাদের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হয় আপনি আকাশের চেয়ে সামান্য বেশি উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছেন। যখন রাতে শহরের আলো ঝলমল করছে, আর বাতাসে শহরের কোলাহলের মৃদু সুর ভেসে আসছে, TM-এ বিল্ডিং হয়ে ওঠে এক রোমান্টিক প্রেক্ষাপট।

আমরা প্রথমে প্রবেশ করলাম অবজারভেশন ডেকে। লিফটের কাচের দেওয়াল দিয়ে উঠে যখন বাইরে তাকালাম, টোকিও যেন আমাদের পায়ের তলায় বিস্তৃত এক বিশাল ক্যানভাস। আমি দাঁড়িয়ে আকাশের উচ্চতায় শহরের বাতাসে নিঃশ্বাস নিলাম, আর চোখে ধরা পড়লো, সূর্যাস্তের সোনালি আলো কাচের ফধপঅডে প্রতিফলিত হয়ে শহরের ভবনগুলোকে উজ্জ্বল করছে রাস্তা, নদী, সেতু-সব মিলেমিশে এক চলমান চিত্রশালা দূরে, পরিষ্কার দিনে ফুজি পর্বতও যেন আমাদের জন্য হাত ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

এ মুহূর্তে মনে হলো-TM-এ বিল্ডিং কেবল একটি প্রশাসনিক ভবন নয়; এটি হলো টোকিওর আত্মা। আকাশছোঁয়া স্থাপনা আর ঝলমলে শহরের আলো আমাদের ভ্রমণকে কাব্যিক ও রোমান্টিক এক অভিজ্ঞতায় পরিণত করেছে। আমরা এখানে দাঁড়িয়ে যেন শহরকে নতুন চোখে দেখছি-একসঙ্গে, হাত ধরে, প্রতিটি মুহূর্তে ভ্রমণের আনন্দে ভেসে।

১৯ আগস্ট ২০২৫

শেয়ার করুন