কয়েকদিন আগে ঢাকার হৃৎপিণ্ডে মিডফোর্ড হাসপাতালের সামনে ভাঙারি ব্যাবসায়ী সোহাগকে দিনদুপুরে অনেক মানুষের সামনে মাথায় পাথর দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করে মৃতদেহের ওপর বুনো উল্লাস করেছে অভিযুক্ত বিএনপির যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। বিএনপি তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্ত সবাইকে দলের সব ধরনের পর্যায় থেকে বহিষ্কার করেছে। মামলা হয়েছে, কিন্তু ভুক্তভোগীদের ধারণা মামলায় প্রকৃত দোষী কয়েকজনকে কৌশলে পরিত্রাণ দেওয়ায় ষড়যন্ত্র চলছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি চাঁদাবাজির পরিণতি বলা বলেও প্রাথমিক তদন্ত শেষে পুলিশ ধারণা করছে ব্যবসায়িক অন্তর্দ্বন্দ্ব। একই সঙ্গে খুলনায় একজন যুবদল নেতাকে হত্যা করে তার পায়ের রগ কেটে দেওয়াটা নিয়ে বড় একটা মহল নীরব। এটা নিয়েও সরব হওয়া উচিত ছিল যেমনটা মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরব হয়ে গিয়েছিল একটি মহল।
দুর্বৃত্তায়ন দূষিত রাজনীতির দেশে মব সন্ত্রাস, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, নির্মম হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সমাজ জীবনকে বিষাক্ত করে তুলেছে। যেসব ব্যর্থতার পরিণতিতে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের সরকারের করুণ পরিণতি হয়েছে সেখান থেকে কেউ কোনো শিক্ষা নেয়নি, বরং চাঁদাবাজি দখলদারিত্ব, মব সন্ত্রাস, নির্মম হত্যাকাণ্ড বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যে স্বপ্ন ও আদর্শ বুকে নিয়ে জুলাই-আগস্ট ২০২৪ তরুণ সমাজের নেতৃত্বে ৩৬ দিনের রক্তক্ষয়ী গণবিস্ফোরণ হয়েছিল তার সবকিছুই বিসর্জন হওয়ার পথে। বিগত কিছুদিন যাবৎ বেশকিছু চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণের ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়েছে অসহায় দেশবাসী। নির্বাচনকে সামনে রেখে শুরু হয়ে নগ্ন প্রতিহিংসার রাজনীতি। অনেকেই ঘটনাগুলোকে বর্তমান সরকারপ্রধানের মেটিকুলাস পরিকল্পনায় সরকার পরিবর্তনের ভিন্নরূপ মনে করছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়ে সরকারের নিস্পৃহতা দেখে অনেকেই এটাকে নির্বাচনকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেওয়ার সাজানো খেলা ভাবছেন।
জুলাই-আগস্ট গণবিস্ফোরণের পর সর্বস্তরের জনসাধারণ ইতিবাচক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিল। রাজপথে বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতালোভী দলগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্বে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে আঁধারের শক্তি ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করছে। প্রধান রাজনৈতিক দল লন্ডন থেকে দূর নিয়ন্ত্রিত হয়ে ভারসাম্য হীনতায় ভুগছে। অধিকাংশ স্থানে চাঁদাবাজি আর দখলদারিত্বের জন্য বিএনপির তৃণমূল নেতৃত্বের সংশ্লিষ্টতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। হতে পারে প্রতিপক্ষ বিএনপিকে ফাঁদে ফেলছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তথাকথিত নিরপেক্ষ সরকার কেন কঠোর হাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করছে না? কেন সর্বশেষ সোহাগ হত্যাকাণ্ডের নীরব সাক্ষী অন্তর্বর্তী সরকারের আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলো?
সরকার প্রতিটি ঘটনার অব্যাহতি পরে দোষী ব্যক্তিদের গ্রেফতার করছে। সরকার মব সন্ত্রাস দমনে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। তবুও কেন অব্যাহত গতিতে মব সন্ত্রাস চলছে। নীরবে সরবে চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে?
বিএনপি দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি, বেশ কয়েকবার সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থেকে সাফল্য ব্যর্থতা দুটিই রয়েছে। পতিত আওয়ামী সরকারের প্রধানতম বিকল্প হিসেবেই বিএনপি বিবেচিত হয়। অনেকের ধারণা নির্বাচন ডিসেম্বর ২০২৫, ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিল ২০২৬ যখনি হোক বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হবে। কিন্তু একই সঙ্গে দুঃখের সঙ্গে পরিলক্ষিত হয়েছে তৃণমূলে বিএনপি নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণহীন। চাঁদাবাজি, দখল দারিত্ব, ধর্ষণের অনেক অভিযোগ বিএনপির বিরুদ্ধে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখন অনেকটাই সুস্থ। তার উপস্থিতিতে দল পরিচিত হচ্ছে দেড় দশক বিদেশে জীবন কাটানো দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের নেতৃত্বে। অনেকেই মনে করেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারেক জিয়ার অধিকাংশ মামলা মীমাংসিত হওয়ায় তার অবিলম্বে দেশে এসে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ অপরিহার্য। অনেকের ধারণা, বিএনপির বিরুদ্ধে আঁধারের শক্তি ষড়যন্ত্রে নেমেছে। জেনে বা না জেনে বিএনপি সেই সাজানো ফাঁদে পা দিয়েছে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুক অবস্থার দায়-দায়িত্ব বর্তমান সরকারকে নিতে হবে। কিছু উপদেষ্টা যতই বলুক তারা মব সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতা করছে না। বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু ভিন্ন ইঙ্গিত দেয়। দেশে আজ পর্যন্ত একটি মব ভায়োলেন্স বন্ধ হয়নি। জুলাই-আগস্ট ২০২৪ নির্মম পুলিশ হত্যাকে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে একটি কথা আছে পাপ বাপকেও ছাড়ে না। প্রবল প্রতিপত্তিসম্পন্ন আওয়ামী লীগ সরকারের করুণ পরিণতি থেকেও কেউ শিক্ষা নিলো না, সেটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয়।
আশা করি, সরকার নির্বাচনকে উপলক্ষ করে সব রাজনৈতিক দল এবং শক্তির পরামর্শ নিয়ে দ্রুত সব অপশক্তিকে কার্যকরভাবে দমন করে নির্বাচনের আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করবে। দরকার হলে জাগ্রত যুবশক্তিকে কাজে লাগাবে।