৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:৩৪:০৫ অপরাহ্ন


শেষ সময়ে শিক্ষক মাহেরীন
যাদের বাঁচিয়েছি তারাও তো আমার সন্তান
দেশ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-০৭-২০২৫
যাদের বাঁচিয়েছি তারাও তো আমার সন্তান শিক্ষিকা মাহেরীন


রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে আগুন ধরে গেলে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে দগ্ধ হন শিক্ষক মাহেরীন চৌধুরী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রথমে একাধিক শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করেন। পরে আবারও কয়েকজনকে বাঁচাতে ভিতরে গেলে নিজেই পুড়ে যান। ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২১ জুলাই সোমবার রাতে তিনি মারা যান।

মাহেরীন নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ী রাজারহাট চৌধুরী পাড়ার মহিতুর রহমান চৌধুরীর মেয়ে। গত ২০ জুলাই বিকালে বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে জানাজা শেষে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। মাহেরীনের স্বামী মনসুর হেলাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি ওকে (মাহেরীন) জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি তোমার নিজের দুই সন্তানের কথা একবারও ভাবলে না?’ সে বলল, ‘ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি? আমার সবকিছু দিয়ে চেষ্টা করেছি তাদের বাঁচাতে, কিন্তু পারিনি।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘শেষরাতে হাসপাতালে ওর সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়। আইসিউতে শুয়ে মাহেরীন আমার হাত নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বলেছিল তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না। আমি ওর হাত ধরতে গিয়েছিলাম, কিন্তু শরীরটা এমনভাবে পুড়ে গিয়েছিল যে ঠিকভাবে ধরতেও পারিনি।’

মাহেরীনের মৃত্যুতে চলছে শোকের মাতম। এলাকাবাসী জানান, শিক্ষকতার পাশাপাশি গ্রামে এসে সমাজসেবাও করতেন মাহেরীন। গত ২২ জুন বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ২৮ জুলাই আবারও প্রতিষ্ঠানটিতে আসার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু তার আগেই সেই প্রতিষ্ঠানের মাঠে তাঁর জানাজা হলো।

‘তারেক রহমানের চাচাতো বোন’ সেই সাহসী শিক্ষিকা মাহরিন

রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে জুলাই সোমবার দুপুরে বিকট শব্দ করে আছড়ে পড়ে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান। মুহূর্তেই প্রতিষ্ঠানটির ‘হায়দার আলী’ নামে দ্বিতল ভবন দাউ-দাউ করে জ্বলে ওঠে। আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নেয় শ্রেণিকক্ষে থাকা কোমলমতি শিশুদেরকে। শিশুদের সঙ্গে প্রাণ হারান শিক্ষিকা মাহরিন চৌধুরী, যিনি মাইলস্টোনের ওই শাখায় কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। এই দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৩২ জন এবং চিকিৎসাধীন আছেন ১৬৫ জন।

দুর্ঘটনার পর নিজের জীবনের কথা না ভেবে তার ছাত্র-ছাত্রীদের আগে বের করার জন্য চেষ্টা করেন মাহরিন। শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে তার শরীরের শতভাগই দগ্ধ হয়েছিল। এত বেশি ধোঁয়া আর আগুনে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে, তার শ্বাসনালি পুরোপুরি পুড়ে গিয়েছিল। দগ্ধ অবস্থায় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করার পর সোমবার রাত ৯টার কিছু আগে আইসিউতে মারা যান মমতাময়ী এই শিক্ষিকা। ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্ধারে তার সাহসী ভূমিকা ও আত্মত্যাগ গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ পেলে আলোচনায় আসেন মাহরিন। তাকে অনেকেই বীর বলে অ্যাখ্যা দেন। তার বিষয়ে আরও অজানা তথ্য প্রকাশ করে অনেকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। আর সেই অজানা তথ্যটি হলো- নিজের জীবন তুচ্ছ করে ২০ শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করা মাহরিন চৌধুরী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভাতিজি। প্রথমে এই বিষয়টি সামনে আনেন মাহরিনের সহপাঠী আলী আহমাদ মাবরুর নামে এক ব্যক্তি। ২২ জুলাই মঙ্গলবার সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে মাবরুর জানান, মানারাত ইউনিভার্সিতে তিনি ও মাহরিন একসঙ্গে ইংরেজিতে মাস্টার্স করেছেন। মাহরিন তার সিনিয়র ছিলেন এবং তাকে আপা ডাকতেন। দুজনই উত্তরাতে থাকতেন, সে হিসেবে মাহরিন তার প্রতিবেশীও ছিলেন। 

মাহরিনকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মাবরুর লেখেন, একদম সাদামাটাভাবে চলাফেরা করতেন মাহরিন। আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। গত কয়েক বছরে মাহরিন আপা প্রথমে তার পিতা এবং এরপর মাকেও হারান। পরিবারের বড়ো সন্তান হিসেবে সকল ভাই বোন বরাবরই তাকে অভিভাবক হিসেবেই গণ্য করতেন। তার দুটি ছেলে আছে। দুর্ঘটনার বিষয়ে তিনি লেখেন, যখন স্কুলের ওপর বিমানটি আছড়ে পড়ে, মাহরিন আপা তার স্বভাবসুলভ মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। নিশ্চিত আগুনে পুড়ে যাওয়া থেকে কমপক্ষে ২০ জনের বেশি ছাত্র-ছাত্রীকে তিনি সেইভ করেছেন। কিন্তু এই সাহসী ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে গিয়ে কখন নিজের জীবনকেই বিপন্ন করে ফেলেছেন, তা হয়তো তিনি বুঝতেও পারেননি। মাবরুর আরও জানান, মধ্যরাতে তার লাশ যখন বাসায় আনা হয়, আমি দেখতে গিয়েছিলাম। ওনার স্বামী আমাকে দেখে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘জানিস তোর আপা পরশু রাতেও তোর কথা বলেছিল’। ব্যক্তিগতভাবে মাহরিন ফরজ আমল, ইবাদত ও নিয়মিত কুরআন পড়তেন বলে জানান মাবরুর।

মাবরুর আরও জানান, মাহরিনের বাবা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাহেবের আপন চাচাতো ভাই এমআর চৌধুরী। যদিও এই পরিচয়টি তিনি দিতে চাইতেন না। পরিবার ছাড়া বাইরের খুব কম মানুষই তার এই পরিচয় জানতো। ফ্যাসিবাদী আমলে যখন কেউ বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান অফিসে কিংবা বাসায় বা হাসপাতালে যাওয়ার সাহস পেত না, মাহরিন আপা তখন গোপনে বেশ রাত করে যেতেন, খাবার ও পথ্য নিয়ে যেতেন। তবে তিনি এগুলো গোপন রাখতেন। তার ও তার পরিবারের সদস্যরা বিএনপির সুদিনে কখনো সামনে যায়নি। সুবিধা নেওয়ার মানসিকতা তার ভেতর আমি দেখিনি বরং স্কুল টিচার হিসেবেই তিনি জীবন কাটিয়ে দিলেন।

‘মাহরিন চৌধুরী জিয়াউর রহমানের ভাতিজি’- এ বিষয়টি নিয়ে মাবরুরের মতো আরও অনেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। মাবরুরের স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে তার সঙ্গে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করা হলে বিকালে তিনি জানান, তিনি মাহরিনকে নিয়ে যে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তা শতভাগ সত্য। মাহরিন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের চাচাতো বোন।

এদিকে তারেক রহমানকে ভাই দাবি করে দেওয়া মাহরিন চৌধুরীর একটি বক্তব্যের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি মাহরিন চৌধুরী। আমার বাবা মতিউর রহমান চৌধুরী...। আমার আরেকটা পরিচয় হলো- আমি তারেক রহমানের বোন, আমার চাচা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। আমি খুবই সামান্য একটা মানুষ...। আমি একটা চাকরি করি’। 

অপরদিকে মাহরিনের মৃত্যুর পর সাংবাদিকের কাছে এক নারীকে বলতে শোনা যায়, ‘যে মারা গেছে তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভাতিজি, তার বাড়ি নীলফামারী। 

মাহরিন চৌধুরী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভাতিজি কিনা জানতে চাইলে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, ‘তার দল তাকে এ বিষয়ে কিছু বলেনি’।

শেয়ার করুন