৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:২২:৩৬ অপরাহ্ন


জামায়াত পশ্চিমাদের কাছে মডারেট প্রমাণে মরিয়া
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-০৭-২০২৫
জামায়াত পশ্চিমাদের কাছে মডারেট প্রমাণে মরিয়া জামায়াতে ইসলামির লগো


জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের সাথে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠকে নারী নেতাদের উপস্থিতি নিয়ে নানা আলোচনা রাজনৈতিক অঙ্গনে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এধরনের বৈঠকটি রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ কয়েকটি কারণে যেমন ইঙ্গিতপূণ, তেমনি এর মাধ্যমে বিশেষ কিছু বার্তাও আছে। সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি এ্যান জ্যাকবসন। রাজধানীর মগবাজারে দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকের প্রথমবারের মতো ছিলেন জামায়াতের নারী নেতারাও। 

বৈঠকের কয়েকটি বিশেষ দিক

বৈঠকের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে ও-ই বৈঠকের ছবি প্রকাশ করেছে। এছাড়া বৈঠকের পর মহিলা জামায়াতের নেতারা ট্রেসি এ্যানকে জামদানি শাড়ি উপহার দেন। গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে যে, এর আগে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুকের সঙ্গে জামায়াতের নারী নেতারা বৈঠক করলেও, তাতে পুরুষ নেতারা ছিলেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে থাকা ট্রেসি এ্যানের সঙ্গে বৈঠকে একই টেবিলে একসারিতে জামায়াত আমিরের সঙ্গে ছিলেন নারী নেতারা। তারা হলেন জামায়াতের মহিলা বিভাগের সহকারী সেক্রেটারি সাইদা রুম্মান, কর্মপরিষদ সদস্য প্রফেসর ডা. হাবিবা চৌধুরী সুইট, মহিলা বিভাগের মজলিসে শূরা সদস্য, সাবেক এমপি ডা. আমিনা রহমান। কিন্তু এবারই কূটনৈতিক মহলে এদের বিচরণ দেখা গেলো। এমনকি দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দলটিতে এতদিন তাঁদের প্রকাশ্যে দেখা যায় না। ধর্মীয় এবং সাংগঠনিক কাজেই তাঁদের ভূমিকা সীমাবদ্ধ রাখা হতো জামায়াতের নারী সদস্যদের। 

প্রশ্ন হচ্ছে হঠ্যাৎ প্রকাশ্যে কেনো?

জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের সাথে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠক নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তেমন কোনো অলোচনা না থাকলেও এতে নারী নেতাদের উপস্থিতি নিয়ে রয়েছে আলোচনা। প্রশ্ন হচ্ছে কোনো পশ্চিমাদের সাথেই বৈঠকে দলটির নারী সদস্যদের এমন উপস্থিতি দেখা গেলো? কারো কারো মতে, বিষয়টি একেবারে রাজনৈতিক। বিশেষ করে জামায়াতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু এতো বছর বছর তারা কেনো নারী সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে উপস্থিত করাতো না? এনিয়ে একটি পক্ষ মনে করেন জামায়াতের সদস্যদের মধ্যে একটি বড়ো অংশ রয়েছে নারী। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ আমলে যখন জামায়াতে ইসলামীর কর্মকান্ডের ওপর কঠোরভাবে নজরদারি রেখেছিল, তখন পুরুষ সদস্যরাই বলা চলে বিভিন্নভাবে আত্মগোপন করেছেন, বা কৌশলে তারা অন্য কোনো দলে আত্মগোপন করেন, যা এখন গুপ্ত পার্টি বলে পরিচিতি পাচ্ছে। অন্যদিকে পুরুষ সদস্যরা বিভিন্ন সরকারি-বেসরাকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন তাই তাদের রাজনৈতিক পরিচয় পেশার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। অর্থ্যাৎ তারা গ্রেফতার হয়রানির প্রথম টার্গেট হতে পারে। একারণে পুরো আওয়ামী লীগ শাসনামলেই তাদেরকে ভালোভাবেই আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে গুপ্ত অবস্থায়। আর দীর্ঘ এসময় জামায়াতের নারী সদস্যদের একটি বিরাট অংশ গোপনে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে দলের জন্য শক্ত ভূমিকারা নামেন। বলা হচ্ছে ওই সময়ে ব্যপকভাবে নারী সদস্য পার্টির জন্য ভুমিকা রাখায় জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ এবং মজলিসের শুরার সদস্যদের উল্লেখযোগ্য অংশ এখন নারী। তবে এমনও দেখা গেছে, এতোকিছুর পরও আওয়ামী লীগ শাসনামলে ধরপাকড়ের মুখে জামায়াতের বহু নারী নেতাকর্মী-ও গ্রেপ্তার হন। জানা গেছে, জামায়াতের এখন পুরুষ সদস্যদের চেয়ে অনেক নারী সদস্যই ভালোভাবে দলের সাংগঠনিক কাজ চালাতে পারদর্শীতা দেখাচ্ছেন। কারো কারো মতে, দলের সঙ্কটকালে গোপনে জামায়াতের বহু নারী নেতাকর্মী সারাদেশে দলের সাংগঠনিক কর্মকান্ড সফলভাবে চালিয়েছেন। একারণে এখন তারা তাদের সাংগঠনিক যোগ্যতা দেখিয়ে বড়ো পদপদবি আসীন হতে দাবিদার হয়ে উঠছেন। আবার কারো কারো মতে, জামায়াতে নারী নেতারা এখন কেষে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। ধারণা করা হয় এসব ত্যাগি নারী নেতা-কর্মীরা এখন দলে তাদের প্রভাব ধরে রাখতে জোরালো ভূমিকা রাখছেন। এসব কারণেই জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের সাথে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠকে নারী নেতাদের উপস্থিতি দৃশ্যমান হয়েছে বা তাদের রাখতে বাধ্যই হয়েছেন বলেন কারো কারো অভিমত। 

পশ্চিমাদের কাছে আরও মডারেট ইসলামী দল প্রমাণ

কারো কারো মতে, পশ্চিমারা মনে করেন যে বাংলাদেশে জামায়াত একটি মৌলবাদী নারী বিদ্বেষী দল। এই জামায়াত বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতিই পাল্টে দিতে চায়। তাদের দল নারীদের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে চায়। এমন ধারণা পাল্টে দিতে অর্থ্যাৎ পশ্চিমাদের দেখানা হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী দলটি মডারেট ইসলাম ফলো করে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতে, জামায়াতে ইসলামী একটি মডারেট ইসলামিক দল। বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জামায়াতে ইসলামীকে এ স্বীকৃতি-ও দিয়েছিলেন। যদিও জামায়াত নেতারা বিভিন্ন সময় দাবি করেন যে, ভারত ছাড়া সব শক্তিই জামায়াতকে মডারেট ইসলামী দল মনে করে। তবে সম্প্রতি কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে যেসব কনসার্ন উত্থাপন করেছে, সেগুলোকে অতিসত্বর অ্যাড্রেস করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলসহ চার দফা দাবিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলাম আয়োজিত ওই মহাসমাবেশে এমন বক্তব্যকে কেউ কেউ নারীবিদ্বেষী বলে দেশে বিদেশে আলোচনার ঝড় বইয়ে দেয়া হয়। মাত্র কয়েকদিন আগে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারীদের রাজনৈতিক দল এনসিপি’র একজন কেন্দ্রীয় নেতার হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে অংশগ্রহণ নিয়ে যেমন প্রশ্ন তোলা হয়। তেমনি বহুল আলোচিত নারী সংস্কার ইস্যুতে তার সুস্পষ্ট বক্তব্যের মাঝে নারীবিদ্বেষী অবস্থান নিহিত রয়েছে কিনা ও-ই প্রশ্ন চলে আসে। এক্ষেত্রে হেফাজতে ইসলামী কোনো রাজনৈতিক দল না হওয়ার এধরণের অবস্থান তাদের জন্য কোনো ফ্যাক্টর বা চ্যালেঞ্চই না। কিন্তু এমন অবস্থানের দায়ভার গিয়ে পড়ে যারা ইসলামী দল বলে পরিচিত রাজনৈতিক দলগুলির ঘাড়ে। সেক্ষেত্রে জামায়াতের মতো দলের ঘাড়ে গিয়ে পড়েছে দলটি ‘নারী বিদ্বেষী’। এছাড়া ওই সমাবেশে নারী-সংস্কার কমিশন ঘিরে প্রকাশ্যে নারীকে গালি দেওয়া নিয়ে দেশে বিদেশে তোলপাড় বয়ে যায়। একারণে কারণে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছিল ছয় নারী। কারো কারো মতে, বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলি যে নারী বিদ্বেষী না এবং তারা অনেক মডারেট সেটি প্রমাণেই পশ্চিমাদের সাথে বৈঠকে জামায়াতের নারী নেতারা উপস্থিত হয়েছেন। আবার এমন-ও হতে পারে ইসলামী দল বলে দাবিদার রাজনৈতিক দলের নারী নেতাদের মুখেই তাদের অবস্থান ধ্যান ধারণা স্বচক্ষে দেখতে বা শুনতে পশ্চিমাদের পরামর্শে জামায়াতের নারী নেতাদের হাজির করানো হয়েছে। যেনো এমন বার্তা দেওয়া হয় জামায়াত আসলেই একটি মডারেট ইসলামী দল। উল্লেখ্য সম্প্রতি বাংলাদেশে জঙ্গী সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা জোরেসোরে অভিযোগ তুলেছে।

সর্বশেষ সম্প্রতি বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান নেই বলে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন কে-ও আশ্বস্ত করতে হয়েছে। এসব বিষয় সামনে রেখে নিজেদের মডারেট ইসলাম প্রমাণে জামায়াত তাদের নারী সদস্যদের মাঠে নামিয়েছে কি-না সামনের দিনগুলি বলে দেবে। 

শেয়ার করুন