৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:২১:০৯ অপরাহ্ন


বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন বাঁক
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-০২-২০২৫
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন বাঁক সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়ার সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃবৃন্দ


আওয়ামী দুঃশাসনে অতিষ্ঠ্য হয়ে উঠেছিল মানুষ। খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যেও চরম হতাশা ছিল। আর কত? পরিবর্তন দরকার। কিন্তু কে করবে পরিবর্তন? কে ধরবে হাল? বিএনপিকেও দেখা আছে। জামায়াতের সে যোগ্যতা এখনো হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ ভেবেছিলো ওয়ান ইলেভেনের ফসল ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের শাসন ভাল হবে। কিন্ত হলো বিপরীত। সেটাও ছিল দুঃশাসন, স্বৈরাতন্ত্র। বাংলাদেশের মানুষের আর নিস্তার নেই। এখন তো আওয়ামী লীগের, শেখ হাসিনার হাত থেকে রক্ষা নেই। দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতা ধরে রেখেছে প্রচন্ড দাপটে। স্বপ্ন ভীষণ ২০৪১। মানুষের নিস্তার নেই। যদি সৃষ্টিকর্তা কিছু করেন। শেষ পর্যন্ত জেগে উঠলো ছাত্র তরুণ সমাজ। রক্তবন্যার জুলাই আন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থান। 

বাংলাদেশের মানুষের মনের যে আর্তি শুনেছিলেন সৃষ্টিকর্তা। নতুবা যেভাবে প্রশাসনে তিন ও চার স্তর আওয়ামীকরণ করে সাজিয়ে, জেঁকে বসেছিল। যেভাবে বিরোধীপক্ষকে পাথর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল, টু শব্দটুকুও করতে দেয়নি। যার ভয়ে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল শেষ পর্যন্ত মোমবাতি প্রজ্জলন কর্মসূচি দিয়ে নিস্তার পাচ্ছিল না, সেখান থেকে এক রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিষ্ট হাসিনা সরকারের চিরতরে পতন। শুধু পতন নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করে পালিয়ে যায় স্বৈরাচার স্বদলবলে। 

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক নতুন বাঁক। যার সূচনা ৪৭, ৫২,৭১ হয়ে ২০২৪। বাংলাদেশের মানুষ এখন আর আওয়ামী লীগ নিয়ে ভাবে না। তাদের অস্তিত্ব আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত। এমন বিশাল এক দল, এমন বিশাল শক্তি নিয়ে যেভাবে চেপে বসেছিল ১৮ কোটি প্লাস মানুষের ঘাড়ে, সেখান থেকে নামাতে দুই হাজারেরও বেশি ছাত্র জনতার প্রাণ দিতে হয়েছে। যে রক্তের বন্যায় ভেসে গেছে শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ। যা প্রায় সাত মাস হয়ে গেলেও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও টু-শব্দ পর্যন্ত করতে পারছে না। ফিজিক্যালি তো দূরে থাক। ভয়ে তটস্ত সারাক্ষণ। যাদের হুঙ্কারে কাঁপতো সব, তাদের অনেকে কাপুরুষের মত পালিয়ে দেশ ছেড়েছে। কেউ কেউ দেশে গর্তে লুকিয়ে। 

বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এসেছে বিশাল পরিবর্তন। কান পাতলে শোনা যায়, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেন আরো কিছুদিন থাকেন। তিনি নিরপেক্ষ থেকে দেশের মানুষকে একটু স্বস্তি দেন। মানুষ যেন কথা বলার অধিকার ফিরে পায়। মানুষ যেন এটুকু ভাবতে পারে- এটা আমার দেশ। প্রাণ খুলে নি:শ্বাস নিতে পারে। কথা বলতে পারে। মত প্রকাশ করতে পারে। নিজের মত করে সমাজ গড়তে পারে। নিজের মত করে চলাফেরা করতে পারে। নিরাপত্তার অভাব বোধ না করে। শান্তিতে মৃত্যুবরণ করতে পারে। মৃত্যু যেন স্বাভাবিক হয়। পরিবার থাকে নিরাপদ। সবার যেন সমান অধিকার সমুন্নত থাকে। সৌহার্দ্য সম্প্রীতিতে বসবাস করতে পারে। রাজা প্রজার বিষয়টি যেন ভুলে যাই।

কিন্তু চাইলে সব পাওয়া যায় না। কারণ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ একজন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ব হলেও তিনি নির্বাচিত কেউ নন। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারায় তাকে নির্বাচিত হতে হবে শীর্ষ নেতৃত্বে থাকতে হলে। অথবা নির্বাচিত সরকারের কর্তৃক মনোনীতি হতে হবে। 

এমন দৃষ্টিকোন ছাত্র তরুণ সমাজেরও। বিরজামান রাজনৈতিক দলসমূহের কাছে এমনটা প্রত্যাশা করলেও না পাওয়ার ভয় থেকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের অভিলাস করেছেন। গড়ছেনও। ব্যাতিক্রমী এক উদ্যোগের মধ্যদিয়ে বিশাল জনসমাগমের মধ্যদিয়ে ঘোষণা হবে ছাত্র তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দলের। ছাত্ররা তৃণমূলের মানুষের ভাষা বুঝেছেন। ছাত্ররা সমাজের বৈষম্যটা অনুভব করেছেন। ছাত্ররা সমাজের দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু মানুষ যারা সরকার বদলালেও তারা বদলায় না কখনই, তাদের চিনতে পেরেছেন। সাধারণ মানুষও মত দিচ্ছে- দেশের প্রয়োজনে আজীবন ছাত্ররাই রক্ত দিয়ে এসেছে। জানপ্রাণ বিসর্জন দিয়ে এসেছে। জুলাই অভ্যুত্থানেও তারা সে কাজটা করেছে এ আধুনিক যুগে। ফলে তাদের কাছে দেশ সেভ। সমাজ সেভ। তাদের কাছে অন্তত আমাদের বক্তব্যটা তুলতে পারবো। তাদের কাছে এ জাতির অনেক প্রত্যাশা। 

নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজিব ভূইয়া, মাহফুজ আলম, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী, হান্নান মাসউদ, আখতার হোসেনরা বয়সে তরুণ হলেও বুদ্ধিতে তরুণ নয়। এদের বক্তব্যে হ্যামিলিয়নের বাঁশির সূর। এদের ডাকে ঘরের আরামের বিছানা, দামী সব খাবার, ল্যাপটপ, মোবাইল, রাজকীয় সব পরিবেশ ছুঁড়ে ফেলে রাস্তায় চলে আসেন তরুণ ছাত্র সমাজ। জুলাইয়ের আগেও দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন মানুষ। তরুণরা মশগুল ইন্টারনেটে, ভার্চুয়াল জগতে, দেশ নিয়ে চিন্তা নেই, দেশের ভবিষ্যত অন্ধকার! আজ তারা জেগে উঠেছে প্রচন্ড গতিতে, বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন তারা প্রিয় মাতৃভুমি ও এদেশের মানুষকে বৈষম্যের হাত থেকে মুক্ত করতে। এটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য দারুণ স্বস্তির। শুধু লেখাপড়া নয়। দেশকে গড়তে হবে যে যেভাবেই পারবে-এ মন্ত্রে বলীয়ান এখন তারা। 

সম্প্রতি সেনাকুঞ্জে এক অনুষ্ঠানে অসুস্থ খালেদা জিয়াও উপস্থিত হন আমন্ত্রণ পেয়ে। সেখানে এ ছাত্র সমন্বয়করা খালেদা জিয়ার সঙ্গে পরিচিত হতে তার হুইল চেয়ারের সামনে এসে পরিচিত হাসিমুখে। পরে তাদের মন্তব্য ‘আপনার গণতন্ত্রের জন্য ত্যাগ আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে।’ ‘আপনার আপোষহীন লড়াই আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।’ 

বলার আর অপেক্ষা রাখে না, এদের পেছনে বিশ্বখ্যাত একজন ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। যিনি ইতিমধ্যে বাংলাদেশের কতিপয় মেধাবী, দেশ বরেণ্যদের নিয়ে ইতিমধ্যে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছেন। সংবিধান সংস্কার, আইন সংস্কার থেকে শুরু করে অনেক কিছু। ভবিষ্যতে যেন আর কেউ কখনও ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচারী হয়ে না উঠতে পারে। বৈষম্য সৃষ্টি করতে না পারেন। দেশের সম্পদ যেন আর লুণ্ঠন করে অন্য দেশে নিয়ে যেতে না পারে। শ্রমিকরা যেন তাদের ন্যয্য হিসেব বুঝে পান। ন্যায্য সম্মানটুকু লাভ করতে পারেন। 

হয়তো নতুন এ দল দেশের সামগ্রিকভার নেয়ার যোগ্যতা এক্ষুনি অর্জন করতে পারবেন না। তবুও ক্ষমতায় আসার জন্য যে দলটি অপেক্ষমান সেটাও দীর্ঘ ১৭ বছরে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে। হাজার লক্ষ্য নির্যাতন সহ্য করেছে এ দল। নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার শত কুট কৌশল ছিল ফ্যাসিস্টদের। দলটির ত্রাণকর্তার ভূমিকায় যিনি- সেই তারেক রহমান মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে টিকে ছিলেন। মাকে রেখে পরিবার নিয়ে চলে যেতে হয়েছিল দেশ ছেড়ে। বিদেশের মাটিতে থাকতে হলো ওই ১৭ বছর। সেখানে থেকে দীর্ঘ সংগ্রামে তার মমতাময়ী, আপষহীন মা’কে হাজারো নির্যাতন সহ্য করতে দেখে ক্ষত বিক্ষত হয়েছেন। বাবা, মায়ের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের করে দেয়া থেকে শুরু করে পুরান ঢাকার একটি নিম্নমানের বসবাসের অনুপযোগী বাসা কারাগারে রূপান্তরিত করে সেখানে দীর্ঘদিন আটকে রাখা। উন্নত চিকিৎসা বঞ্চিত করা। তিল তিল করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া। ছোট ভাইকে যথার্থ চিকিৎসা না দিয়ে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেয়া। নিজ দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে গুম, খুন, হত্যার নির্যাতনের মাধ্যমে শেষ করে দেয়া। বাবা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের গড়া বিএনপিকে টুকরো টুকরো করার হাজারো প্লান ভেস্তে দিয়ে শীর্ষ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের শুধু মৌখিক শান্তনা দিয়ে যাদুর বশে বুলিয়ে টিকিয়ে রাখা বিএনপি যে আর আগের স্থানে নেই এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

মানুষই ভুল করে। সুদূর লন্ডন থেকে সবকিছুই অবজারব করা যায় না। কিছু ভুল মানুষ এরপরও রয়েছে। যারা দলকে কলুষিত করছেন। তাদের ছেটেও দিচ্ছেন। ফলে এই বিএনপিসহ ছাত্র তরুণদের দল সমন্বয় করে আগামীর রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব নেবে এটাই এখন সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের সংমিশ্রনে যে দলটি আগামী ভবিষ্যতে দাঁড়াবে বাংলাদেশে সে নেতৃত্বকে স্বাগত জানাতে এখন প্রস্তুত বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সংস্কারে থাকা লোকবল ও তার উপদেষ্টা পরিষদে যারা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন, এ তারুণ্যনির্ভর দল হয়তো তাদেরও ছাড়বেন না। 

ফলে মানুষ এখন আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। মানুষ আশা নিয়েই বাঁচে। ধৈর্য নিয়ে বাঁচেন। আর সৃষ্টিকর্তা এমন ধৈর্যশীলদের ভালবাসেন।

একটা কথা বাস্তব। আগামী ডিসেম্বরই হোক, আর মার্চ। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যে নতুন নেতৃত্ব লাভ করবে বাংলাদেশ সেটা গতানুগতিক হবে না এটা নিশ্চিত। জবাবদীহীমূলক এক সরকার হবে। এবং দেশের মানুষ সজাগ থাকলে কেউ যদি পূর্বধারায় ফেরার চিন্তাও করে, তার রেহাই হবে না। বাংলাদেশের মানুষ জেনে গেছে, বুঝে গেছে। এখন থেকে সরকারকে চলতে হবে মানুষের কথায়, তাদের মতে। এর বাইরে হলে আরেকটি ২০২৪ হতে সময় লাগবে না একটুও, এ চিন্তা মাথায় রাখতে হবে রাজনীতিবিদদের। তাছাড়া রাজনীতিবিদরা তো একটু দূরদর্শী সম্পন্ন। ওটা যার লোপ পাবে, আবারও ছাত্র জনতা তাদের বিনাশ করবে এটা ‘২৪ এর শিক্ষা থেকে ইতিমধ্যে জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা বলে বেড়াচ্ছেন। 

তারুণ্যের ডাক-“বুক পেতে দিয়েছিলাম গুলি কর। আমাকে গুলি করেনি, আমার ভাইকে করেছে। ভাই মরে গেছে, আমি বেঁচে রয়েছি, এটা বোনাস লাইফ। ফলে প্রয়োজনে আবারও নামবো- প্রয়োজন পড়বে শুধু একটি ডাক। আমরা ওই ডাকের অপেক্ষায় সজাগ থাকবো সারাক্ষণ দেশকে আর নতুন কোনো ফ্যাসিষ্টের কব্জায় যেতে দেব না।” 

শেয়ার করুন