৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৭:২৫:৫৫ অপরাহ্ন


অভিবাসী গ্রেফতারে শীর্ষে ২৬ ফেডারেল প্লাজা
নিউইয়র্কে কোর্টে হাজিরা মানেই ঝুঁকি
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৮-২০২৫
নিউইয়র্কে কোর্টে হাজিরা মানেই ঝুঁকি


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইমিগ্রেশন অফিস বা আদালতে ইন্টারভিউ দিতে বা অন্যান্য প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে আসা অভিবাসীদের জন্য নিউইয়র্ক সিটি এখন এক অস্বস্তিকর ও আতঙ্কজনক জায়গায় পরিণত হয়েছে। গত মে ও জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যেসব অভিবাসন কোর্টে গ্রেফতার হয়েছে, তার অর্ধেকেরও বেশি ঘটেছে নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটনে অবস্থিত তিনটি কোর্ট বিল্ডিংয়ে, বিশেষ করে ২৬ ফেডারেল প্লাজাকে কেন্দ্র করে। এই দুই মাসে শুধু এ এলাকায় ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) এজেন্টরা অন্তত ১৩৪ জন অভিবাসীকে গ্রেফতার করেছে। একই সময়ে নিউইয়র্ক সিটির মোট অভিবাসন গ্রেফতারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এবং জাতীয় গড়ের তুলনায় প্রায় ১৪গুণ বেশি।

এ গ্রেফতার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটছে আদালত চত্বরে, যেখানে অভিবাসীরা নিজেদের মামলা নিয়ে হাজির হচ্ছেন। তারা সেখানে আসেন আশ্রয় বা বৈধভাবে থাকার অনুমতি চেয়ে শুনানিতে অংশ নিতে। কিন্তু আদালতের ভেতরে বা বাইরে ওত পেতে থাকা মাস্কপরা ফেডারেল এজেন্টদের হাতে তাদের অনেকেই গ্রেফতার হচ্ছেন, যা একধরনের ‘কোর্ট ফাঁদ’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিচারকের সামনে শুনানি শেষ হওয়ার পর আদালত চত্বর ছেড়ে যাওয়ার সময় অনেক অভিবাসীকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে, কখনো কখনো বিচারকের চোখের সামনেই। এমনই এক ঘটনার সময় ইমিগ্রেশন বিচারক জন সিয়েমিয়েটকোভস্কি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, আপনারা নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন কী ঘটছে আমাদের কোর্টে। আপনি কাউকে চিনতে পারেন, যাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে-এমনকি আপনাকেও করা হতে পারে। এটা সত্যিই একটি ভারী মুহূর্ত।’

এ অবস্থা এমন একসময়ে ঘটছে, যখন ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসন আইন প্রয়োগে আগের চেয়ে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়েছে। গত মে মাসের শেষ সপ্তাহে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট একটি মেমো প্রকাশ করে, যেখানে তারা ‘সহযোগিতায় অস্বীকৃত’ শহরগুলোতে কোর্টভিত্তিক অভিযান চালানোর কৌশল উল্লেখ করে। একই সময়ে বাইডেন প্রশাসনের সময় প্রবর্তিত কোর্টে গ্রেফতার সীমাবদ্ধকারী নির্দেশনাও বাতিল করা হয়। এ পরিবর্তনের ফলে নিউইয়র্কে অভিবাসীদের জন্য কোর্টে যাওয়া একপ্রকার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ঘটনার প্রভাব আরো গভীর হয়েছে যখন দেখা যায়, আদালতের পাশাপাশি ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট অফিসে নিয়মিত ‘চেক-ইন’ করতে আসা অভিবাসীরাও গ্রেফতার হচ্ছেন।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য শহরগুলো, বিশেষ করে লস অ্যাঞ্জেলেসে অভিবাসন অভিযানগুলো আরো দৃশ্যমান এবং আক্রমণাত্মক হয়েছে। সেখানে হোম ডিপো, পার্ক এবং রাস্তায় প্রকাশ্যে অভিযান চালানো হচ্ছে, যার ফলে ব্যাপক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দেখা গেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন পরিস্থিতিতে লস অ্যাঞ্জেলেসে ন্যাশনাল গার্ড এবং পরবর্তী সময়ে মেরিন সেনাও মোতায়েন করেছেন। লস অ্যাঞ্জেলেসের মেয়র ক্যারেন বাস শহরটিকে সশস্ত্র দখলের অধীন বলে বর্ণনা করেছেন।

নিউইয়র্ক সিটিতে অবশ্য পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানকার কোর্টভিত্তিক অভিযানগুলো মূলত গোপনে ও নিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যার ফলে জনসম্মুখে তেমন বিক্ষোভ বা সংঘর্ষ দেখা যাচ্ছে না। মেয়র এরিক অ্যাডামস, যিনি একজন ডেমোক্র্যাট হিসেবে নির্বাচিত হলেও ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে একটি সহনশীল সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। তিনি প্রকাশ্যে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে এমনভাবে চলছেন, যাতে প্রকাশ্যে সংঘর্ষ এড়ানো যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে অভিবাসীদের ওপর চাপ আরো বাড়ছে। কারণ তারা কোর্ট বা চেক-ইন এজেন্সিতে যাওয়ার আগেই ভয় পাচ্ছেন যেকোনো মুহূর্তে গ্রেফতার হতে পারেন।

এদিকে মেয়র অ্যাডামসের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক মহলে। গত এপ্রিল মাসে ট্রাম্প প্রশাসনের বিচার বিভাগ তার বিরুদ্ধে থাকা দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। এর ঠিক পরদিনই অ্যাডামস ঘোষণা দেন, তিনি একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আবার নির্বাচনে অংশ নেবেন। সমালোচকদের মতে, কোর্ট অভিযান নিয়ে তার নীরবতা এ রাজনৈতিক হিসাবের অংশ হতে পারে।

এ চলমান অবস্থা নিউইয়র্ক সিটির অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে এক গভীর অনিশ্চয়তা এবং আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। কোর্টে না গিয়ে আত্মগোপনে থাকার প্রবণতা বাড়ছে, আইনজীবীরা বলছেন এ পরিস্থিতি আইনগত সহায়তা পাওয়া ও ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ধরনের অভিযান বন্ধ করার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন এখন পর্যন্ত এ নীতিতে পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত দেয়নি।

নিউইয়র্ক সিটিতে ইমিগ্রেশন কোর্ট ও অফিসগুলোতে অভিবাসীদের গ্রেফতারের হার যেভাবে রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অভিবাসন নীতির একটি অমানবিক ও বিচারবিরোধী রূপ উন্মোচন করছে, যেখানে আইনের আশ্রয় নিতে গিয়েই অনেকে নিজেকে ঝুঁকির মুখে ফেলছেন, যা শুধু অভিবাসীদের নয়, সমগ্র সমাজের ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারবিষয়ক মূল্যবোধের জন্য এক গভীর উদ্বেগের বার্তা বহন করে।

যারা আইন মেনে আদালতে হাজিরা দিতে আসছেন, তারাই এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়ছেন। এ বিশ্লেষণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতির এক অন্ধকার চেহারা প্রকাশ পাচ্ছে, যেখানে ন্যায়বিচারের নামে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ প্রবণতা শুধু অভিবাসীদের জন্য নয়, বরং গোটা সমাজের জন্যই এক গুরুতর প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে: আমরা কি সত্যিই আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ?

শেয়ার করুন