বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র উদ্যোগে সেমিনারে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ড. আনু মুহাম্মদ
বলেছেন, বিগত হাসিনার সরকারের আমলে জ্বালানী খাতের লুটপাট ও দূর্নিতির তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে ‘কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রঃ অভিজ্ঞতা কি বলে?’- শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, জাতীয় সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ব্যবস্থা করা এবং নাবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারের প্রতি বর্তমান সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের আহ্বান এবং গণ ট্রাইবুনাল করে জ্বালানী খাতের লুটপাট ও দূর্নিতির তদন্ত করে দ্রুত বিচার করার দাবী জানান তিনি।
বাপা’র সভাপতি, অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদার এর সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক, মো. আলমগীর কবির এর সঞ্চালনায় সেমিনারে মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাপা’র সহ-সভাপতি, জাতিসংঘের উন্নয়ন ও গবেষণা বিভাগের সাবেক প্রধান ড. নজরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ এর অধ্যাপক, ড. এম এম আকাশ ও সিইজিআইএস এর পরিচালক, মোহাম্মদ মোক্তারুজ্জামান।
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন, বাপা’র নির্বাহী সদস্য ও কোষাধ্যক্ষ জাকির হোসেন।
সেমিনারে মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকার ভুক্তভোগী মো. মহসিন, পায়রা এলাকার ভুক্তভোগী জে এম মাহবুবুল আলম এবং ও রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকার ভুক্তভোগী এস এম সবুর রানা উপস্থিত থেকে সেখানকার বর্তমান অবস্থার প্রকৃত চিত্র বর্ণনা করেন।
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বাপা’র সহ-সভাপতি, মহিদুল হকখান, যুগ্ম সম্পাদক, মিহির বিশ্বাস, নির্বাহী সদস্য, ড. হালিম দাদ খান, জাভেদ জাহান, জাতীয় পরিষদের সদস্য রাতুল হাসান, নাজিমুদ্দিনসহ বাপা’র অন্যান্য নেতৃবৃন্দ মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকার মোস্তফা বেগম, পায়রা এলাকার ভুক্তভোগী রবিউল ইসলাম ও রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকার ভুক্তভোগী সুজন মজুমদারসহ এবং বিভিন্ন পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ।
মুল প্রবন্ধে ড. নজরুল ইসলাম বলেন, বাপা, বেন, তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি, ও অন্যান্য মহলের সমালোচনা সত্ত্বেও সরকার জীবাশ্ম জ্বালানীর মধ্যে সবচেয়ে দূষণকারী আমদানিতৃত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করে। দেশের অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন, এবং ব্যবহারের প্রতি আগ্রহের অভাব, নবায়নযোগ্য জ্বালানীর প্রতি গুরুত্বের অভাব, বৃহদাকার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপর অতি নির্ভরশীলতা এবং স্পর্শকাতর পরিবেশসম্পন্ন এলাকার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে নেওয়া এই প্রকল্পগুলোর ক্ষতির প্রভাব এখন ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ হচ্ছে।
দায়মুক্তি আইনের অধীনে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, স্বজনপ্রীতি, লুটপাট, ব্যয়বহুল কুইক রেন্টালসমূহকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বহাল রাখা, অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে আমদানির মত বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে দেশের টাকা তচরুপের সুযোগ করে দিয়েছে এ সরকার এগুলোর বিরোধীতা করতে গিয়ে ফুলবাড়ির মত হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল বিগত হাসিনার সরকার।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, দেশের পরিবেশ রক্ষায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। রামপাল এলাকায় মাছ পাওয়া যাচ্ছে না মানুষ নিউট্রিশনের অভাবে এবং চর্মরোগে ভুগছে। শিল্প কারখানা করার সময় ইটিপি করার বিধান ধাকলেও তা কার্যত পালন করা হয় না। সুন্দরবরেনর মত একটি সংবেদনশীল স্থানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে দেশের প্রকৃতিকে ধংস করা হয়েছে।
অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ফসিল ফুয়েলের দীর্ঘ মেয়াদী সুফল নেগেটিভ। কয়তার তার মধ্যে অন্যতম। অপর দিকে গ্যাসে জ্বালানী উৎপাদনে নেট বেনিফিট অনেক বেশী ও পরিবেশ সহনশীল। তাহলে কেন আমরা গ্যাস এর পরিবর্তে কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প চালু করেছি একের পর এক। গত ফেসিস্ট সরকার সেটিই করেছে দেশের পরিবেশ- ধংস করেছে দেশের।
টাকা লুটপাট করেছে এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ফুলবাড়িতে হত্যার শিকার হয়েছে অনেক নিরিহ মানুষ। কিন্তু এখন আমরা এই অবস্থার পরিবর্তন চাই আমাদের গ্যাস অনুসন্ধান করতে হবে কম ক্ষতি করে এমন পরিবেশ বান্ধব জ্বালানীর উৎস বের করতে হবে।
মোহাম্মদ মোক্তারুজ্জামান বলেন, সিইজিআইএস এর টিম রামপালের পানি, মাটি পরিক্ষা করে পরিবেশের জন্য বড় ক্ষতিকর কোন লক্ষন চোখে পড়েনি। তিনি বলেন এই পরিক্ষাগুলো আমরা দেশের বুয়েট এবং সাইন্স ল্যাব থেকে করেছি। তিনি আরো বলেন কয়লা পোড়ালে পরিবেশের ক্ষতি হবে এটা নিশ্চিত, ফ্লাই এ্যাশ ও সালফার এর ক্ষতির যে পরিমাণ ক্ষতির কথা বলা হচ্ছে তা নয়। তিনি আরো বলেন সেখানকার সকল ইকুইপমেন্ট সচল রয়েছে কোনটায় অকেজ না।
সিইজিআইএস এর প্রতিবেদন এর প্রেক্ষিতে খুলনা বাপা প্রতিনিধি এড. বাবুল হাওলাদার বলেন, সিইজিআইএস এর প্রতিবেদন প্রকৃত অর্থেই এর বিপরিত। তিনি বলেন সিইজিআইএস এর টিম যখন যায় তখন তাদেরকে সব স্থান পরিদর্শন করতে নিয়ে যাওয়া হয় না অথবা তারা সব স্থান ও যন্ত্রাংস পরিদর্শন করেন না। সেখানকার মানুষ এখন রান্না করতে গেলে পানিতে ছাই পায়, কাপড় শুকাইতে দিলে কাপড়ে ছাই ভরে যায়, গাছের পাতাগুলোর উপর ছাই এর প্রলেপ পড়ে যায়। তিনি বলেন আপনারা যখন পরিদর্শনে যাবেন তখন স্থানীয় পরিবেশবাদীদের সাথে নিয়ে যাবেন তাহলে প্রকৃত চিত্রটা বুঝা যাবে।
মাতারবাড়ির ভুক্তভোগী মো. মহসিন বলেন, মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নের ৫ হাজার মানুষ তাদের কৃষি ও বসতভিটা ছেড়ে আজ উদবাস্ত। তাদেরকে সরকার যে ক্ষতিপুরণ দেওয়ার কথা ছিল তা দুই একজন ছাড়া অধিকাংশই পায়নি। সেসময় সরকার বাস্তুহারাদের চাকুরীর প্রতিশ্রতি দিলেও এখন অধিকাংশই সর্বস হারিয়ে পথে বসার উপক্রম। তিন ফসল জমি নষ্ট হয়েছে, চিংড়ি চাষের জমি ও লবন চাষের জমি এবং কোহেলিয়া নদী ধংস করা হয়েছে।
পায়রা এলাকার ভুক্তভোগী জে এম মাহবুবুল আলম বলেন, পায়রা এলাকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস মাছ শিকার ও কৃষিকাজ। এখন দুটিই নষ্ট হয়েছে। জেলেরা মাছ ধরতে গেলে মাছ পায়না। জমিতে ফসল ফলাতে গেলে আগে যে পরিমান ফলন হতো এখন তা হচ্ছে না। মানুষের শরীরে বিভিন্ন চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে অনেক সময় ওষধেও কোন কাজ হয় না।
রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকার ভুক্তভোগী এস এম সবুর রানা বলেন, বাংলাশের রক্ষাকবজ সুন্দরবন। সেই সুন্দরবনে করা হয়ে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এর ফলে সেখানকার বন ধংস হয়েছে। বনের প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। সুন্দর বনের সাথে যাদের জীবন জীবিকা জড়িত তারা আজ মানবেতর দিনাতিপাত করছে। নদী ও খালগুলোতে মাছ পাওয়া যায় না, এলাকাটা সবসময় ধোয়াচ্ছন্ন থাকে, মাওয়ালীরা মধু পায়না, মাছের প্রজনন নষ্ট হয়েছে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা অনেক কমেছে।
আজকের সেমিনার থেকে নিম্মোক্ত দাবি ও সুপারিশসমূহ তুলে ধরা হয়:
জ্বালানী খাতের নীতি বিষয়ক একটি কমিশন গঠন করতে হবে
উচ্ছেদের শিকার স্থানীয় জনগনকে তাদের প্রকৃত অর্থ প্রদান করতে হবে
সন্তোষজনক বিকল্প জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে
কয়লা থকে সরে এসে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর উপর গুরুত্ব দিতে হবে
দেশের ভেতর জাতীয় সক্ষমতার অধীনে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান বাড়াতে হবে
দেশজুড়ে বিস্তৃত মাঝারি আকারের সরকারি এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দক্ষ সমাহারের মাধ্যমে স্থায়িত্বশীল জ্বালানী ও বিদ্যুতের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে
গণ ট্রাইবুনাল করে জ্বালানী খাতের লুটপাট ও দূর্নিতির তদন্ত করে দ্রুত বিচার করতে হবে।