৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৭:৪০:৩৪ অপরাহ্ন


কৌশলে শেখ হাসিনাকেই কি দুষলেন ছাত্রলীগ নেতা?
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-১২-২০২৪
কৌশলে শেখ হাসিনাকেই কি দুষলেন ছাত্রলীগ নেতা? শেখ হাসিনার সাথে গোলাম রাব্বানী


ফেইসবুকে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী’র একটি স্ট্যাটাস নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা গুঞ্জন দেখা দিয়েছে। কারো কারো মতে, তিনি জামায়াত ও এর নেতাকর্মী প্রশংসা করেই ফেসবুকে ওই বক্তব্য দিয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগ ও সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা মনে করে লাখ লাখ কর্মীকে মাঠে ফেলে শীর্ষ নেতাদের পালিয়ে যাওয়ারই নিন্দা ফুটে উঠেছে ওই রাব্বানীর কণ্ঠে। খোদ দলের সভানেত্রীকেই উদ্দেশ্য করেই তিনি এমন তীক্ষ্ণ মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছেন। 

কি বললেন রাব্বানী

গণমাধ্যমের খবরে দেখা যায় যে,‘আদর্শিক সহযোদ্ধার পাশে দাঁড়ানোর দলগত ও ব্যক্তিগত চর্চায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চেয়ে জামায়াত ও তাদের নেতাকর্মীরা ঢের এগিয়ে’- এমন মন্তব্য করেছেন নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী। 

গণমাধ্যমের খবরে দেখা যায় যে, সম্প্রতি নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে গোলাম রাব্বানী লিখেছেন, ‘একই নীতি, আদর্শ, চেতনায় বিশ্বাস করা নিজ দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ‘বৃহৎ আদর্শিক পরিবারের সদস্য’ হিসেবে ওন করা, যেকোনো ন্যায়সংগত প্রয়োজনে ও সংকটে আন্তরিকতা ও সাধ্যের সেরাটা দিয়ে পাশে থাকা, অত্যাবশ্যক রাজনৈতিক গুণ। আপনি স্বীকার করুন বা না করুন, আদর্শিক সহযোদ্ধার পাশে দাঁড়ানোর দলগত ও ব্যক্তিগত চর্চায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চেয়ে জামায়াত ও তাদের নেতাকর্মীরা ঢের এগিয়ে। বহু চড়াই-উতরাই, প্রতিকূলতার মাঝেও যা তাদের টিকে থাকার অন্যতম সহায়ক শক্তি, কার্যকর টনিক।’ ওই পোস্টে তিনি আরো লিখেছেন, ‘দলীয় ও ব্যক্তিগত ফান্ডে নেতাকর্মীদের শিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কোচিং ও দেশে-বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সহায়তা, নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানে একচ্ছত্র অগ্রাধিকার, হতাহত ও অসুস্থ নেতাকর্মীদের চিকিৎসা ও আইনগত সহায়তা, পরিবারসহ আর্থিক নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়াসহ এমন বহু প্রাসঙ্গিক কারণে আমাদের নেতাকর্মীরা সেখানে নিদারুণ কষ্ট ও হতাশায় ভোগে, তাদের নেতাকর্মীরা সেথা দলীয় সহায়তায় দারুণ মানসিক জোর পায়! ’৭১-এর ভূমিকাসহ বহুবিধ বিতর্ক-সমালোচনা থাকলেও তাদের আদর্শে বিশ্বাসীদের দায়িত্ব নেওয়ার আপ্রাণ প্রচেষ্টার জন্য তারা অনুকরণীয় প্রশংসার দাবিদার।’

এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের উদ্দেশে ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতা বলেন, ‘বর্তমান সংকটে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী শীর্ষ নেতৃত্বের শুভবুদ্ধি ও অনুধাবন শক্তি জাগ্রত হোক। দ্রুততম সময়ে দলীয় ফান্ড গঠন ও সচ্ছল নেতাদের দক্ষিণহস্ত প্র্রসারের মাধ্যমে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট ও অসহায় তৃণমূল নেতাকর্মীদের নৈতিক প্রয়োজন ও বিপদে সার্বিক সহায়তা প্রদানের অনিন্দ্য সুন্দর কালচারটা শুরু হোক। এটা আওয়ামী লীগ ও সব সহযোগী সংগঠনের তৃণমূলের প্রতিটি নেতাকর্মীর অন্তরে লালিত একান্ত চাওয়া ও নিদারুণ প্রত্যাশা।

কে এই রাব্বানী

গোলাম রাব্বানীর বাড়ি মাদারীপুর জেলায়। তিনি ছাত্রলীগের সাইফুর রহমান সোহাগ-এসএম জাকির হোসাইনের কমিটির শিক্ষা ও পাঠচক্রবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। এর আগে এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ-সিদ্দিকী নাজমুল আলমের কমিটিতে উপ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক ছিলেন রাব্বানী।

গোলাম রাব্বানী পারিবারিকভাবে আওয়ামী পরিবারের সন্তান। গোলাম রাব্বানীর মা মরহুমা তাছলিমা বেগম ছিলেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও স্থানীয় ইশিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মরহুম সামশুল হক মুন্সীর বড় মেয়ে। মরহুম সামশুল হক মুন্সী ছিলেন মরহুম শেখ মজিবুর রহমানের একান্ত সহচর এবং শেখ পরিবারের একজন অন্যতম সুহৃদ। গোলাম রাব্বানীর মা তাছলিমা বেগম ছিলেন রাজৈর কলেজ ছাত্রলীগের সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক (১৯৮৩-১৯৯১)। তিনি নব্বয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও এ এলাকায় ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তবে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছি। 

এর আগে এই প্রসঙ্গেই এর আগেও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী অভিযোগ তুলে বলেছিলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ফারজানার ‘মনগড়া’ মৌখিক অভিযোগ ও দলের কিছু নেতার ‘ষড়যন্ত্রে’ ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল তাকে। এ ক্ষেত্রে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি। এই রব্বানী বর্তমান সরকারের কাছে প্রভাবমুক্ত সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়মুক্তি ও সাবেক উপাচার্য ফারজানাকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে আলোড়ন তুলেন। চান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিচার।

কাকে খোঁচা দিলেন রাব্বানী

এই গোলাম রাব্বানী ফেইসবুকে এমন আকুতিতে আসলে কাকে উদ্দেশ্য করে মেসেজ দেয়া হয়েছিল? তিনি কি জামায়াত বা শিবিরের প্রশংসা করলেন? না-কি নিজ দল এক শ্রেণীর আওয়ামী লীগের কোটিপতি নেতাকর্মীদের দিকে তীর ছুড়লেন। যারা দল, প্রশাসনের প্রভাব খাটিয়ে এর পাশাপাশি দল-পদ পদবি বিক্রি করে কোটিপতি হয়েছেন। আবার কোটি কোটি টাকা খরচ করে ইতোমধ্যে সীমান্ত পার হয়ে গেছেন, কেউ কেউ পালিয়ে পশ্চিমা দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। গোলাম রাব্বানী তাদের উদ্দেশ্য করেই বোঝালেন যারা কোটি টাকা টাকা লুট করে নিয়ে এখন আমেরিকা লন্ডন কানাডায় বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন। যারা এক সময় জোর গলায় বলতেন বিএনপি’র জন্য যুবলীগ বা ছাত্রলীগই যথেষ্ট? কথায় কথায় গত ১৭ বছরে বিএনপি’র বিরুদ্ধে লাঠি মিছিল বের করতেন। এখন তারা কই? এদেরই কি গোলাম রাব্বানী খোঁচা দিলেন?

আওয়ামী লীগের একজন নেতা আক্ষেপ করে দেশ প্রতিনিধির কাছে বলেন, গত ১৭ বছরের যারা দেশে বিএনপি বা ছাত্রদল একটা কিছু করলেই লাঠি-সোটা হাতে নিয়ে বের হয়ে যেতেন, তারাই লাখ লাখ কর্মীদের মাঠে ফেলে দিব্বিই বিদেশে মজা করে ঘুরে বেরাচ্ছেন,সাজুগুজু করে ফেইসবুকে পোস্ট দিচ্ছে। গোলাম রাব্বানী কি তাদেরই উদ্দেশ্য করে তার ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন? তবে একজন নেতা এই দেশ প্রতিনিধিকে বলেন, আসলে ওই ধরনের স্ট্যাটাস দিয়েছেন, জামায়াত-শিবিরকে প্রশংসা করে না..। বলেছেন খোদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকেই উদ্দেশ্য করে। কারণ এখন দেশবাসী জেনেছে যে, এই শেখ হাসিনাই পালিয়ে যাাওয়ার দু’দিন আগেই জোর গলাতেই বলেছিলেন, তিনি পালাবেন না। অথচ এখন সেই শেখ হাসিনাই তার আত্মীয়-স্বজনদের দু’দিন আগেই দেশ ছেড়ে পালাতে সবধরনের ব্যবস্থা করেছেন, যা সম্প্রতি আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের বক্তব্যে পাওয়া গেছে। আইন উপদেষ্টা বলেছিলেন, ‘সততার সাথে কোনোরকম চালাকি নয়, কোনো উপদেষ্টা নয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার মনে হয়, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের জিজ্ঞেস করা উচিত, আপনি আপনার বৃহত্তর পরিবারকে নিয়ে, কাউকে না জানিয়ে এভাবে যে পালিয়ে গেলেন এবং আমাদেরকে প্রতিনিয়ত এভাবে যে উস্কানি দেন, বিক্ষোভ করার জন্য, সন্ত্রাস এবং উস্কানিমূলক কাজ করার জন্য, এই বিষয়ে আপনার ব্যাখ্যা কী?’

সম্প্রতি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ওই বক্তব্যের পাশাপাশি আইন উপদেষ্টা আরো বলেন, উনি ওনার ভাগ্নে, পরিবারের লোকজনদের সরকার পতনের ২-৩ দিন আগে নিরাপদে কেন বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উচিত, উনার পার্সোনাল জবাবদিহিতা চাওয়া। এখন প্রশ্ন নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী সম্প্রতি দেয়া ওই পোস্টে কি সেটাই বুঝিয়েছেন যে দলের খোদ সভাপতি শেখ হাসিনা কেনো তাদের একা ফেলে জীবনের ঝুকির মধ্যে রেখে গেলেন? কেন ত্যাগী নেতারা এখন ধুঁকে ধুঁকে দিন চরম অনিশ্চয়তায় দিনি কাটাচ্ছে? 

শেয়ার করুন