৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:১৮:৫৩ অপরাহ্ন


কঠিন সময়ে শীর্ষ নেতারা হাসিনাকে একা রেখে আগেই সটকে পড়ে
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৮-২০২৪
কঠিন সময়ে শীর্ষ নেতারা হাসিনাকে একা রেখে আগেই সটকে পড়ে দেশত্যাগ করছেন শেখ হাসিনা


ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার অনেক আগেই সটকে পড়েছিলেন খোদ নিজ দলের তথাকথিত শীর্ষ নেতারা। এর পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে আস্কারা পাওয়া তথাকথিত কর্মী-শুভানুধ্যায়ীরা পাশে ছিলেন না তার। পাশে থাকেনি দলের ত্যাগি নেতাদের দাবিয়ে রেখে নিজ পছন্দমতদের মধ্য থেকে ‘ডামি’ নির্বাচনে বিজয়ী করে আনা এমপিরাও। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা যে টিকতে পারছেন না-এটা বুঝেই তারা গোপনে সড়ে পড়তে থাকেন। এসব তথ্য জানা গেছে বিভিন্ন সূত্র থেকে। 

সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হন। এরপর থেকে তিনি বাঙালীর বিভিন্ন গণআন্দোলনে ঐতিহাসিক বিপ্লবী ভূমিকা জানার পরও একের পর এক একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকার অদম্য বাসনায় লিপ্ত হন। ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন করেন। ২০১৮ সালে বিতর্কিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হন। এই নির্বাচনকে দেশবাসী ‘রাতের ভোট’ বলে আখ্যা দেয়। সব শেষে চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বীর দর্পে একতরফা নির্বাচন করে ফেলেন। বিরোধী দলগুলো ছাড়াই নিজ দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী বানিয়ে ‘ডামি’ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে তিনি আবারও ক্ষমতা নেন। এ নির্বাচন দেশে-বিদেশে ‘ডামি নির্বাচন’ হিসাবে পরিচিতি পায়। তবে এসব ডামি নির্বাচন করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাত মাসও টিকে থাকতে পারেনি। সাত মাসের মধ্যে ছাত্র আন্দোলন ও গণবিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।

অনেকে আগেই টের পায়

আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হচ্ছে। এমনকি আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা যে আর ক্ষমতায় থাকতে পারবে না- এমনটা দলের দলের অনেক শীর্ষই নয় মাঝারি গোছের নেতারা টের পেয়ে যান। তারা অতি গোপনে নিজেদেরকে গোছাতে থাকেন তলে তলে। কেউ কেউ চিকিৎসা বা পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করার কথা বলে দেশ ছাড়তে থাকে। কোটা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন একটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে, দেশ ছাড়েন দুই ডজন মন্ত্রী-এমপি। ওই পত্রিকার খবরে বলা হয় যে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড চীন ও দুবাই পাড়ি জমান সরকারি দলের প্রভাবশালীরা। 

এমন খবর প্রকাশিত হতে থাকলেও সরকারের শীর্ষ মহল থেকে শুরু করে তৃণমূলের কর্মীরা নার্ভাস হয়ে পড়ে। তারা কোটা আন্দোলন প্রতিরোধ দূরে থাক বিএনপি’কেও মোকাবিলা করতেও আগ্রহী হয় না, যা নিয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ে টানাপোড়েন দেখা দেয়। একটি সূত্র জানায়, কোটা আন্দোলন নিয়ে যে দল লেজে-গোবরে করে ফেলেছে এবং আওয়ামী লীগ যে ক্ষমতায় থাকতেই পারছে না সেটি তৃণমূলে স্পষ্ট হয়ে উঠে। এমনকি এমন আভাস পেয়ে যান যে সরকারেরর পতন অত্যাসন্ন। এসব মাথায় রেখে সংকটময় পরিস্থিতিতে সরকারের অনেক দায়িত্বশীল মন্ত্রী এবং এমপিদের অনেকে দেশ ত্যাগ করেছেন বলে শোনা যায়। কারো কারো মতে, খোদ প্রধানমন্ত্রীও এক পর্যায়ে টের পেয়ে যান। তাই প্রধানমন্ত্রী নিজে দেশে ঝুকি নিয়ে অবস্থান নিলেও তা অন্যদের মোকাবেলা না করতে দিয়ে নিরাপদে চলে যেতে সাহায্য করেন বা ব্যবস্থা করেছেন বলে শোনা যায়। 

খবর প্রকাশিত হয় যে, ছাত্রদের কোটা আন্দোলন ও দেশের পরিস্থিতি সহিংস হওয়ার মধ্যেই অনেক মন্ত্রী-এমপি ১৪ জুলাই থেকে ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে দেশ ছাড়েন। পরিস্থিতি নাজুক দেখে বিদেশ থেকে ফ্লাইটের টিকিট কেটে ঢাকা ছাড়েন অনেক প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রী। ধারণা করা হচ্ছে অধিকাংশরাই সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারত, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এমনকি চীন ও দুবাই পাড়ি জমান। আর এসব হয় খুবই গোপনে হয়। তবে একটি সূত্র মতে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঘুণাক্ষরেও টের পাননি মন্ত্রী-এমপি’রা পালানো প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। 

ইন্টারনেট বন্ধে আওয়ামী লীগও ক্ষতিগ্রস্ত

কোটা আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে দফায় দফায় ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয় সরকার। প্রথম বন্ধ করে পরে সাত দিনের মাথায় ৪ আগস্ট আবার ফোর-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ করা হয়। দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৫৪ লাখেরও বেশি। যার মধ্যে সাড়ে ১১ কোটির বেশি ব্যবহারকারী মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ফলে ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করে দেয়ায় সরকারের ধারণা কোটা আন্দোলনকারীদের আন্দোলন ভেস্তে যাবে। কিন্তু বরং এটা হিতে বিপরীত হয়।

জানা গেছে, দফায় দফায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ায় কারণে খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে দারুণভাবে ব্যর্থ হন। ফলে কোটা আন্দোলন মোকাবেলা দূরে থাক, আওয়ামী লীগের সারা দেশের নেতাকর্মীও এক ধরনের বিচ্ছিনতায় পড়ে যান, যা দলে ভয়াবহ সাংগঠনিক বিপর্যয় ডেকে আনতে সাহায্য করে। আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, ফেইসবুক বন্ধ করে সরকার দলের নেতাকর্মীদেরও বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এখন প্রশ্ন দেখা দেয়, গোপনে পালিয়ে যাওয়ার জন্যই কি নেতারা এসব যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছিল। কারো কারো মতে, আওয়ামী লীগের অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতারা এমন পরিস্থিতিতে দিক-নির্দেশনাহীন হয়ে পড়েন। আর এভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার কারণে মাঠে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জড়ো করে কোটা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করার ফুরসৎ পায়নি দলটি। তবে কারো কারো মতে, শেখ হাসিনাকে ফেলে অনেকেই গোপনে দেশ এমনকি মাঠ ত্যাগ করেছে অনেক আগে। বিশেষ করে দফায় দফায় একতরফা নির্বাচন করে একেবারে মাই ম্যানদের ক্ষমতার স্বাদ দিতে গিয়ে দলের ত্যাগি নেতাকর্মীরা অনেক আগে থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ে। যার চূড়ান্ত রূপ আসলে ৫ আগস্ট দেখা গেলো। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে মাঠে নামা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন বাংলাদেশে দেড়যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা পাঁচ মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বন্দুকের নল, শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু ও কারফিউ কোনোটাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে ঠেকাতে পারলো না। বিদায় নিতে হলো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীড়ের সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। 

শেখ হাসিনা আরো একা হলেন যেভাবে

জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের এক দফার আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে প্রভাব প্রতিপক্তি নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা ছিল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোর। ধারণা করা হয়, ৪ আগস্ট রোববার এভাবে মাঠে নামলে এক পর্যায়ে পিছু হটবে কোটা নিয়ে আন্দোণনকারীরা। শক্তি দেখাতে তাই গত রোববার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী, পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ-সংঘাতও হয়। এটা আরো চালাতে চেয়েছিল দলটি। কিন্তু ওই সময়ে খোঁজ খবর নিয়ে দেখা গেছে মাঠ পর্যায়ের আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাই মাঠে নেই। এসময়ই মাঠে রটে যায় দলের সাধারণ সম্পাদক থেকে অনুমতি নিয়ে অনেকে দেশ ছেড়েছেন, বা আত্মগোপনে চলে গেছেন। কারো কারো মতে, গোপন জায়গায় চলে গেছেন তারা। আর এভাবেই সাড়ে ১৫ বছর যাদের সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে দেশ শাসন করার পরও বিদায় কালে শেখ হাসিনা একা হয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্পস্ট হয়ে যায়। 

নেতাকর্মীদের আস্থা ছিল গভীর

পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী মাত্র কদিন আগেও বলেছিলেন- ‘শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালায় না, আমি শেখ মুজিবের মেয়ে।’ এড়িয়ে গিয়েছিলেন পদত্যাগের প্রশ্নও। কিন্তু সেই শেখ হাসিনা শেষ-মেষ পদত্যাগই করলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের তৃণমূল থেকে মাঠ পর্যায়ের নেতারা কেউ বিশ্বাসই করতে পারেননি এভাবে বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশ ছেড়ে পালাবেন। কেননা অনেকেরই বিশ্বাস ছিল শেখ হাসিনা যেভাবে ভূ-রাজনৈতিকভাবে সবাইকে ম্যানেজ করে ফেলেছিলেন। 

তাই তাকে সহজে পরাজিত করা যাবেই না। যেভাবেই হোক তিনি সব ধরনের বিরূপ পরিস্থিতিই ম্যানেজ করে ফেলবেন। আর এমন আস্থার কারণে নেতাকর্মীরা অনেকেই দলের সাংগঠনিক কাজ ফেলে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছিলেন। করতে থাকেন ব্যবসা বানিজ্যের বিশাল পাহাড়। আর এতেই দল যায় রসাতলে। সভাপতির প্রতি এমন আস্থার কারণে শেখ হাসিনা আসলে নেতাকর্মীদের কাছ থেকে দূরে সরে পড়েন তারই মনের অজান্তে।

শেয়ার করুন