হঠাৎ করে ভারতে বাধ ছেড়ে দেওয়ায় সেখান থেকে আসা পানিতে ভেসে যাওয়া সিলেট কুমিল্লা ফেনী অঞ্চলে যে হাহাকার তৈরি হয়েছিল, তাতে মানুষ মুষড়ে পরেছিলেন। যে যা পেরেছেন সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। বিভিন্নভাবে সে সহায়তা প্রদান করা হলেও বড় একটা মাধ্যম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের ডাকে সাড়া দিয়ে টিএসসিতে অর্থ ও ত্রাণের মালামাল জমা দেয় বহু মানুষ।
ধর্মবর্ণনির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ নগদ অর্থ দিয়েছিলেন ত্রাণ তহবিলে। ছোট-বড় অনেকেই তখন নিজের জমানো অর্থ দান করতে মাটির ব্যাংক হাতে হাজির হয়েছিলেন টিএসসিতে, যা দেখে কেউ কেউ আপ্লুতও হয়েছিলেন।
কিন্তু ত্রাণ তহবিলে জমা পড়া সেইসব অর্থ বন্যার্তদের সহায়তায় ঠিকঠাক ব্যবহার হচ্ছে কি না, সেটি নিয়ে গত কিছুদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ধরনের আলোচনা চলছিল। আলোচনায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে যখন গত ১৪ সেপ্টেম্বর শনিবার সমন্বয়কদের বার্তা থেকে জানা গেছে যে, সংগৃহীত অর্থের বেশির ভাগই অব্যবহৃত অবস্থায় ব্যাংকে পড়ে রয়েছে।
শনিবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে লিখেনÑ‘ব্যয় বাদে বাকি টাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক শাখা, ইসলামী ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সংরক্ষিত রয়েছে।’
মূলত এ পোস্টের পরেই ত্রাণ তহবিলের টাকার আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠতে দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন মহলে চলছে নানান আলোচনা-সমালোচনা। কেন নগদ অর্থ বন্যার্তদের না দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে? এ প্রশ্নের ক্লিয়ার কোনো উত্তর নেই। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা আসলে কী? তহবিলের টাকা বন্যার্তদের সাহায্যে ব্যয় না করে ব্যাংকেই-বা রাখা হলো কেন? এ প্রশ্ন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সবাইকে।
সরকারি হিসেবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১টি জেলার ৫৬ লাখ মানুষ। তাদের জন্য ত্রাণ ও অর্থ গ্রহণ শুরু হয় টিএসসিতে গত ২২ আগস্ট। পরবর্তী দুই সপ্তাহে ওই তহবিলে প্রায় ১১ কোটি ১০ লাখ টাকা জমা পড়েছিল। এর মধ্য থেকে এখন পর্যন্ত বন্যার্তদের সহায়তায় খরচ হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অবশিষ্ট প্রায় ৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
এছাড়া খাবার-দাবারসহ অন্যান্য যত প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ হয়েছিল, প্রায় ১৯১টি ট্রাকে করে সেগুলো বন্যাদুর্গত এলাকায় নিয়ে বিতরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। বন্যার্তদের সহযোগিতার উদ্দেশে গঠিত ত্রাণ তহবিলের যে ৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যাংকে রাখা হয়েছে, সেটি নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই বলে জানাচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। ত্রাণ সহায়তার জন্য যত অর্থ আমরা পেয়েছি, সেগুলোর প্রতিটি পয়সার হিসাব আমাদের কাছে আছে। কাজেই এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, বললেন প্ল্যাটফর্মটির অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। প্রাথমিক ত্রাণ কার্যক্রমে খরচের পর তহবিলের বাকি অর্থের বেশির ভাগই জমা রাখা হয়েছে জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক এবং ইসলামী ব্যাংকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখায়।
চাইলেও সেগুলো কেউ আত্মসাৎ করতে পারবে না বলে জানাচ্ছেন হাসনাত আব্দুল্লাহ। কারণ সেগুলো বিশেষভাবে খোলা হয়েছে, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকও যুক্ত রয়েছেন। তিনিসহ আরো দুইজনের সম্মিলিত সিগনেচার ছাড়া কেউ টাকা তুলতে পারবে না, বলছিলেন এই সমন্বয়ক। এছাড়া অর্থের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তহবিলের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তিনি আরো বলেন, আমরা ত্রাণ কার্যক্রমের আয় ও ব্যয়ের ওপর একটি অডিট করছি এবং আগামী কয়েকদিনের মধ্যে অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। হাসনাত আরো বলেন, কেউ যদি দেখাতে পারে যে, আমরা ত্রাণ তহবিলের কোনো টাকা অন্যকাজে ব্যবহার করছি, তাহলে যা শাস্তি দেওয়া হবে, বিনাবাক্যে সেটা মাথা পেতে নেবো। তবে এর পরও যে প্রশ্নটা উঠছে তাহলো যে মানুষগুলোর জন্য উঠানো হলো অর্থ বা মানুষ তাদের সামর্থ্য থেকে অর্থ দান করলেন, সেসব টাকা তাদের না দিয়ে ব্যাংকে কেন? এর সঠিক কোনো উত্তর নেই। তবে তারা জানাচ্ছেন, বন্যার পরবর্তীতে মানুষকে সহায়তার জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়, তখন এটা ব্যবহার করা হবে। কিন্তু সেটা কখন? সে প্রশ্ন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
হাসনাত বলেন, ত্রাণ তহবিলের বেশির ভাগ টাকা পরিকল্পিতভাবেই ব্যাংকে রাখা হয়েছে বলে জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এ সমন্বয়ক। তিনি বলেন, তহবিল সংগ্রহের শুরুতেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, অর্থ সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে সব খরচ না করে বেশির ভাগই জমা রাখা হবে।
কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে কারণ কী? তিনি বলেন, কারণ আগের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা জেনেছি যে, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরবর্তী ধাপে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর অর্থ সহায়তা বেশি প্রয়োজন হয়। বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় এখন ওই অর্থ ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় ব্যয় করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। আরো আগে থেকেই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িঘর নির্মাণসহ অন্য কাজগুলো করে দেওয়ার কথা ভাবছিলাম, কিন্তু আয়-ব্যয়ের অডিট কমপ্লিট না হওয়ায় সেটা সম্ভব হচ্ছিল না।
নিরীক্ষা শেষ করে শিগগিরই তহবিলের সব অর্থ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ব্যয় করার পরিকল্পনাও জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সরকার যে তহবিল গঠন করেছে, সেখানেই টাকাগুলো দেওয়া হবে। এর ফলে সুষ্ঠু ও কার্যকরভাবেই আমাদের তহবিলের অর্থ মানুষের কাজে আসবে বলে আশা রাখি, বলে জানিয়েছেন হাসনাত।