মিশিগানের হ্যামট্রামিক শহরে দুই বাংলাদেশি আমেরিকান সিটি কাউন্সিল সদস্য, মোহাম্মদ কামরুল হাসান (৫৭) ও মুহতাসিন রহমান সাদমান (২৬)-এর বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে একাধিক গুরুতর অভিযোগে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত ৮ আগস্ট শুক্রবার মনরো কাউন্টির প্রসিকিউটর জেফ্রি ইয়োর্কি হাসান ও সাদমানের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে এই মামলা দায়ের করেন। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে অনুপস্থিত ব্যালটের আবেদনে জাল স্বাক্ষর, মিথ্যা তথ্য প্রদান এবং সাদমানের ক্ষেত্রে একজন অযোগ্য ভোটার হিসেবে ভোট দেওয়ার চেষ্টাসহ অন্য অযোগ্য ব্যক্তিদের ভোট দিতে উৎসাহিত করা। এ অভিযোগগুলো এসেছে একটি দীর্ঘ তদন্ত প্রক্রিয়ার পর, যেখানে একাধিক আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। প্রসিকিউটর জেফ্রি ইয়োর্কি বলেন, তদন্ত ছিল গভীর এবং বিস্তৃত। আমাদের দফতরে বহু তথ্য এসেছে যা যাচাই-বাছাই করেই আমরা এই অভিযোগপত্র দায়ের করেছি।
সাদমান এসব অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে বলেন, এ মামলাটি আমাদের বাংলাদেশি ও মুসলিম কমিউনিটিকে কলঙ্কিত করার একটি ষড়যন্ত্র। সবকিছুই সাজানো। আমরা এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করব। অন্যদিকে হাসান সরাসরি কোনো মন্তব্য না করলেও পূর্ববর্তী এক সিটি কাউন্সিল মিটিংয়ে তিনি বলেন, এসব মিথ্যা অভিযোগ আমার কর্মস্থলে সম্মানহানির কারণ হয়েছে এবং সামাজিকভাবে আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ২০২৩ সালের নির্বাচনে তিনটি সিটি কাউন্সিল পদে নির্বাচন হয়েছিল। প্রাথমিক (আগস্ট) নির্বাচনে হাসান ও সাদমান যথাক্রমে-চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান অর্জন করেছিলেন, তবে সাধারণ (নভেম্বর) নির্বাচনে হাসান প্রথম এবং সাদমান তৃতীয় স্থান অর্জন করেন, যার ফলে উভয়েই নির্বাচিত হন। এ প্রক্রিয়াতেই ভোটার অনুপস্থিত ব্যালট জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে।
নির্বাচনের আগে ও পরে বিভিন্ন সময়ে হ্যামট্রামিক সিটি ক্লার্ক রানা ফারাজ, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসকে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেন, যে শহরে কিছু প্রার্থী নতুনভাবে নাগরিকত্ব পাওয়া ভোটারদের কাছ থেকে অনুপস্থিত ব্যালট সংগ্রহ করে তা নিজেরা পূরণ করছিলেন। মার্চ ১০ তারিখে এ অভিযোগের ভিত্তিতে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস একটি অনুসন্ধান শুরু করে। পরে এপ্রিল মাসে একটি বিশেষ প্রসিকিউটর নিয়োগের অনুরোধ জানানো হয়।
হাসান ও সাদমান উভয়ের বিরুদ্ধেই তিনটি করে অভিযোগ আনা হয়েছে-অনুপস্থিত ব্যালট আবেদনে জাল স্বাক্ষর (ফেলনি সর্বোচ্চ ৫ বছর জেল বা ১ হাজার ডলার জরিমানা)। নির্বাচনী জালিয়াতি (ফেলনি সর্বোচ্চ ৫ বছর জেল বা ১ হাজার ডলার জরিমানা)। মিথ্যা তথ্য প্রদান (মিসডিমিনার সর্বোচ্চ ৯০ দিন জেল বা ৫০০ ডলার জরিমানা)। সাদমানের বিরুদ্ধে আরো দুটি অতিরিক্ত অভিযোগ রয়েছে-একজন অযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে ভোট দেওয়ার চেষ্টা ও অন্য অযোগ্যদের সহায়তার অভিযোগ (ফেলনি, সর্বোচ্চ ৪ বছর জেল বা ২ হাজার ডলার জরিমানা)। জানা গেছে, হাসান দীর্ঘদিন ধরে হ্যামট্রামিক শহরের রাজনীতিতে সক্রিয়। ২০০৯ সালে তিনি প্রথমবার কাউন্সিলে নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও পরাজিত হন। ২০২৩ সালে তিনি একটি বিতর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যাতে এলজিবিটিকিউ ও অন্যান্য রাজনৈতিক পতাকা শহরের সরকারি ভবনে প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়।
এই মামলাটি আরো বিতর্কিত হয়ে উঠেছে যখন জানা যায়, শুরুতে তদন্তের দায়িত্বে থাকা মিশিগানের অ্যাটর্নি জেনারেল ডানা নেসেল মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে পক্ষপাতিত্বের আশঙ্কায় নিজেকে মামলাটি থেকে প্রত্যাহার করে নেন। পরে মনরো কাউন্টির প্রসিকিউটরকে বিশেষভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ মামলাটি এমন এক সময়ে সামনে এলো, যখন হ্যামট্রামিক শহরে আরো দুটি তদন্ত চলছে-একটি দুই কাউন্সিল সদস্যের বাসস্থান নিয়ে, অন্যটি শহরের সিটি ম্যানেজার ও পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে। এমনকি এফবিআই কর্মকর্তারাও মে মাসে শহর পরিদর্শন করেন বলে সূত্র জানায়।
এ পুরো ঘটনার ফলে হ্যামট্রামিকের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চরমভাবে প্রশ্নের মুখে পড়েছে এবং শহরের মুসলিম ও বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্যমান অবিশ্বাস ও পক্ষপাতিত্বের আশঙ্কা আরো গভীর হয়েছে। পুরো শহরজুড়ে চলছে তীব্র বিতর্ক, প্রতিবাদ ও আইনি প্রক্রিয়ার উত্তেজনা। সবার চোখ এখন আদালতের রায় ও ভবিষ্যতের তদন্তের দিকে। এই মামলার রায় কেবল দুই কাউন্সিল সদস্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না, বরং এটি হ্যামট্রামিকের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মর্যাদা এবং নির্বাচনব্যবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।